রাকীব আল হাসান
২৬ মার্চ। বাঙালি জাতির জন্য এ এক গৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা দীর্ঘসময়ের পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে স্বাধীনতার সুধা পান করি। দীর্ঘদিনের শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন আর গোলামির হাত থেকে বাঁচার যে সম্ভাবনা সেদিন সৃষ্টি হয় তা নয় মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ আর ৩ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে অর্জিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে।
সুলতানি আমল পর্যন্ত এই বঙ্গভূমি স্বাধীন ছিল। টাঙ্গাইলের করটিয়ার ঐতিহ্যবাহী পন্নী (পূর্বে এই বংশের নাম ছিল কাররানি) পরিবারের উত্তরসূরি সুলতান দাউদ খান কাররানি ছিলেন বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে এই বঙ্গভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি জীবন দেন। সুলতান দাউন খান কাররানির আমলে স্বাধীন সুলতান হিসাবে তার নামেই খুতবা পাঠ করা হতো এবং তার নামেই মুদ্রা প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিক বিচারে এই দাউদ খান পন্নীই বাংলার ইতিহাসে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা ছিলেন। পন্নী রাজবংশের পরাজয়ের পর বারো ভূঁইয়াখ্যাত পন্নীদের অনুগত দৃঢ়চেতা কমান্ডার ও জমিদারগণ দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বীকার করে আঞ্চলিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও পরে অবশ্য তারাও মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে এই বঙ্গভূমি পরিচালনা করেছে মোঘল সম্রাটদের অধীনস্ত ও মোঘল সম্রাট কর্তৃক নিয়োগকৃত সুবেদার ও নবাবগণ (নায়েব)। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে নবাবী আমলের কার্যত পতন ঘটে এবং বাংলা চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। শুরু হয় অবর্ণনীয় শোষণ আর নির্যাতন। তাদের শোষণের ফলেই ছেয়াত্তরের মনন্তরে এ অঞ্চলের একতৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়, জীবিত মানুষ মৃত মানুষের গোস্ত ভক্ষণ করে। এভাবে চলে প্রায় দুইশ’ বছরের অত্যাচার আর শোষণের যুগ। পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চলকে শোষণ করে চরম দারিদ্রে নিমজ্জিত করে ১৯৪৭ সালে তারা এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবার সময় এ অঞ্চলের মানুষ যেন একদিনের জন্যও ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সেজন্য তারা বেশকিছু শয়তানী চক্রান্ত করে রেখে গেল, তার মধ্যে ভৌগোলিকভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অধীন করা, ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ অন্যতম। তারা বাংলাদেশকে স্বাধীনতা না দিয়ে পাকিস্তানের অধীন করে রেখে গেল ফলে ব্রিটিশ শাসনের মতোই শোষণ আর নির্যাতন চলতে থাকল। এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এমন বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিয়ে গেল যেন মুসলিম ও হিন্দুরা একে অপরকে শত্রু গণ্য করে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসাশিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে মনস্তাত্তি¡কভাবে দু’টি ভাগে ভাগ করে ফেলল। আবার মাদ্রাসাশিক্ষিতদের মাধ্যমে নানা মাজহাব-ফেরকার যে দ্ব›দ্ব আগে থেকেই ছিল তা আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেল। আর রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বহু দল-মতে যেন আমরা বিভক্ত থাকি তার ব্যবস্থাও করে দিয়ে গেল।
ঐক্য অনৈক্যের উপর জয়লাভ করবে এটি একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এটা যেমন কোনো পরিবারের জন্য সত্য তেমনি একটি জাতির জন্যও সত্য। একটি জাতির মানুষগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তারা যে কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। এর উদাহরণ ১৯৭১। ব্রিটিশদের বিদায়ের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকরা এ দেশের মানুষের উপর যে শোষণ, নির্যাতন চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে এদেশের কৃষক, তাঁতি, মুটে, ছাত্র শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণ সেদিন শান্তিময় দেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল। এই বিরাট অর্জন সম্ভব হয়েছিল কারণ এ জাতিটি তখন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ৪৭ বছরে সেই ঐক্য আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে ধরে রাখতে পারি নি। ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির ফতোয়াবাজি, অপরাজনীতি আর পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হাজারো ভাগে বিভক্ত ও হানাহানি, মারামারি, দলাদলি, হত্যা-রক্তপাতে নিমজ্জিত হয়ে গেছি। কিন্তু ৪৭ বছর যদি আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে থাকতাম, তবে আমরা নিঃসন্দেহে সর্বদিক দিয়ে পৃথিবীর একটি শীর্ষস্থানীয় জাতিতে পরিণত হতাম। সেই অতীতের ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে আজ যদি আমরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা এ জাতিটিকে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতিসত্তায় পরিণত করে স্বাধীনতাকে সার্থক করব, তাহলেও আমাদেরকে সেই প্রাকৃতিক নিয়মটি কাজে লাগাতে হবে-অর্থাৎ আমাদেরকে একাত্তরের ন্যায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ষোল কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
