ইসলামের পারিবারিক ও সামাজিক নীতিমালা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইসলামে নারীকে অতুলনীয় সম্মান ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি একটি জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে সে জাতির মধ্যে নারীদের অবস্থান। কিন্তু যদি কোনো সমাজে নারীকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, অসম্মান ও অমর্যাদা করা হয়, বুঝতে হবে সেই জাতি জাতিগতভাবেই অধঃপতনের শিকার, সেই জাতির মধ্যে ধর্মের নয় অর্ধমের চর্চা করা হয়। সেই অধর্মকে যখন সাধারণ মানুষ ধর্ম বলে বিশ্বাস করে তখন শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, বিনষ্ট হয় শান্তি, ভারসাম্য। এই শান্তি, এই ভারসাম্য বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও নেই। কারণ সারা পৃথিবীতে নারীদের অবস্থা বিপর্যস্ত। ঘরে বাইরে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন হাজারো নারী। সমস্ত পৃথিবীতে নারীদের এই সীমাহীন দুর্ভোগ, নির্যাতন ও কষ্টকর জীবন প্রমাণ করে বর্তমান সভ্যতা মানবজাতিকে অধঃপতনের কত গভীরে নিয়ে গেছে। অথচ প্রকৃত ইসলামে নারীদের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতার উপর ভিত্তি করে সমাজের যেকোনো অঙ্গনে ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে।
কিন্তু সেই অধিকার হরণ করলো কারা? অন্যসব কাজ বাদ দিয়ে যদি শুধু ইসলামের জন্য কাজ করার কথা বলি, সেক্ষেত্রেও চরম বাধার শিকার হচ্ছেন হেযবুত তওহীদের নারীরা। গত বেশকিছুদিন ধরে পর পর কয়েকবার হেযবুত তওহীদের নারীরা রাস্তাঘাটে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। শুধু হেনস্তা করেই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী ক্ষান্ত হয়নি, মেয়েদেরকে গুরুতর আঘাত করেছে তারা। ফলে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে তাদের অনেককেই। কারণ একটাই, নারীরা কেন ঘরের বাইরে বের হয়ে পত্রিকা বিক্রি করছে, বই বিক্রি করছে, কেন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের আয়োজন করছে। এই অপরাধে সারা বাংলাদেশের বেশকিছু জায়গায় যেমন: খুলনা, রংপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আমাদের নারীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। আক্রমণের প্রথম ভাষাটাই হল – পর্দা কোথায়? বেপর্দা মহিলা রাস্তায় নেমে কেন এই কাজ করছে? তারপর রীতিমত হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমামকে নিয়ে অশ্লীল গালাগালি, এমামুয্যামানকে নিয়ে গালাগালি, ঘটনাস্থলে বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা বলার মাধ্যমে সাধারণ উগ্র ধর্মান্ধ জনতাকে লেলিয়ে দেয়া। তারপরে শুরু হয় গায়ে হাত তোলা। সেই দৃশ্য আবার পেছন থেকে ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে বিভিন্ন বাজে শব্দ ব্যবহার করে প্রচার করা।
এভাবে একটি ধর্মব্যবসায়ী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে, হামলা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেইনি। আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তবুও এখন পর্যন্ত অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্ত মনে আর হামলার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে। এইসব করে হয়ত তারা মনে করছে যে তারা বিজয়ী হয়ে গেছে। কিন্তু তারা আসলে পরাজিত হয়েছে। তারা আদর্শিকভাবে পরাজিত হয়েছে। হেযবুত তওহীদ যা বলে সব দলিল ভিত্তিক কথা বলে, অকাট্য যুক্তিপূর্ণ কথা বলে। তাই আমাদের কোনো কথার যুক্তি খণ্ডন করতে না পেরে তারা হেরে গেছে। হেরে গেছে বলেই আজকে তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে এবং রাস্তাঘাটে আমাদের বোনদেরকে আক্রমণ করছে।
এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে নারীরা আসলে কতটুকু নিরাপদ? এদেশে সরকার আছে, প্রশাসন আছে, তারপরও কেন সারাদেশে লক্ষ লক্ষ নারী তাদের অধিকার হারাচ্ছে? কেন সন্ত্রাসীপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে? যারা দুনিয়ার বিন্দুমাত্র খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন বর্তমানে নারীদের জন্য এই সমাজ কতটা অনিরাপদ। এই বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আর এই অনিরাপদ সমাজকেই নিরাপদ করার জন্য আমরা মাঠে নেমেছি। এই লড়াইটা আসলে আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে, অন্য কেউ করে দেবে না। অন্য কারো কাছে নিরাপদ সমাজ গড়ার পথ নেই। তাই এখন হেযবুত তওহীদের নারীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা কি এই ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হব, নাকি বিজয়ী হব? রাস্তাঘাটে এরকম হামলার শিকার হয়ে হেনস্তা হয়ে আমরা কি চুপ করে বসে থাকব, নাকি ব্যবস্থা গ্রহণ করব?
