শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার আত্মপ্রসাদ নিয়ে মুসলিমরা বসে আছেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যে শর্ত আল্লাহ আরোপ করেছেন সেটা হচ্ছে, তারা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করবে (সুরা ইমরান- ১১০)। তিনি মো’মেনদের সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছেন এই মর্মে যে, যারা ঈমান আনবে ও আমলে সালেহ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করবেন যেখানে ভীতির পরিবর্তে নিরাপত্তা থাকবে (সুরা নূর- ৫৫)। সুতরাং ইসলামের অর্থ হচ্ছে শান্তি, উদ্দেশ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্যে যা কিছু করা হবে সেগুলোই আমলে সালেহ।
এবাদতের অর্থ হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। যেমন আল্লাহ সূর্য সৃষ্টি করেছেন আলো তাপ দেওয়ার জন্য, সেটা দেওয়াই সূর্যের এবাদত। তেমনি আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। ধরুন আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়িতে আগুন লাগল। আপনি কী করবেন? দৌঁড়ে যাবেন সাহায্য করতে, নাকি প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন? যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি তা না করেন তাহলে যত তাহাজ্জুদই পড়েন সব পণ্ডশ্রম। কারণ আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য। ঐ কাজের জন্য যে আত্মিক, শারীরিক ও মানসিক চরিত্র দরকার তা অর্জনের প্রশিক্ষণ হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি। যদি আসল দায়িত্ব পালন না করে কেবল ব্যক্তিগত আমলের আনুষ্ঠানিকতাই করে যান তাহলে আল্লাহ তা গ্রহণই করবেন না। এ কারণেই বর্তমানে মুসলমান নামক জাতিটির কোনো আমলই আল্লাহ গ্রহণ করছেন না, বরং তারা সর্বত্র আল্লাহর অভিশাপের পাত্র। পৃথিবীময় মুসলিম জাতির এই দুর্দশার এটাই কারণ।
আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর ব্যক্তি কখনও মো’মেন-মুসলিম হতে পারে না। কারণ পবিত্র কোর’আনের (সুরা হুজরাতের- ১৫) নম্বর আয়াতে মু’মিন হবার শর্ত হিসেবে জীবন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করে দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং সমাজ তথা মানবজাতির শান্তির লক্ষে নিজেদের জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে প্রচেষ্টা না করলে কারও কোনো আমলই কবুল হবে না, তারা জান্নাতেও যেতে পারবে না। অন্যদিকে সমাজ হলো একদল মানুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যবস্থা যার অস্তিত্বের ভিত্তি হলো ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, পারস্পরিক সহযোগিতা, ত্যাগ, কোরবানি। এই গুণগুলো মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে গেলে সেটাকে আর মানবসমাজ বলা যায় না, তখনই মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। যে ব্যক্তি শুধু নিজের এবং নিজের পরিবারের চিন্তায় মগ্ন থাকে, দেশ-সমাজে যা হয় হোক, তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করে না, এমন স্বার্থপরের অধিকার থাকে না কোনো সমাজে বসবাস করার। মানুষকে বুঝতে হবে যে, সে আর দশটা প্রাণীর মতো সাধারণ সৃষ্টি নয়, সে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মৌলিক কয়েকটা তফাৎ রয়েছে-
(ক) মানুষের মধ্যে স্রষ্টার রূহ বা পরমাত্মার অংশ রয়েছে;
(খ) আল্লাহ নিজ হাতে মানুষ বানিয়েছেন। অন্য সকল সৃষ্টিকে তিনি কুন শব্দ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন,
(গ) মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি,
(ঘ) নিরন্তর মানুষের নানা প্রয়োজন মিটিয়ে যাওয়ার জন্যই সমস্ত সৃষ্টিকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
কাজেই এই মানুষ সৃষ্টির এক মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। সেই মানুষও যদি কেবল পশুর মতো খায়, ঘুমায়, বংশবিস্তার করে, যাবতীয় জৈবিক চাহিদা পুরণ করে আর একটা পর্যায়ে মরে যায় তাহলে তার মানবজীবন ব্যর্থ হয়ে গেল। প্রতিটি প্রাণী কেবল নিজের জন্য বাঁচে কিন্তু মানুষ বাঁচবে অন্যের জন্য। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই আমাদের জীবন তখনই সার্থক হবে যখন আমাদের দ্বারা মানবজাতির কোনো কল্যাণ হবে। সেটারই পুরস্কার আমরা হাশরের দিনে পাব ইনশাল্লাহ্।
আজ সমস্ত বিশ্ব যখন অন্যায় অশান্তি, যুদ্ধ, রক্তপাতে পূর্ণ তখন আমাদের সমাজ তথা প্রিয় জন্মভূমিকে যাবতীয় সন্ত্রাস, হানাহানি থেকে নিরাপদ রাখা আমাদের প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য।