নাম তাঁর হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.), আবু ইয়ালা ও আবু আম্মারা তাঁর কুনিয়াত। রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর উপাধি দেন আসাদুল্লাহ। তাঁর জননী ‘হালা বিনতে উহাইব’ রসুলাল্লাহর (সা.) মাতা আমিনার চাচাতো বোন। তিনি ছিলেন রসুলাল্লাহর (সা.) আপন চাচা। তাছাড়া হামযা (রা.) ছিলেন রসুলাল্লাহর (সা.) দুধভাই। আবু লাহাবের দাসী ‘সুওয়াইবা’ তাঁদের দু’জনকে দুধ পান করিয়েছিলেন। তিনি বয়সে রসুলাল্লাহর (সা.) দু’বছর মতান্তরে চার বছরে বড়।
ছোট বেলা থেকেই তরবারি চালনা, তীরন্দাযী ও কুস্তির প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। ভ্রমণ ও শিকারে তাঁর ছিল সীমাহীন আকর্ষণ। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি এ কাজে ব্যয় করেছেন। রসুলাল্লাহর (সা.) নবুয়্যত প্রাপ্তির পর তখন বেশ কিছুদিন গত হয়েছে। তওহীদের আহ্বান তখন মক্কার অলিতে গলিতে ধ্বনিত হচ্ছিল। তবে হামযার (রা.) মত শিকার নিয়ে ব্যাস্ত লোকের এ ধরণের বিষয় অর্থাৎ সামষ্টিক জীবন ব্যবস্থা নিয়ে ভাবার বা মনোযোগ দেওয়ার মানসিকতা ছিল না।
আবু জাহেল একদিন সাফা পাহাড়ের পাদদেশে রসুলাল্লাহ (সা.) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় সে তাঁকে অশ্লীল গালিগালাজ ও ভর্ৎসনা করল এবং তার আনীত জীবনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় নিন্দা করল ও তাঁকে হীন বলে আখ্যায়িত করল। রসুলাল্লাহ (সা.) তাকে জবাবে কিছুই বললেন না। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআন এর আযাদকৃত দাসী নিজের ঘরে বসে আবু জাহেলের এসব অশ্লীল কথাবার্তা ও ব্যবহার শুনছিল। এরপর আবু জাহেল ঐ স্থান থেকে চলে গিয়ে কা’বার নিকট একদল কুরাইশদের সাথে বসল।
কিছুক্ষণ পর হামযা (রা.) ঐ পথ দিয়ে তীর-ধনুক সজ্জিত অবস্থায় শিকার থেকে ফিরছিলেন। হামযা (রা.) ঐ দাসীর ঘরের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় সে তাঁকে বলল; “হে ‘আবু আম্মারা’ এইমাত্র আপনার ভাতিজা মোহাম্মদ (সা.) আবুল হাকাম ইবনে হিশামের কাছ থেকে যে ব্যবহারটি পেল, তা যদি আপনি দেখতেন! সে মোহাম্মদকে (সা.) এখানে বসা দেখে বিনা কারণে গালাগাল করল এবং অত্যন্ত ঘৃণ্য আচরণ করল, তারপর চলে গেল। মোহাম্মদ (সা.) তাকে কিছুই বলেন নি”।
এ খবর শুনে হামযা (রা.) ক্রোধে অধীর হয়ে আবু জাহেলের খোঁজে বায়তুল্লাহর দিকে ছুটলেন। সেখানে গিয়েই তিনি দেখলেন আবু জাহেল কিছু লোকের সাথে বসে আছে। তিনি তার দিকে এগিয়ে গেলেন, সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি স্বীয় ধনুকটি দিয়ে তার মাথায় খুব জোরে আঘাত করলেন, ফলে আবু জাহেলের মাথা রক্তাক্ত হলো। তারপর হামযা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, “তুমি তাঁকে (মোহাম্মদ) তিরস্কার কর! জেনে রাখ, আমিও তো তাঁর ধর্মের অনুসারী এবং সে যা বলে আমিও তা বলি। এখন পারলে আমাকে কিছু করে দেখাও দেখি”। এ সময় আবু জাহেলকে সাহায্য করার জন্য বনু মাখযূমের কিছু লোক হামযার দিকে ছুটে এলো। আবু জাহেল তখন তাদেরকে বলল; “থাক! ‘আবু আম্মারা’কে কিছু বলো না। আমি তার ভাতিজাকে সত্যিই খুব খারাপ গালি দিয়েছি”।
ঘটনার পর হামযার (রা.) উত্তেজনা কমে আসলে তাঁর মধ্যে ভাবান্তর আসলো। তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন যে, উত্তেজিত অবস্থায় যদিও তিনি কথাগুলো বলে ফেলেছেন, কিন্তু সত্যি সত্যি কি তিনি তাঁর বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করতে পারবেন। আর কোনটাই বা সঠিক? এতদিনের পালন করা ধর্ম, না কি মোহাম্মদের আনীত ধর্ম? এ সকল প্রশ্ন তাঁর মনে তোলপাড় শুরু করলো। এক ভয়াবহ দোলাচলে দোলতে লাগলো তাঁর মন। অবশেষে সিদ্ধান্তহীন হয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে মোনাজাত ধরলেন হামযা (রা.); “হে আল্লাহ! মোহাম্মদের কথা যদি সত্য হয় এবং সে সত্যিই যদি তোমার প্রেরিত রসুল হয়, তাহলে এই বিশ্বাস আমার অন্তরে স্থির করে দাও! আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা কর! আর যদি তা সত্য না হয় তাহলে আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর!”
