দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫০টি বছর পেরিয়ে গেল। একটি জাতির জন্য ৫০ বছর অনেক বিরাট সময়। বিশেষ করে এই জ্ঞান বিজ্ঞান প্রগতির যুগে যেখানে আগে যে পথ পাড়ি দিতে ছয়মাস সময় লাগত সেই পথ এখন আধ ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া যায়। চিঠির মাধ্যমে মনের ভাব আদান প্রদান করতে ছয়মাস লাগত সেখানে চোখের পলকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ সময় অনেক সংক্ষিপ্ত। কাজেই এ যুগে এসে একটি জাতির জন্য ৫০ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এখন সময় হয়েছে আমাদের অতীত ইতিহাসকে মূল্যায়ন করার, কী লক্ষ্য ছিল আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের, কীসের আশায় লক্ষ লক্ষ বাঙালিদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, এত আবেগ অনুভূতি যে স্বাধীনতাকে ঘিরে তার কতটুকু অর্জিত হলো, যে অবিচার অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, সেই অবিচার অনাচার আজও রয়ে গেছে কিনা, মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ সেটা মানুষকে কতটুকু মুক্তি দিল, কী প্রতিবন্ধকতা আমাদের শান্তির অন্তরায় ছিল, সেই স্বাধীনতা কতটুকু সফল হলো, সেই মূল্যায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় আমরা পাড়ি দিয়েছি, এখন সেই মূল্যায়ন করতেই হবে।
সুলতানী যুগ
দীর্ঘদিন থেকে পাল বংশ, সেন বংশের রাজারা এ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। কোনো কোনো রাজার ব্যক্তিগত উদ্যমের কারণে কোনো কোনো নির্দিষ্ট এলাকা হয়তো উন্নতি করেছিল। কিন্তু অধিকাংশ এলাকায় মানুষ ছিল নিষ্পেষিত। কারণ রাজারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে নিপীড়ন করছিলেন আর ভোগবিলাসের জন্য চালাচ্ছিলেন শোষণ। নিপীড়িত জনতার পক্ষে সম্ভব ছিল না ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার। এদিকে আরবে আল্লাহর রসুলের আবির্ভাব হয়। তিনি সেখানে ঐশী পথনির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে সূচনা করেন এক দুর্বার জাগরণ, রেনেসাঁর। মানব ইতিহাসের পটভূমিতে নতুন একটি মহাশক্তির আবির্ভাব হলো, যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী। আটলান্টিকের তীর থেকে মরোক্কা পর্যন্ত সেই জাতিটি অনাবিল শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রগতির ঝড় সৃষ্টি করল। সেই ঢেউ আমাদের ভূখণ্ডেও আছড়ে পড়ল। যদিও ততদিনে ইসলামের প্রকৃত আদর্শ অনেকাংশেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের এখানে তুর্কি, ইরান, আফগানিস্তান থেকে ইসলামের চেতনার মশাল নিয়ে আগমন করলেন বহু বীর সেনানী। তারা অত্যাচারী রাজবংশগুলোর হাত থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিলেন, মানুষও তাদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলিঙ্গন করে নিল। তারা মুক্তি, সাম্য ও ন্যায়ের বাণী নিয়ে এসেছিলেন। তাদের সোনালী শাসনামলে টাকায় আটমন চাল, গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু ইত্যাদি কথা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু যেহেতু তারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার থেকে অনেকটাই বিচ্যুত ছিলেন, তাই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, হিংসা বিদ্বেষ, ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি বহুবিধ কারণে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো। এরই মধ্যে মোঘলদের আক্রমণে বাংলায় সুলতানী আমলের সমাপ্তি ঘটল।
