শাকিলা আলম
নারী পুরুষ যদিও একই সত্তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে তবু তারা স¤পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্টসম্পন্ন ভিন্ন দুটো সত্তা। এই চমকপ্রদ বিষয়টিকে আল্লাহ তাঁর একটি নিদর্শন বা আয়াত বলে পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করেছেন। বিপরীত বৈশিষ্ট্য ধারণ করার জন্যই নারী ও পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ চিরন্তন ও প্রাকৃতিক। যদি একজন নারীর প্রতি কোনো পুরুষ আকৃষ্টই না হয় তাহলে সে আর নারীই থাকে না। তেমনি পুরুষের বেলায়ও। এটাই হলো অপ্রাকৃতিক।
এই আকর্ষণ থেকে যেন কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়, মানুষ যেন প্রবৃত্তির পূজায় লিপ্ত না হয়, যেন কোনো ফেতনা বা অশান্তি সৃষ্টি না হয় সেজন্য কিছু নীতিমালা ও বিধিনিষেধ আল্লাহ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ঠিক করে দিয়েছেন। এগুলোকেই বলা হয় পর্দা বা হেজাব। কোর’আনে পর্দা শব্দটি নেই, সেখানে আছে হেজাব। এর অর্থ হলো আড়াল। হেজাব শব্দটি কেবল নারী-পুরুষের বেলায় নয়, বিভিন্ন প্রসঙ্গেই এ শব্দটি আল্লাহ ব্যবহার করেছেন, এমনকি নিজের বেলাতেও হেজাব অর্থাৎ আড়াল কথাটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, “কোনো মানুষের এ মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন, ওহীর মাধ্যম, পর্দার আড়াল অথবা কোনো দূত পাঠানো ছাড়া (সুরা শুরা ৫২)।
আল্লাহর এই বিধানগুলো (শরিয়াহ) কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু লক্ষ্য কখনও পাল্টায় নি। লক্ষ্য ছিল সমাজে যেন প্রবৃত্তির পূজা, বিশৃঙ্খলা, ফেতনা সৃষ্টি না হয়। শেষ নবীর সময়ে এই নীতিমালা এমন একটি সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থানে আনা হয়েছে যেন এই হুকুম সমগ্র মানবজাতির নারী-পুরুষই মেনে চলতে পারে, ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া, আঞ্চলিক সংস্কৃতি যেন এতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কেননা শেষ দীনটা এসেছে সমগ্র মানবজাতির জন্য, তাই এই দীনের গৃহের পরিসর সংকীর্ণ নয়, বিরাট। এখানে সমগ্র মানবজাতিকে এখানে প্রবেশ করানো হবে। এজন্যই কোর’আনে পোশাক আশাক নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনাই করা হয়নি, মূলত শালীনতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আপনি বলে দিন: আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন গোনাহ, অন্যায়-অত্যাচার চালানো, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোনো সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না (সুরা আরাফ ৩৩)।
প্রচলিত ইসলামে নারীদের পর্দাকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার আগে পর্দার প্রসঙ্গ চলে আসে। মনে হয় যেন পুরুষদের দাড়ি আর নারীদের বোরকাই হলো ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সাধারণ নারীদের হেজাব নিয়ে পবিত্র কোর’আনে দুটো আয়াত আছে যেখানে আল্লাহ বলেন, “হে নবী আপনি আপনার পতœীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মো’মেন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজের বুকের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে, ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না, আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু” [আল আহযাবের ৫৯]।
