মোহাম্মদ আসাদ আলী
মানুষ কার্যত নিজের হাতে নিজের নিয়তি রচনা করে। তার আজকের সিদ্ধান্ত নির্মাণ করে তার ভবিষ্যৎ। সঠিক সিদ্ধান্তের ফলাফল শুভ হয় আর ত্রুটিযুক্ত সিদ্ধান্তের ফলাফল হয় অকল্যাণকর। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বা সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছেন। এই ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইহকালে সে যে সিদ্ধান্ত নেবে তার উপরেই অনুষ্ঠিত হবে তার হাশর। যার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই, যেমন পাগল, তাকে হাশরের দিন কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। অন্যদিকে পৃথিবীতে যার সিদ্ধান্তের মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি- যেমন রাজা, বাদশাহ, রাষ্ট্রনায়করা, তাদেরকে তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত কারণ দেখাতে হবে, সূক্ষ্ম জবাবদিহি করতে হবে, যে কারণে রাজা-বাদশাহ-সমাজপতিদের হাশর হবে অতি কঠিন ও সঙ্কটময়। কে জান্নাতে যাবে, কে জাহান্নামে যাবে তাও নির্ভর করছে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিপ্রসূত সিদ্ধান্তের উপর। পৃথিবীতে যারা সজ্ঞানে জেনে বুঝে সত্যকে ধারণ করেছে, সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছে এবং সেই সত্যকে যারা মাথা পেতে নিয়েছে তাদের মর্যাদা হবে অনন্য, তারা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করে জান্নাতে যাবে, অন্যদিকে যারা সজ্ঞানে জেনে বুঝে সত্যকে অস্বীকার করেছে, স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে অবাধ্য হয়েছে, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তাদের পরিণতি হবে জাহান্নাম। আসমান ও জমিনে জাহান্নামীদের চেয়ে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত আর কেউ হবে না।
প্রশ্ন আসতে পারে, স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যেহেতু মানুষের আছে, সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে মানুষ নিজের চলার পথ নিজেরা রচনা করতে পারতো। তবু আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন অর্থাৎ আল্লাহ নিজের সিদ্ধান্ত মানুষের উপর প্রয়োগ করেছেন, এটা কি মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে প্রশমিত করে না? উত্তর হচ্ছে- না। এতে মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বিন্দুমাত্রও প্রশমিত হয় না। কারণ-
প্রথমত, আল্লাহ কেন নবী-রসুলদের মাধ্যমে জীবনবিধান পাঠালেন সেটা বুঝতে হবে। শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে, অন্যায়-অবিচার, অশান্তি, রক্তপাতে নিমজ্জিত করবে- এটা শয়তানের চ্যালেঞ্জ (সুরা আরাফ, ১৬-১৭)। মানবজীবন শান্তিময় হওয়ার অর্থ শয়তানের পরাজয়, আর অশান্তিময় হবার অর্থ শয়তানের জয়। আল্লাহ চান মানুষ সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অনাচার, হানাহানি, রক্তপাত, অনৈক্য, সংঘাত, খুন-খারাবি থেকে মুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিতে বসবাস করুক। কিন্তু মানুষের শান্তি-অশান্তি নির্ভর করে তাদের জীবন-বিধানের উপর। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গেলে তাকে কোনো না কোনো জীবনবিধান অনুযায়ী চলতে হয়। সেই সামষ্টিক জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম নির্ভুল হলে মানুষ শান্তিতে থাকবে, আর সিস্টেম ভুল হলে অনিবার্যভাবে অশান্তিতে পতিত হবে। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের অন্তঃকরণ, তার সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা সব তার জানা। তিনি মানুষকে এতখানি সামর্থ্য দেন নি যাতে মানুষ একটি নির্ভুল জীবনব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। জীবনব্যবস্থা কেমন হবে তা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে একমাত্র আল্লাহর। তিনি যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে মানুষকে সেই নির্ভুল দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা প্রদান করে এসেছেন মানুষেরই স্বার্থে।
দ্বিতীয়ত, যুগে যুগে আল্লাহ যে দ্বীন পাঠিয়েছেন, ধর্মগ্রন্থ পাঠিয়েছেন সেগুলো মেনে নিতে কারও ওপর জোর-জবরদস্তি করা হয় নি। মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে স্রষ্টার পাঠানো জীবনব্যবস্থা মানবে, নাকি নিজেরা নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে। প্রত্যেক নবী-রসুল এসে মানুষকে তওহীদের আহ্বান করেছেন। তওহীদের দাবি হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই এ কথায় একমত হওয়া। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে- তওহীদের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে একটিমাত্র সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছেন যে, তারা কার হুকুম মানতে চায, তাদেরকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর, নাকি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের রাজা-বাদশা, সমাজপতি ও ধর্মব্যবসায়ীদের? বাকিটা নির্ভর করেছে মানুষ কী সিদ্ধান্ত দেয় তার উপর।
মানুষ যখন নিজেদের বিবেক, জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ দিয়ে বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্তে এসেছে যে, তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানতে চায়, তার মানে তারা সত্যকে স্বীকার করে নিল, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তওহীদ মেনে নিল। তারা হয়ে গেল মুসলিম। তারপর আল্লাহ তাদেরকে যে জীবন-বিধান বা কিতাব দিয়েছেন তা কেবল ওই তওহীদের চুক্তি মোতাবেক। চুক্তিটা কী?
