জন্ম: ১৯৭২ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার পোরকরা গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা নুরম্নল হক মেম্বার দুই যুগের অধিককাল স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। মা হোসনে আরা বেগম।
শিক্ষা: স্থানীয় মক্তবে পড়াশোনা শুরু করেন এবং খুব অল্প বয়সে কোর’আনসহ অন্যান্য আদব-কায়দা শিক্ষালাভ করেন। পোরকরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর তিনি স্থানীয় আহমদ উলস্নাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এস.এস.সি. পাস করেন। তারপর লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচ.এস.সি. এবং ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি.এস.এস. পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অতঃপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
সত্যের সন্ধান: ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ভাবতেন মুসলমান জাতির দুরবস্থা নিয়ে। কলেজের হোস্টেলে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক ইনকিলাব- এই দু’টি পত্রিকা রাখা হতো। ইনকিলাবে বসনিয়ার মুসলমানদের অবস্থা, বিভিন্ন জায়গার মুসলমানদের নির্যাতনের কাহিনী পড়ে তার চিšত্মার জগতে আলোড়ন ওঠে। তিনি পৃথিবীময় মুসলিম জাতির দুরবস্থা দেখে ব্যথিত হন। ভাবতে থাকেন কেন এই বিপর্যয়, কোন পথে মুক্তি। জাতির এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করতে তিনি ছুটে যান বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে। সেখানে বহু সময় ব্যয় করেছেন। রাজধানীর গুরম্নত্বপূর্ণ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে ঘুরে ঘুরে তিনি অধ্যয়ন করতে থাকেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, আগারগাঁওতে অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারে দিনের পর দিন সময় কাটিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানের প্রয়াস পান। বহু সিরাতগ্রন্থ, ইতিহাসগ্রন্থ, গবেষণাগ্রন্থ, ফেকাহ গ্রন্থ তিনি পাঠ করেন। বহু সভা-সেমিনারে গিয়ে বিদগ্ধ ধর্মীয় চিন্তাবিদ, লেখক ও স্কলারদের বক্তব্য শ্রবণ করেন। কিন্তু কেউ তাঁর সত্যসন্ধানী আত্মার খোরাক যোগাতে পারত না। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকা- দেখে তিনি হতাশ হতেন। বিভিন্ন অসঙ্গতি, কথার সাথে কাজের অমিল, গোঁজামিল, অযৌক্তিক কর্মকা- ইত্যাদি দেখে তিনি বিরক্ত হতেন। তিনি দেখলেন, ধর্মের নামে অনেক কিছু চললেও সবই যেন স্বার্থপরতারই নামান্তর।
হেযবুত তওহীদে যোগদান: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ঢাকায় সঙ্গী-সাথীদের মুখে এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর নাম শোনেন। এমামুযযামানের লেখা “এ ইসলাম ইসলামই নয়” বইটি নিয়ে তখন সেখানে ব্যাপক তোলপাড় চলছিল। এক শ্রেণির আলেম তাঁর বই নিষিদ্ধ করার জন্য মিছিল করছিল। তিনি লোকমুখে এমামুয্যামান সম্পর্কে শুনতেন যে, এমামুযযামানএমন একজন মানুষ যার দাড়ি নাই, টুপি নাই, মাদ্রাসায় পড়েন নাই, কিন্তু তিনি এমন একটা বই লিখেছেন যে বইটার কারণে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, আলেমরা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। কিন্তু তিনি লোকের কথায় কান না দিয়ে বইটি সংগ্রহ করে পড়তে থাকলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এমামুযযামান সাথে দেখা করবেন, তাঁকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করবেন।
১৯৯৮ সাল। টাঙ্গাইলের করটিয়ার দাউদ মহলে হেযবুত তওহীদের এক সম্মেলনে যোগ দিলেন তিনি। এই সম্মেলনে একমাত্র তিনিই হেযবুত তওহীদের সদস্য না হয়ে যোগ দেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। এমামুয্যামানের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সরলতা, কথার মাধুর্য এবং যুক্তিবোধ তাকে অভিভূত করল। এমামুয্যামান মাদ্রাসায় পড়েন নি অথচ ধর্মের ব্যাপারে কী অগাধ পা-িত্য তাঁর! জমিদার বাড়ির সন্তান, কিন্তু অহংকারের লেশমাত্র তাঁর কথাবার্তা, চালচলনে নেই। তিনি দেখলেন, এমামুযযামান সামনে বসে যারা তাঁর আলোচনা শুনছেন তারা কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক, এক কথায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। যারা এক সময় তাদের প্রজা ছিলেন, যারা দাউদ মহলের সামনে দিয়ে হাঁটারও সাহস পেত না, তাদেরকে নিয়ে তিনি একসাথে চা খাচ্ছেন, খানা খাচ্ছেন, গল্প করছেন, ইসলামের বিষয় বুঝাচ্ছেন, কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে জবাব দিচ্ছেন, অসুস্থদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, যেন তারাও তাঁরই পরিবারের সদস্য।