এ ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে প্রায়ই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক অস্থিরতায় গোটা দেশে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেসময় রাজনীতি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আহত, পঙ্গু, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, কেটে ফেলা হয়েছে হাজার হাজার গাছ, পোড়ানো হয়েছে বহু ঘর-বাড়ি, যান-বাহন। রেল ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় রাজনীতিতে আন্দোলনের নামে সহিংসতা সৃষ্টির যে ধারা আমাদের দেশে চালু আছে তার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই। তাই সাধারণ মানুষকেই সচেতন হতে হবে ভবিষ্যতে তাদের জীবনে যেন আর এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। একইসাথে দেশ ধ্বংসকারী একটি ইস্যু হলো জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হয়ে একটির পর একটি মুসলিম দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও গত কয়েক বছর থেকে জঙ্গি তৎপরতা যেভাবে বেড়ে গেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে দেশকে ধ্বংস করার জন্য দেশি-বিদেশি একটি মহল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। এখন এই অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে জনগণকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা, রাজনীতিক সহিংসতাসহ যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় যত বৃহৎই হোক তারা প্রকৃতপক্ষে হয় শক্তিহীন। জনগণের অনৈক্যের সুযোগ নিয়েই কতিপয় সুবিধাবাদী দু®কৃতকারী যুগের পর যুগ মানবসমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে যায়। কিন্তু আর নয়। ষোলো কোটি মানুষ যদি সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাহলে গুটিকয় দুষ্কৃকারী আর দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারবে না।
এখন আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে আমরা এমন একটি সমাজ পাব যেখানে কোনো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, হানাহানি থাকবে না, চুরি-ছিনতাই থাকবে না, কোনো দুর্নীতি, প্রতারণা থাকবে না, অন্যের অধিকার কেউ হরণ করবে না, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। দু’জন মানুষের ঐক্য যেমন পরিবারকে শান্তিময় করে, তেমনি ষোলো কোটি মানুষের ঐক্য সমাজ ও দেশকে শান্তিময় করবে।
আমাদেরকে অবশ্যই ন্যায়-সত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যায়, অসত্য, বিভক্তি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো যথা ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতির, পশ্চিমা সভ্যতার চাপিয়ে দেওয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে কারণ কোনো অন্যায়, অসভ্যতা, মিথ্যা মানুষকে শান্তি দিতে পারে না। আমরা সমস্ত মানবজাতি একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই পিতা-মাতা আদম হাওয়ার সন্তান। সুতরাং আমরা এক পরিবার, আমরা প্রত্যেকে ভাই-ভাই। তাই আমাদের মধ্যে ধর্মীয় বা রাজনীতিক কোনো বিভক্তি থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। বিভক্তি স্রষ্টার কাম্যও নয়। তাই সকল ধর্মেই আছে ঐক্যের শিক্ষা। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে ধর্মকেই বিভেদের প্রাচীরে রূপ দিয়েছে।
আজ আমরা ধর্ম বলতে বুঝি কিছু আনুষ্ঠানিক উপাসনা। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে মান বতা, সেটা আমরা ত্যাগ করেছি। কোনো বস্তুর মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার ধর্ম। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা। এশিয়ার একজন মানুষ আফ্রিকার অনাহারী মানুষটির কথা ভেবে দুঃখিত হবে, একটি বাড়িতে আগুন লাগলে সে আগুন নেভাবে, সে বিবেচনা করবে না ঐ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটি কোন ধর্মের। ফিলিস্তিনে একটি শিশু বোমার আঘাতে প্রাণ দিলে সমগ্র মানবজাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে, এটাই মনুষ্যত্বের ধর্ম। আর এ ধর্ম পালন করাই মানুষের প্রকৃত এবাদত। মানবজাতিকে অশান্তির মধ্যে ফেলে রেখে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার চার দেওয়ালের মধ্যে প্রার্থনায় মশগুল থাকলে স্রষ্টা আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন না, পরকালেও মুক্তি মিলবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি তারাই লাভ করেন যারা সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, ক্ষুধা, ক্রন্দন- এক কথায় অশান্তি দূর করার জন্য সংগ্রাম করে যান। নবী-রসুল-অবতারগণ ঐ লক্ষ্যেই সংগ্রাম করে গেছেন।
মুসলিম-সনাতন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন এ যামানার এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষকে তাদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষা ‘নিঃস্বার্থ মানব কল্যাণই ধর্ম’ এই মহাসত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান করেছেন। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এই সমাজে আমরা বড় হয়েছি, এ সমাজের প্রতি আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। আমাদেরকে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করতে হবে। যে শুধু নিজের স্বার্থে কাজ করে, মানুষের কল্যাণের জন্য একটি কুটাও নাড়তে চায় না, একটা টাকা খরচ করতে চায় না- সে তো মানুষ নয়, সে পশুরও অধম। মানবজাতির কল্যাণে নিজেদের জীবন ও সম্পদকে উৎসর্গ করতে পারার মধ্যেই নিহিত আছে মানবজন্মের সার্থকতা। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন নিঃস্বার্থভাবে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, আজ ৪৭ বছর পরে আবারও প্রয়োজন একটি শান্তিময়, ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিঃস্বার্থ আত্মনিয়োগের।
স্বাধীনতার এই মাসে বহু অনুষ্ঠান হবে, বহু সেমিনার হবে, নানা আয়োজনে পালন করা হবে স্বাধীনতা দিবস কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণার পর এই ঘোষণাকে বাস্তবায়নের জন্য যে নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগী ঐক্যবদ্ধ মানুষগুলো নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল তাদের জীবন থেকে আমরা কতটুকু শিক্ষা নিতে পারব সেটাই এখন প্রশ্ন। তাদের আত্মত্যাগকে কেবল দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আমরাও যদি তাদের মতো দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন উৎসর্গ করতে পারি তবেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। আসুন আমরা এই স্বাধীনতার মাসে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুনভাবে দেশ গড়ার শপথ নেই।