এই আয়াতে আল্লাহ নারীদেরকে চাদর বা ওড়নার মতো একটি বাড়তি বস্ত্রখ- দিয়ে নিজেদের বক্ষদেশকে আবৃত্ত করার জন্য বললেন যেন তা যৌন আবেদন সৃষ্টি না করে। আরো একটি বিষয়, এ আয়াতে এমন একটি পোশাকরীতির প্রস্তাব করা হয়েছে যা পরিধান করলে তাদেরকে চেনা সহজতর হয়। এতে করে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, নারীদেরকে মুখম-ল ঢেকে রাখতে বলা হয়নি। মুখম-ল ঢেকে রাখলে চেনা দুরূহ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় যে আয়াতটিতে আল্লাহ সাধারণ নারীদের পোশাকরীতি সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে তিনি বলছেন, (হে নবী) আপনি বিশ্বাসী পুরুষদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহকে হেফাজত করে। আপনি বিশ্বাসী নারীদেরও বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে, তারা যেন তাদের আভরণ (গোপন সৌন্দর্য) প্রদর্শন করে না বেড়ায়, তবে তাদের শরীরের যে অংশগুলো এমনিতেই খোলা থাকে তার কথা আলাদা (সুরা নূর, আয়াত-৩১)।
অর্থাৎ নারীরা তাদের সাধারণ প্রকাশমান অঙ্গগুলোকে উন্মুক্ত রাখবেন। চেনার জন্য মুখ খোলা রাখা, খাওয়ার জন্য, শ্বাস গ্রহণের জন্য নাক মুখ খোলা রাখা, কাজ করার জন্য হাত ও হাঁটার জন্য পায়ের প্রয়োজনীয় অংশ খোলা রাখা কি স্বাভাবিক নয়? ওগুলো ঢেকে রাখা কি অসুবিধাজনক নয়? তাই আল্লাহ ওটা ঢাকতে বলতে পারেন না, বললে সেটা অপ্রাকৃতিক হতো। আর ওগুলো যৌন আবেদনও সৃষ্টি করে না। আল্লাহ নারীর সাধারণ প্রকাশমান অংশ আবৃত করতে বলেন নি। এখন কেউ যদি ওগুলোও ঢেকে রাখার ফতোয়া দেন তাহলে সেটাই হবে দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি যা আল্লাহ হারাম করেছেন।
আর মহানবীর স্ত্রীদের জন্য একটি বিশেষ বিধানও কোর’আনে এসেছে। সেখানে আল্লাহ বলেন, হে নবী-পতœীগণ, তোমরা অন্য কোন নারীর মতো নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হবে। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং জাহেলি যুগের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তঁাঁর রসুলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে স¤পূর্ণরূপে পবিত্র করতে (সুরা আহযাব ৩২)।
এই আয়াতটি যে কেবলই নবী-পরিবারের জন্য এতে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশও আল্লাহ রাখেননি। তিনি একাধিকবার তাঁদেরকে এ আয়াতের মধ্যে সম্বোধন করে বিধান প্রকাশ করেছেন। তথাপিও তাফসিরকারকগণ এ আয়াতের বিধানাবলীকে সকল সাধারণ নারীর উপর চাপিয়ে দিতে উদগ্রীব। যেমন তাফসিরে জালালাইনে বলা হচ্ছে, এ আয়াতে নবী পতœীদেরকে সম্বোধন করা হলেও বিধান পৃথিবীর সকল নারীদের জন্য প্রদত্ত।
আল্লাহর দীনের অভিমুখ অবশ্যম্ভাবীরূপে বহির্মুখী। কারণ দীনটাকে সংগ্রামের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা না করা হলে দীন পাঠানোই অর্থহীন হয়ে যাবে। লক্ষ্য যেহেতু বহির্মুখী সেহেতু এই উম্মাহর অন্তর্মুখী হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। রসুলাল্লাহর সাহাবিরা তাদের সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন জেহাদের মাঠে, তাদের শতকরা আশি ভাগের কবর হয়েছে বিদেশের মাটিতে। পরবর্তীতে যখন এই জাতি জেহাদ ছেড়ে দিল তখন এই কাজটির ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য ফকিহ, মুফাস্সির, প-িতরা অন্তর্মুখী বিধান আবিষ্কার করলেন। তারা রসুলাল্লাহর সমগ্র সংগ্রামী জীবনকে বাদ দিয়ে সুন্নাহ নির্ধারণ করলেন দাড়ি, জোব্বা