এসব বিষয় তাঁর মনে অনেক নাড়া দেয়। আবার খটকাও লাগে, কারণ এতদিন ধরে ইসলামের যে রূপ তিনি দেখে আসছেন তার সাথে দৃশ্যগুলো ঠিক মেলাতে পারছিলেন না। যেমন- এমামুযযামান মিটিংয়ের এক পাশে মেয়েরাও বসতেন। ছেলে মেয়েরা এক জামাতে সালাহ (নামাজ) কায়েম করছেন ইত্যাদি। যাহোক, সব মিলিয়ে তিনি এমামুযযামান কথায় প্রচ-ভাবে আকৃষ্ট হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সত্য যদি থেকে থাকে সেটা এখানেই আছে। পরদিনও এমামুযযামান কথা শুনলেন। যতই শুনলেন ততই তাঁর সম্মুখে সত্য সুস্পষ্ট হতে লাগল। তিনি যেন স্বচক্ষে দেখতে পেলেন ঠিক কোন জায়গাটাই ভুল করছে এই মুসলিম নামধারী জাতি, কোথায় তারা পথ হারিয়েছে। আল্লঅহর সার্বভৌমত্ব বা তওহীদ থেকে সরে যাবার কারণেই আজ তাদের এই দুর্দশা। এই তওহীদের ঘোষণাই হচ্ছে ইসলামে প্রবেশের একমাত্র দুয়ার। পুনরায় তওহীদে ফিরে গেলেই তাদের মুক্তি সম্ভব হবে। তাহলেই তারা পাবে ইহকালে শাস্তি পরকালে জান্নাত, অন্য কোনোভাবে নয়। তওহীদের অর্থ কী, তাৎপর্য কী সেটা তিনি এমামুয্যামানের কাছে থেকে ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। তারপর ঢাকায় এসে আরও বই-পুস্তুক পড়েন। তারপর ১৯৯৮ সনের ফেব্রম্নয়ারী মাসের ২৮ তারিখে হেযবুত তওহীদ আন্দোলনে যোগদান করেন। সেই থেকে তাঁর সংগ্রামী পথ চলা শুরু।
তিনি জানতেন সত্য প্রকাশে বিপদ আসবে, বাধা-প্রতিবন্ধকতা আসবে, অপমানিত হতে হবে, আল্লাহর পরীক্ষা নিবেন। কিন্তু তাঁর জন্য এই পরীক্ষা মোটেও সহজ ছিল না। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে গিয়ে যখন তিনি সত্য প্রচার শুরম্ন করলেন, মানুষকে মুক্তির উপায় বোঝাতে লাগলেন, সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানালেন এবং ধর্মের নামে চলা অধর্মগুলোকে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করতে লাগলেন তখন এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু দিল। খ্রিষ্টান আখ্যা দিয়ে বারবার তাঁর বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর করা হয় এবং যারা হেযবুত তওহীদের সদস্য হয়েছিল তাদেরকে মারধোর, নির্যাতন করা হতে থাকে। ২০০৯ সালে তাঁদের বাড়িসহ হেযবুত তওহীদের সদস্যদের আরো আটটি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি ও সন্ত্রাসীরা।
মাননীয় এমামুয্যামান ইন্তেকাল করলেন ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি। এরপর থেকে আন্দোলনের সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে হেযবুত তওহীদের এমামের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে বর্তায়। মাননীয় এমামুয্যামানের রেখে যাওয়া আদর্শকে সমগ্র দেশে পরিচিত করে তোলার জন্য তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে বিপুল উদ্যম নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেযবুত তওহীদের সদস্য-সদস্যাগণ। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের শত শত মিলনায়তন, নগর-বন্দর, জনপদ। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতিকে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য দুই লক্ষাধিক সভা-সেমিনার, পথসভা, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠান করে হেযবুত তওহীদ।হেযবুত তওহীদের এই অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার জন্য ধর্মব্যবসায়ীদের তৎপরতাও সমান তালে চলতে থাকে। মাননীয় এমামের বাড়িতে সবচেয়ে জঘন্য বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলাটা হয় ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। তাঁর বাড়ির প্রাঙ্গনে নির্মাণাধীন মসজিদকে গির্জা আখ্যা দিয়ে, হেযবুত তওহীদকে খ্রিষ্টান অপবাদ দিয়ে মসজিদের মাইকে হামলা চালানোর জন্য মানুষকে আহ্বান করা হয়। স্থানীয় মাদ্রাসাগুলো থেকে ছাত্র ও শিক্ষকের, বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের সন্ত্রাসী বাহিনী এক জোট হয়ে এই দিন তার বাড়িতে হামলা করে প্রকাশ্য দিবালোকে হেযবুত তওহীদের দুইজন সদস্যকে হাত-পায়ের রগ কেটে জবাই করে হত্যা করে। তাদের শরীর পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তবে এত বাধা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তিনি সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পিছপা হন নি কখনই। আবারও সেই ধ্বংশস্তুপের উপর গড়ে তুলেছেন শহীদী জামে মসজিদসহ বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রতিষ্ঠান। তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্বে পাহাড়সমান মিথ্যার বিরুদ্ধে তওহীদের পতাকা নিয়ে এক মহাসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন হেযবুত তওহীদের নিবেদিতপ্রাণ সদস্য-সদস্যাগণ।