ভুলে গেলে চলবে না ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ একজন নারী। তওহীদ গ্রহণ করার জন্য যাঁকে প্রকাশ্যে ভয়াবহ নির্যাতনের পর বল্লম দিয়ে করা হয়েছিল। সেই সুমাইয়ার (রা.) কোরবানি তখনকার নারীদের এতোটাই উদ্দীপ্ত করেছিল যে নারীরা রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে রোমানদেরকে পরাজিত করেছিল। যে নারীদের মনে করা হতো অবলা-সরলা সেই নারীরাই রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। যেই হাতে তারা আটা পিষতো সেই হাতেই তারা তলোয়ার চালনা শিখেছিল। শুধু ইসলামের ইতিহাসে না, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার যেই নারীরা পরম মমতায় সন্তান লালন পালন করতো সেই তারাই রাইফেল কাধে তুলে নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। অন্যায়কে তারা মাথা পেতে নেয়নি। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।
ঠিক একইভাবে আজকে যারা নারীদেরকে অবদমন করে রেখেছে, যারা নারীদের বাক্সবন্দী করে রাখতে চাচ্ছে তারা অন্যায় করছে। আমাদেরকেও এর প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বলছি যে, ইসলাম নারীদের বাক্সবন্দী করে নাই, বাক্সবন্দী করেছে বর্তমানের ধর্মব্যবসায়ী কূপমণ্ডূক শ্রেণি। এই শ্রেণিটি চায় নারীদের শাসন করতে যাতে তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য আর কেউ না থাকে।
আমি সরকারকে পরিষ্কার করে বলতে চাই আমরা বাংলাদেশের আইনকে শ্রদ্ধা করি। আমরা আইন মান্যকারী আন্দোলন, এর মানে এই নয় রাস্তা-ঘাটে আমাদের নারীরা হেনস্তা হবে। যদি সরকার এই গোষ্ঠীকে সুযোগ দেয়, আস্কারা দেয় তবে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারীরা যেদিন রাজপথে নামবে তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে সেদিন যারা অন্যায়কে সমর্থন দিয়েছে, যারা আইনের দায়িত্ব পেয়েও আইন প্রয়োগ করেনি সেদিন আর তাদের রক্ষা থাকবে না। সেদিন কোনো কিছু দিয়েই তাদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইরানের মাহসা আমিনির কথা। ন্যায়ের জন্য একজন মানুষ যখন একবার জীবন দিতে শিখে তখন হাজার হাজার মানুষ নেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য শপথ নেয় জীবন দেয়ার।
সবশেষে ধর্মব্যবসায়ী স্বার্থানেস্বী গোষ্ঠিীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তোমরা পরিকল্পনা করো রাস্তাঘাটে হেনস্তা করার, সন্ত্রাসীপনা করার আর আমার প্রতিনিয়ত আশা করি ইসলামের জন্য শাহাদাত লাভ করার। তোমরা কার উপর হামলা করছ? কাকে হেনস্তা করছ? হেযবুত তওহীদের নারীরা চুপ করে বসে থাকার পাত্রী নয়। আমরা অবলা-সরলা নারী নই যে আমরা আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে চৌরাস্তায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাঁদব। আমরা প্রতিনিয়ত শাহাদাতের স্বপ্ন দেখি। আমাদের সন্তাদেরকে বড় করছি শহীদ করার জন্য। আমাদের স্বামীকে, আমাদের পিতাকে, আমাদের ভাইকে আমরা প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। কাজেই তোমরা সাবধান হয়ে যাও।
সত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ধর্মব্যবসায়ীদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সকল সত্যনিষ্ঠ মানুষকে। মনে রাখতে হবে, ধর্ম নয়- নারীকে প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে ধর্মব্যবসায়ীরা। যেদিন প্রকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিন অবশ্যই নারী তার পূর্ণ স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পাবে।