ইত্যাদি। তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ বাদ দিয়ে আবিষ্কার করলেন নফসের বিরুদ্ধে জেহাদই বড় জেহাদ। অথচ পবিত্র কোর’আনে সুস্পষ্ট আয়াত আছে, কোর’আন দ্বারা কাফেরদের বিরুদ্ধে বড় জেহাদ (জেহাদান কাবির) করো (সুরা ফোরকান ৫২)। রসুলাল্লাহ বলে গেলেন, তওহীদ জান্নাতের চাবি (ওবায়দাহ বিন সামিত (রা.) ও আনাস (রা.) থেকে বুখারী ও মুসলিম, মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, সিরাত ইবনে ইসহাক)।” আর হাদিস রচনা করা হলো, নামাজ জান্নাতের চাবি। মানুষ নামাজ পড়েই যদি জান্নাতে চলে যায় কে শুধু শুধু তওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য জেহাদ করতে যাবে? জেহাদের শ্রম ও ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জাতিকে অন্তর্মুখী আমলে উৎসাহিত করাকেই আলেমগণ তাদের লক্ষ্য বানিয়ে নিলেন। তারা নারীদেরকে অন্তর্মুখী বানিয়ে দিলেন পর্দা সংক্রান্ত চূড়ান্ত কঠোরতা আরোপ করে। সমগ্র নারী জাতিকে তারা সামষ্টিক জীবনের অঙ্গন থেকে, সামরিক অঙ্গন থেকে নির্বাসিত করে পাঠিয়ে দিলেন অন্দরমহলে, পরপুরুষের দৃষ্টিও যেন তাদের উপরে না পড়ে, তাদের কণ্ঠও যেন কেউ শুনতে না পায়। এসবকে তারা নাম দিলেন তাকওয়া। এভাবে একটি নব আবিষ্কৃত, মাসলা মাসায়েল নির্ভর বিকৃত ও বিপরীতমুখী ইসলাম সমাজে চালু হয়ে গেল। রসুলাল্লাহর সমগ্র জীবনের আদর্শ ঢাকা পড়ে গেল। রসুলাল্লাহর সময় মেয়েরা মসজিদে যেতেন, যুদ্ধে যেতেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন, হাসপাতাল পরিচালনা করতেন, আহত যোদ্ধাদের সেবা করতেন এসব ইতিহাসকে চাপা দিল তারা একটি অজুহাত তুলে। সেটা হলো, “এখন ফেতনার যুগ, রসুলাল্লাহর সাহাবিদের মতো মজবুত ঈমান ও আত্মিক পরিশুদ্ধি এখনকার সময়ের পুরুষদের নেই, তাই এখন মেয়েদের মসজিদে যাওয়া বন্ধ, কাজে কর্মে যাওয়া বন্ধ”।
আজ ইসলাম শত সহ¯্র ফেরকা মাজহাবে বিভক্ত। পর্দার বিধান নিয়ে একেক মাজহাব একেক বিধান দিচ্ছে। কেউ বলছে হাত-পা, চোখ-মুখ দেখা যাবে, কেউ বলছে ওগুলোও ঢেকে রাখতে হবে। সমাজের ফেতনা দূর করার জন্য আল্লাহ যে কেতাল বা যুদ্ধ করার হুকুম দিলেন, সেই হুকুমের দিকে আলেম সাহেবদের ভ্রুক্ষেপ নেই, তারা সহজ উপায় বের করেছেন, নারীকেই ঘরে বন্দী করে রাখো, তাহলেই তো হলো। নারীর প্রতি এই চরম অন্যায়কে তারা আল্লাহ রসুলের বিধান বলে চালিয়ে দিল। যেমন তাফসিরে জালালাইনে বলা হচ্ছে, ‘যে অংশ সাধারণত প্রকাশ পায়’ বলতে মুখম-ল ও দুই হাত বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এ প্রাসঙ্গিক দুই মতের একমত মতে ফিতনার ভয় না থাকলে পরপুরুষের জন্য তা দেখা বৈধ। দ্বিতীয় অভিমতটি হলো: তা দেখা হারাম। কারণ তা দেখলেও ফিতনার সম্ভাবনা আছে। এ অভিমতটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে ফিতনার দরজা বন্ধ করার জন্য। [তাফসীরে জালালাইন, পৃ:৪৬২] অর্থাৎ তারা সমাজকে পাল্টানোর ঝক্কিটা নিলেন না। নিজেরাও উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলেন এবং নারীদেরকেও সেটাই করতে বাধ্য করলেন। সমাজ উচ্ছন্নে গেল। আমরা যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করি, আমাদের একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আমরা কি আল্লাহর হুকুম (কোর’আন) ও রসুলাল্লাহর জীবনাদর্শ মানবো, নাকি আলেম-ওলামাগণ যে হুকুম দেন সেগুলো মানবো? যদি তাদের হুকুমগুলো আল্লাহর হুকুম ও রসুলের আদর্শের সঙ্গে বিপরীতমুখী হয় তবুও কি অন্ধভাবে তাদেরকেই মেনে চলব?