ক. মানুষ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা বলে মানবে,
খ. আল্লাহ মানুষের শান্তিময় জীবন নিশ্চিত করবেন।
মানবজাতির ইতিহাসে একটিবারের জন্যও আল্লাহ এ চুক্তি ভঙ্গ করেন নি, বরং মানুষই বিভিন্ন সময় সচেতনভাবে এই চুক্তি ভঙ্গ করেছে, সার্বভৌমত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে, পরিণতিতে ভোগ করেছে ভয়াবহ অশান্তি। যখনই মানুষ এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষতির দিকে পা বাড়িয়েছে, অসীম করুণাময় আল্লাহ আবার তাদের মাঝে নতুন কোনো নবী পাঠিয়েছেন। তাদেরকে পুনরায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে তাদের কী মঙ্গল হবে তা যেমন জানিয়ে দিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে তার প্রাকৃতিক পরিণতির ভয়াবহতাও বর্ণনা করে শুনিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মানুষকে তার হুকুম মানতে বাধ্য করেন নি। যিনি সমগ্র সৃষ্টিজগত বানিয়েছেন কেবল ‘হও’ শব্দ করে, পৃথিবীর সকল মানুষ তাকে হুকুমদাতা হিসেবে মানার জন্য তার তেমন একটি আদেশই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তিনি তা করেন নি, কখনো করবেনও না, কারণ তাহলে মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা অর্থাৎ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে যেত। মানুষ আর হাতি-ঘোড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতো না।
আজ সমগ্র মানবজাতি যে সীমাহীন অশান্তি ভোগ করছে তার জন্য স্রষ্টা দায়ী নয়, শয়তানও দায়ী নয়, দায়ী মানুষ। মানুষ এ নিয়তি নিজ হাতে রচনা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানবজাতি সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তটি নেয় আজ থেকে ৪৭৫ বছর আগে। এই প্রথম মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের জাতীয় জীবন থেকে স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে সার্বভৌমত্বকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়। জন্ম হয় ধর্মনিরপেক্ষতার। তারপর শতাব্দীর পর শতাব্দী গত হয়েছে, শিল্প বিপ্লব হয়েছে, যান্ত্রিক উৎকর্ষতা আকাশ ছুঁয়েছে, সমগ্র পৃথিবীতে চলেছে ধর্মনিরপেক্ষতার জোয়ার, কিন্তু যতই দিন গেছে শান্তির পায়রা ততই দূরে সরে গেছে। সমস্ত রকম পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, দিন দিন মানুষ যান্ত্রিক উন্নতিতে যত উপরে উঠছে, আত্মিকভাবে সে তত নিচে নামছে। দেশে দেশে যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি, রক্তপাত, অন্যায়, অপরাধ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মানবতা হারিয়ে মানুষ স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক পশুতে পরিণত হয়েছে। তবে এখন সঙ্কট মানবতার নয়, এখন সবচেয়ে বড় সঙ্কট হয়ে দাড়িয়েছে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করা।
স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা তার চূড়ান্ত ধ্বংসযজ্ঞের সাইরেন বাজাতে শুরু করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো মাত্র আর একটি বিশ্বযুদ্ধ দরকার পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে মানুষের অস্তিত্বকে মুছে ফেলতে। কেমন হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? কতটা ভয়াবহ হবে তার বিভীষিকা? এসব চিন্তা করে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এখন দিশাহারা। আজ সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ নেই, সিদ্ধান্ত মানুষ কয়েক শতাব্দী আগেই নিয়েছে, আজ সময় কেবল পরিণতি ভোগের।