টাঙ্গাইলের জমিদার পন্নী পরিবারের পূর্বপুরুষ তাজ খান পন্নী, সুলেমান খান পন্নী, বায়েজিদ খান পন্নী ও দাউদ খান পন্নী এই বাংলা বিহার উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ তথা গৌড় জনপদকে শাসন করতেন। দিল্লির বাদশাহ আকবর ইসলাম ত্যাগ করে দীনে এলাহী নামক নতুন ধর্মমত চালু করায় দাউদ খান পন্নী সেই প্রতাপান্বিত মোঘল বাদশাহকে বাৎসরিক কর দিতে অস্বীকার করেন এবং নিজের নামে মুদ্রা ও খোতবা প্রদানের ঘোষণা দেন। এভাবে তিনি এই বৃহত্তর বঙ্গকে স্বাধীন জনপদ হিসাবে ঘোষণা করেন এবং এ অঞ্চলের সকল রাজা ও জমিদারকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
মোঘল শাসন
সম্রাট আকবর বঙ্গের স্বাধীন সুলতান দাউদ খান পন্নীর বিরুদ্ধে সেনাভিযান প্রেরণ করেন। রাজমহল নামক স্থানে প্রচণ্ড রক্তক্ষীয় যুদ্ধ হয়, তাতে মোঘল বাহিনী বিজয়ী হয় এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন সুলতান দাউদ খান পন্নীসহ বহু বীর বাঙালি, পাঠান সৈন্য। এরপর থেকে বাংলা দিল্লির সুবেদারদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। এদিকে ভারতবর্ষে কালো থাবা বিস্তার করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ছলে বলে কৌশলে যেখানে যেভাবে দরকার তারা মোঘল শাসকদেরকে পরাভূত করে ধীরে ধীরে পুরো ভারতকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করে। তখন তারা ভারতবর্ষের যাবতীয় সম্পদকে শোষণ করে নিয়ে ব্রিটেনে জমা করতে থাকে। ভারতের হিন্দু আর মুসলিমদেরকে শাসন করার সুবিধার্থে ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি নিয়ে তারা এই দুই জাতির মধ্যে শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টি করল। তারা নিজেদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও দণ্ডবিধি এদেশের উপর চাপিয়ে দিল। তাদের শোষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ বিদ্রোহ করল বার বার। এই বিদ্রোহকে প্রশমিত করার জন্য ব্রিটিশরা কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ নামে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তৈরি করে দিল। পর পর দুটো বিশ্বযুদ্ধে সমাপ্ত হলো ঔপনিবেশিক যুগ। দুশো বছরে বহু প্রাণ, বহু রক্ত দিল মানুষ, বহু চাবুক পেটা আর জুতোর লাথি খেল। তারপর এক সময় লাহোর প্রস্তাবের দাবি মোতাবেক হিন্দু আর মুসলমানের জন্য দুটো আলাদা ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করা হলো – ভারত ও পাকিস্তান।
পাকিস্তান আমল
কথা ছিল পাকিস্তান শাষিত হবে ইসলামের নীতি মোতাবেক। কিন্তু কার্যত দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সেই উপনিবেশ যুগের বর্বর শাসনপ্রথাই চালাতে লাগল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নিল। ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো, বাংলাদেশ থেকেও লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি থেকে উৎখাত করা হলো। ইংরেজরা ভারতবাসীর মাতৃভাষার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে নি, কিন্তু পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বলে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। বাঙালি আবারো রক্ত দিল, ভাষার অধিকারের জন্য। অভাব, দারিদ্র, কষ্ট দূর হলো না, কারণ এখন বিলেতের বদলে পশ্চিম পাকিস্তানে দেশের সম্পদ পাচার হতে লাগল। ইসলাম দেবে বলে তারা নাম রেখেছিল ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কিন্তু মানুষ ইসলামের সেই সুবিচার, ন্যায়বিচার, ভ্রাতৃত্বের ছিটেফোটাও পায় নি। পেয়েছে ধর্মের নামে রাজনীতি আর প্রতারণা। অভিজাত কয়েকটি বুর্জোয়া পরিবারের হাতে ক্ষমতা আর অর্থের ছড়ি কুক্ষিগত হলো। শাসক শ্রেণি মানুষের মনের ভাষা বোঝার চেষ্টা করে নি। এরপর এলো একে একে ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র। সবশেষে বাঙালি জাতি এমন একজন নেতাকে খুঁজে পেল যার প্রতি তারা তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন উজাড় করে দিল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও পাকিস্তান সরকার তাঁকে ক্ষমতা হস্তান্তর করল না। উল্টো তারা ২৫ মার্চ কালো রাতে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে গণহত্যা চালালো, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর নয় মাস বাংলার স্বাধীনচেতা কৃষক, শ্রমিক, মজুর, তাঁতি, কামার, মাঝি, ছাত্র, শিক্ষক সবাই অস্ত্র হাতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করল। আমরা পেলাম একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিভক্তির রাজনীতি