না। অবশ্যই মানবো না। আমরা মানবো আল্লাহর হুকুম ও রসুলের জীবনাদর্শ। তাই আসুন এবার হেজাবের বিধানের প্রায়োগিক দিকগুলো বিবেচনা করা যাক। প্রথমেই দেখে নেই রসুলাল্লাহর সমগ্র সংগ্রামী জীবনে তাঁর নারী সাহাবিদের ভূমিকা কী ছিল? এটা বিবেচনায় নিলেই সমস্ত বিতর্ক শেষ হয়ে যাবে, কারণ রসুলাল্লাহ যা করেছেন তা নিশ্চয়ই আল্লাহর হুকুম মাফিক করেছেন, নিজ থেকে করেননি। এক্ষেত্রে কতগুলো প্রশ্ন সামনে আসবে।
- রসুলাল্লাহর সময়ের মো’মেন নারীরা কি ঘরে বন্দি থাকতেন নাকি সর্বত্র বিচরণ করতেন?
- তাঁরা কি পর্দার আড়াল থেকে রসুলাল্লাহর কথা শুনতেন নাকি সামনা সামনি বসে শুনতেন?
- তাঁরা কি সর্বাঙ্গ আবৃত রেখে চলাফেরা করতেন নাকি তাদের চেহারাসহ স্বাভাবিক প্রকাশমান অঙ্গগুলো প্রকাশিত থাকত?
- পাঞ্জেগানা নামাজে, ঈদে, জুমায়, হজের সমাবেশে কি পুরুষের পাশাপাশি নারীদের উপস্থিত থাকা কি নিষিদ্ধ ছিল?
- জেহাদের মাঠে নারী সাহাবিরা শত্রু সৈন্যদের কীভাবে মোকাবেলা করতেন?
- নারীরা কি কেবল তাদের যুদ্ধাহত আত্মীয়দের সেবা করতেন নাকি যে কোনো যোদ্ধা সাহাবিদের সেবা করতেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসের পাতায় পাতায়, হাদিসের গ্রন্থে শত শত স্থানে খুঁজে পাওয়া যাবে। আনাস (রা.) বলেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন আয়েশা ও উম্মে সুলাইম দ্রুতপদে মশক বহন করে আনছিলেন এবং লোকদের মুখে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন (বোখারী ও মুসলিম)।” উম্মে আতিয়া (রা.) বলেন, আমি রসুলাল্লাহর সাথে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি তাদের জিনিসপত্রের তত্ত্বাবধান করার জন্য তাঁবুতে থেকে যেতাম এবং খাদ্য প্রস্তুত করতাম (মুসলিম)।” বহু হাদিস নারীরা বর্ণনা করেছেন যা তাঁরা রসুলাল্লাহর মুখ থেকে সরাসরি শুনেছেন। মসজিদে নারী পুরুষ একত্রে বসে রসুলের বক্তব্য শুনতেন। আমরা অনেকে হয়ত এও জানি না যে, রসুলাল্লাহর সময় মসজিদে নববী ঝাড়– দিতেন একজন মহিলা সাহাবি।
ওমর (রা.) একদিন রসুলের ঘরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। সেই সময় তাঁর কাছে একদল কোরাইশ মহিলা ছিলেন। তারা উচ্চৈঃস্বরে রসুলাল্লাহর সাথে কথা বলছিলেন এবং কোনো বিষয়ে আরো অধিক দাবি করছিলেন। কিন্তু ওমর (রা.) প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করলে তারা উঠে দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। রসুলাল্লাহ ওমরকে (রা.) আসার অনুমতি দিলেন। তিনি তখন হাসছিলেন। ওমর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আল্লাহ আপনার হাসি স্থায়ী করুন। রসুল বললেন, যে সব মেয়েরা আমার কাছে ছিল তাদের কর্মকা- দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। কারণ তারা তোমার কণ্ঠ শুনেই দ্রুত ভিতরে চলে গেল। ওমর বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনাকে বেশি ভয় করা তাদের উচিত। তারপর বললেন, হে নিজেদের দুশমনেরা! তোমরা কি আমাকে ভয় পাও এবং আল্লাহর রসুলকে ভয় পাও না? তারা বললো, হ্যাঁ তাই, আপনি রসুলের চাইতে কর্কশ ও কঠোর। রসুল বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ সেই মহান সত্তার শপথ! শয়তানও তোমাকে কোনো পথে চলতে দেখলে সে পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে (সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”