এরপর তিনি মোহাম্মদ (সা.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের মনের এই দোদ্যুলমানতার কথা তুলে ধরে পরামর্শ ও দোয়া চাইলেন। আল্লাহর রসুল (সা.) অত্যন্ত শান্তভাবে তাঁর কথা শুনার পর তাঁকে তওহীদের দিকে আহবান করলেন এবং দিকনির্দেশনমূলক কথা বললেন। এরপর তিনি প্রাণখুলে আল্লাহর দরবারে হামযার (রা.) মনের স্থিতিশীলতার জন্য এবং তাঁকে হেদায়াতদানের দোয়া করলেন।
এই সময়টা ছিল রসুলাল্লাহর উপর ঈমান আনয়নকারী মু’মীনদের জন্য সেই দুঃসময়ের কথা, যখন রসুল (সা.) আরকাম ইবনে আবুল আরকামের গৃহে আশ্রয় নিয়ে গোপনে তওহীদের আহবান করছিলেন। রসুলের (সা.) আহবানে তখন গুটিকয় মানুষ সাড়া দিয়েছেন। যারাই প্রকাশ্যে তওহীদের এই ঘোষণা দিয়েছেন তারাই অতি দ্রুত সমাজ এবং পরিবারের নিকট অনেকটা অচ্ছ্যুত হয়ে নিরাশ্রয় ও নিরন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছেন। শুধু তাই নয় এমতাবস্থায় তারা হয়ে পড়েছিলেন চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীন। এদের মধ্যে যাদের সামাজিক অবস্থান একটু দুর্বল ছিল তারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা.) এর পরিবারের সকল সদস্য তওহীদ গ্রহণের ফলে আবু জাহেল গংদের নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি ছাড়া তাঁর মা, বাবা, ভাই সকলেই শহীদ হন। আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা.) এর মাতা সুমাইয়া (রা.) আখেরী ইসলামের প্রথম শহীদ। এমতাবস্থায় হামযা (রা.) এর তওহীদ গ্রহণ, পুরো পরিস্থিতির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। হামযার (রা.) দ্বীন গ্রহণের জন্য বিরুদ্ধবাদীদের অপতৎপরতা অনেকটা হ্রাস পায়।
এর কিছুদিন পরেই উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তওহীদ গ্রহণের জন্য মনস্থ করে রসুলাল্লাহর নিকট দারুল আরকামে উপস্থিত হলেন। রসুলাল্লাহ তখন কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন, হামযা (র.) ও তাদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) সেখানে সশস্ত্র অবস্থায় উপস্থিত হলেন। উমারকে (রা.) এই অবস্থায় এসে দরজায় কড়া নাড়তে দেখে উপস্থিত সকলেই পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু হামযা তাদের অভয় দিয়ে বললেন; “তাঁকে আসতে দাও। যদি সে ভালো উদ্দেশ্যে এসে থাকে, আমরাও তাঁর সাথে ভালো ব্যাবহার করবো। অন্যথায় তাঁরই তরবারি দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হবে”। কিন্তু উমর (রা.) উল্টো তওহীদ গ্রহণের ঘোষণা দিলে সকলেই খুশিতে তকবীর দিলেন। হামযার (রা.) পর উমরের ইসলাম গ্রহণ মু’মিনদের অবস্থান যথেষ্ট দৃঢ় করে। এই দুই জনের তওহীদ গ্রহণ রসুলাল্লাহর (সা.) আনীত দ্বীনকে অপ্রতিরোধ্য গতি ও শক্তি দান করে।
মক্কায় অবস্থানকালে রসুলাল্লাহ (সা.) তার অতি আদরের পালক পুত্র যায়িদ ইবনে হারিসা (রা.) এর সাথে হামযার (রা.) ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। যায়িদের প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা এত প্রগাঢ় হয় যে, যখন তিনি বাইরে কোথাও যেতেন, তখন তাঁকেই সব ব্যাপারে অসিয়ত করে যেতেন। নবুয়্যতের ত্রয়োদশ বছরে অন্য সকলের সঙ্গে হামযাও (রা.) মদিনায় হিজরত করলেন।
হিজরতের পর সপ্তম মাসে রসুল (সা.) ‘ঈস’ অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দিকে ত্রিশ সদস্যের মুহাজিরদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠান। উদ্দেশ্য, কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। মদিনা থেকে যাত্রার প্রাক্কালে রসুল (সা.) এই বাহিনীর নেতৃত্ব হামযার (রা.) হাতে তুলে দেন। এখানে তাঁরা আবু জাহেলের নেতৃত্বাধীন মক্কার তিনশো অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হন। তারা সিরিয়া থেকে ফিরছিল। কিন্তু মাজদী ইবনে আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় এ যাত্রা সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়। মাজদীর সাথে দু’পক্ষের সন্ধি চুক্তি ছিল। ইবনে আবদিল বার সহ কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, এটাই ছিল রসুল (সা.) কর্তৃক কোন সাহাবীর হাতে তুলে দেওয়া প্রথম ঝা-া।
সংগ্রহে – আব্দুল কাদের; সদস্য, হেযবুত তওহীদ