আসাদ আলী:
ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে যে পরিমাণ প্রচার-প্রচারণা চলল তাতে মনে হচ্ছে এতদিন ভোট দেয়ার জন্য সময়-সুযোগের অপেক্ষায় মানুষ উন্মুখ হয়ে ছিল। প্রচারণার শুরুতেই ঢাকা শহর পোস্টারে ছেয়ে যায়। গত কয়েক দিন যাবৎ কী পরিমাণ মাইকিং হয়েছে, হ্যান্ডবিল বিতরণ হয়েছে, পথসভা, গণসংযোগ হয়েছে শহরবাসীরা ভালোভাবেই জানেন। এদিকে সকল টিভি-চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকার ফোকাস নির্বাচনের দিকে। অনলাইন জগৎও সরগরম একই বিষয়ে। আর ভোটের মৌসুমে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি খোশ মেজাজে থাকবেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তারাও সাজানো-গোছানো কথামালা দিয়ে ভোটযুদ্ধকে যথাসম্ভব সাজিয়েই রেখেছিলেন। প্রচারণায় যুক্ত হয়েছে অভিনব এক পদ্ধতি। মোবাইলে মেসেজ করে ভোট চাওয়া হচ্ছে। ভোটের অধিকারের কথা বলা হচ্ছে। স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে সবুজ ঢাকার। বলা হচ্ছে- ‘ভোট দিয়ে নগরপিতা নির্বাচন করা আপনার অধিকার। কাজেই আপনারা ভোটের অধিকার কাজে লাগান’। এই অধিকারের কথা এতবার বলা হচ্ছে, মিডিয়াতে প্রচার করা হচ্ছে, মোবাইলে মেসেজ করা হচ্ছে যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে গাফেলতি না করে। ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। নির্বাচন কমিশনও দু’বেলা সেটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা কপালে হালকা চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলছেন- সবকিছুই ঠিক আছে, তবে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কিন্তু বেশি হতে হবে, কম হলে অশনিসংকেত! ভালো কথা। ভোটার হিসেবে ভোটাধিকারের ব্যাপারে অবশ্যই সজাগ ও সচেতন হতে হবে। এতে আমিও দ্বিমত করছি না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমার আরও যে যে অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে সেগুলোর কথা কেউ বলছে না কেন? ওগুলোকে কি কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, নাকি গুরুত্বপূর্ণ জানার পরও এড়িয়ে চলা হচ্ছে?
নিরাপদে চলাফেরা করার অধিকার, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, জান-মালের অধিকার, আত্মরক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, বস্ত্রের অধিকার- এসব কি ভোটাধিকারের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? যদি তা না হয় তাহলে কেউ এসব অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না কেন? কেউ এ কথা বলে না কেন- তুমি স্বাধীনভাবে দেশের যে কোনো স্থানে চলাচল করতে পার, কেউ তোমার পথরোধ করতে পারবে না, তুমি তোমার মতামত নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পার কেউ তোমার কণ্ঠরোধ করতে পারবে না, তোমার জান-মাল নিয়ে নিশ্চিন্তভাবে বসবাস করবে কেউ তোমার জান-মালে ক্ষতি করতে পারবে না, তুমি এদেশের নাগরিক হিসেবে প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা সুবিধা লাভ করবে কেউ তোমাকে এ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না, কারণ এসব তোমার প্রাপ্য অধিকার। রাষ্ট্র তোমাকে এ অধিকার দিয়েছে। কেউ তা ছিনিয়ে নিতে পারে না।
কই, কেউ তো বলে না। কেউ তো এ কথা মনে করিয়ে দেয় না। কেউ তো মোবাইলে মেসেজ করে এ প্রশ্ন করে না যে, আপনি আপনার জান-মালের অধিকার বুঝে পেয়েছেন তো? জানি, এসব অধিকারের কথা কেউ বলবে না। কারণ যাদের খোঁজ নেয়ার কথা তারাই এ অধিকারগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত করে এসেছে পালাক্রমে। সিস্টেম এক মহাঘাতক। মানুষের অধিকারকে সে হরণ করছে অবলীলায়। কেবল একটি অধিকার সে জীবিত রেখেছে, ভোটের অধিকার। কথা হলো- ভোট কাকে দেবো? দুর্নীতিবাজকে? বোমাবাজকে? কে কার চেয়ে কম খারাপ এই বিবেচনায়? ভোট দেওয়া যেমন অধিকার, ভোট না দেওয়া যেমন অধিকার, তেমন যাকে ভোট দেওয়া হয়েছে সেই যখন দুর্নীতি করবে, মানুষের অধিকার হরণ করবে তখন তার টুঁটি চেপে ধরাও অধিকার। এ অধিকারগুলোর কথা তো কেউ বলেন না? যদি মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই আপনাদের উদ্দেশ্য হয় তাহলে কেবল ভোটাধিকার নয়, তার বাইরের অধিকারগুলোও স্মরণ করিয়ে দিন। দেশের মানুষ জানুক আসলে তাদের কী কী অধিকার ভোগ করার কথা, বাস্তবে কী কী অধিকার ভোগ করছে। তবেই তারা টুঁটি চিপে ধরতে শিখবে।