এই হাদিসটিই তো এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট যে নারীদের সঙ্গে আল্লাহর রসুল কোনো আড়াল ব্যাতিরেকেই আলোচনা করতেন এবং তিনিই আমাদের আদর্শ মহামানব। তাঁর চেয়ে বেশি পরহেজগার হওয়ার জন্য যারা আরো বাড়তি শরিয়ত আমাদের উপর চাপাতে চায় তাদের এই অতিভক্তি সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
বর্তমানের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের ধারণাকে মিলাতে গেলে আরো বহু প্রশ্ন সামনে আসবে। রসুলাল্লাহর স্ত্রী অর্থাৎ উম্মুল মো’মেনীনসহ রসুলাল্লাহর পরিবারের নারীদের জন্য অতিরিক্ত হেজাবের হুকুম ছিল। আল্লাহ তাঁদেরকে নির্দিষ্ট করে আহ্বান করে সেই হুকুম বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “হে নবী পতœীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে পর পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, ফল যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে কুচিন্তায় পতিত হবে, তোমরা ন্যায় সঙ্গত কথা বলো। তোমরা আপন গৃহে অবস্থান করো এবং জাহেলিয়াতের যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। (সুরা আহযাব ৩৩)।
পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহ নবী পতœীদের প্রসঙ্গে আরো বলেন, “তোমরা তাঁর পতœীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্যে এবং তাঁদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ। আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর পতœীগণকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ।” (সুরা আহযাব ৫৩)।
নবীর স্ত্রীগণ অন্যান্য নারীদের মত নন। কারণ তাদের স্বামী তখন সাধারণ কেউ নন, তিনি একটি মহান জাতির নেতা, তিনি একজন রসুল, তিনি সমগ্র জাতির অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। জাহেলি যুগে তাদের জন্য আলাদা কোনো বিধিনিষেধের প্রয়োজন ছিল না, তারা নিজেদের ইচ্ছেমাফিক চলাফেরা করতে পেরেছেন। কিন্তু এখন নবী পরিবারের যেমন অনেক বন্ধু হয়েছে তেমনি অনেক শত্রুরও জন্ম হয়েছে। ইতোমধ্যে বহু গোত্রের সঙ্গে বহু যুদ্ধবিগ্রহ হয়ে গেছে। তাই তোমাদের জীবনযাপন ও চলাফেরার উপরও অবশ্যই কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। একটি রাষ্ট্রের শাসক পরিবারের নারীরা অবশ্যই অন্যান্য নারীদের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। এটাই হচ্ছে ঐ নির্দেশ – যে তোমরা জাহেলি যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না। এখানে কিন্তু বের হতে নিষেধ করা হয়নি। আল্লাহ তাঁদের স্থান নির্ধারণ করেছেন মো’মেনদের মায়ের স্থান, তাদের পুনর্বিবাহও হারাম। তাই তাদের ও মো’মেনদের উভয়েরই আত্মার পবিত্রতা রক্ষার জন্য বলা হয়েছে যেন তাদের কাছ থেকে কিছু চাইলে বাহির থেকে চায়। এই আয়াতগুলোকে সকল মো’মেন নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অথচ সেটাই যদি ন্যায়সঙ্গত হতো তাহলে আল্লাহই তো সেভাবে সকল নারীদেরকে উদ্দেশ করে হুকুমটি নাজিল করতে পারতেন। তা তো তিনি করেননি। তিনি আলাদা আলাদা করে শ্রেণি উল্লেখ করে আয়াত নাজিল করেছেন। এই অতি বিশ্লেষণকারী আলেমদের বদৌলতে দীনের হুকুমগুলো এতটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আজ তা ইসলামের বিষয়ে নারীদেরকে বিরূপ করে তুলছে। অধিকাংশ নারী তাই কর্মজীবন শেষ করে বার্ধক্যে গিয়ে পর্দা করা শুরু করেন যে সময়টিতে তাদেরকে পর্দা করার ব্যাপারে আল্লাহই ছাড় দিয়েছেন।