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে গত ৫০ বছর আমাদের এই জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি একদিনের জন্যও ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয় নি। ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি একদিকে নানা ফেরকা মাজহাব আর অপরাজনীতি করে গেছে আর অপরদিকে পাশ্চাত্য থেকে ধার করা বিভিন্ন দাসত্বের মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে সারাবছর হামলা-পাল্টা হামলা, ভোটাভুটি নিয়ে রক্তারক্তি, হরতাল, অবরোধ চালিয়ে গেছে। ফলে স্বাধীনতার সুফল আমরা ভোগ করতে পারি নি, শান্তি আসে নি। সরকারগুলো বস্তুগত উন্নতির চেষ্টা করেছে, বিরোধীরা সরকাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে প্রতিবাদের নামে জাতির সম্পদ ধ্বংস করেছে। এই আধুনিক গতিশীলতার যুগে একটি জাতিকে পৃথিবীর বুকে সম্মানজনক আসন লাভ করতে ৫০ বছর কম সময় নয়। কিন্তু আজও আমরা দারির্দ্যের সাথেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, হাজার হাজার ডলার বৈদেশিক ঋণের বোঝা এ জাতির মাথার উপরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় এ দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, কিন্তু এখন আমরা সংখ্যায় ১৬ কোটি যাদের বিরাট একটি অংশ তরুণ, উদ্যমী, কর্মক্ষম এবং পরিশ্রমী। আমাদের মাটি অত্যন্ত উর্বর। আমাদের রয়েছে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ, রয়েছে নদী, সমুদ্রসীমা যা উন্নয়নের বড় নিয়ামক।
সব মিলিয়ে আমরা যদি নিজেরা স্বার্থ, ক্ষমতা, রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে হানাহানি না করে যাবতীয় সুস্পষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী একটি জাতিসত্তা গড়ে তুলতে পারতাম তাহলে এতদিন আমরা অর্থনৈতিক, সামরিক, শিক্ষা, প্রযুক্তি, কৃষি এক কথা সর্বদিক থেকে পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারতাম। সেখানে আমরা এখনও মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার জন্য কতই না চেষ্টা করছি। যাহোক, সময় ফুরিয়ে যায় নি। এখনও আমরা চাইলে অন্তর্কলহ ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, তাহলে চলমান বৈশ্বিক সংকট ও আঞ্চলিক সংকট থেকে নিজেদের দেশ ও জাতিকে নিরাপদ রাখতে পারব। নয়তো ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশগুলো যেভাবে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে আমাদেরকেও হয়তো তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।
এদিকে যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো জঙ্গিবাদী ইস্যু সৃষ্টি করে একে পৃষ্ঠপোষণ ও প্রণোদনা দিয়ে একটার পর একটা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে, মানুষের ঈমানকে ভুলখাতে প্রবাহিত করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে এমতাবস্থায় যদি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলের মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দ্বারা ঐক্যবদ্ধ করা না যায় তবে এই ভয়াবহ সংকট মোকাবেলা করা সহজ হবে না। সুতরাং এখন আমাদের ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বা গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আমাদের স্বাধীনতা সার্থক হবে, আমরা বিশ্বের বুকে একটি উন্নত শক্তিশালী জাতি হিসাবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারব।