রাকীব আল হাসান :
আল্লাহর রসুল এবং প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী খেজুর পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির মসজিদ থেকে অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছেন, তাঁদের মসজিদসমূহ কোনোই জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। তবু যে ভূখণ্ডে এই জাতি শাসন করেছেন সেখান থেকে সমস্ত অন্যায় অবিচার, যুদ্ধ রক্তপাত, ক্ষুধা দারিদ্র্য, শোষণ এক কথায় সর্ব প্রকার অন্যায় অশান্তি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ বর্তমানে সারা দুনিয়াতে এমন বহু মসজিদ রয়েছে যার গম্বুজ সোনার তৈরি। মসজিদগুলির ভেতর, বাহির এতটাই জাঁকজমকপূর্ণ যে তা রাজপ্রসাদকেও হার মানায়। কিন্তু সমাজ অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ। আল্লাহর রসুল বর্তমানের এই সময়ের অবস্থাকেই বর্ণনা করে বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন- (১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, (২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, (৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, (৪) আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, (৫) তাদের তৈরি ফেতনা তাদের ওপর পতিত হবে। [আলী (রা:) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]
আল্লাহর রসুলের পবিত্র মুখনিঃসৃত এই বাণীটি আজ অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ একেকটা মসজিদ নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় তা দিয়ে হাজার হাজার নিরন্ন মানুষের আহার জুটতে পারে, দীন দরিদ্র্যের জীবনকে স্বচ্ছল করা যেতে পারে। আমাদের দেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের অলিতে গলিতে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদ। শুধু মসজিদ নয় মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ইত্যাদি ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিও যে বিপুল অর্থব্যয়ে তৈরি হয় তাও মসজিদগুলির মতোই। এই ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ, সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণসহ সেখানকার ধর্মগুরুদের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ সাধারণ মানুষ ব্যয় করে থাকে তা যে কোনো সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়িত অর্থের বহুগুণ। অথচ ঐ উপাসনালয়গুলিতে শুধুমাত্র উপাসনা ভিন্ন অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজও হয় না। দিনের বেশিরভাগ সময় সেগুলি তালাবদ্ধ থাকে।
তবে কি স্রষ্টা আমাদের কাছে শুধুই উপাসনার কাঙাল? স্রষ্টা কি শুধুই উপাসনালয়ের মধ্যে থাকেন? মানুষের সকল কল্যাণ কি শুধু উপাসনার মধ্যেই নিহিত? সকল ধর্মের উদ্দেশ্যই কি মানুষকে উপাসনায় ব্যস্ত রাখা?
না, ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণে। ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, মানবতার কল্যাণ করা। কিন্তু সকল ধর্মের মানুষই আজ মানবতার কল্যাণের পথ ছেড়ে শুধু উপাসনালয়ে পড়ে থাকাকেই ধর্ম জ্ঞান করছে, ইবাদত মনে করছে। যেহেতু আল্লাহ মানুষকে তার ইবাদত করা ভিন্ন অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন নি (সুরা যারিয়াত ৫৬) সেহেতু আমাদেরকে জানতে হবে ইবাদত কাকে বলে। নামাজ রোজা করা, পূজা-অর্চনা, জপমালা জপা, ধ্যানমগ্ন হয়ে সময় ব্যয় করা ইত্যাদি মানুষের প্রকৃত ইবাদত নয়। ইবাদত কথাটির অর্থ হচ্ছে যে জিনিসকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজ করা। একটি ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে সময় দেখানোর জন্য, এটা করাই তার ইবাদত। সূর্য সৃষ্টি করা হয়েছে আলো ও তাপ দেওয়ার জন্য, এটা করাই তার ইবাদত। মানুষকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা আগে জানতে হবে। কারণ সেটা করাই তার ইবাদত। মানুষকে কি মসজিদে, মন্দিরে, গীর্জা, প্যাগোডায় গিয়ে বসে থাকার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? না। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে সত্য, ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। পৃথিবী যখন অশান্তির জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে আছে, মানুষের মুখে ভাত নেই, উপাসনালয় থেকে জুতা পর্যন্ত চুরি হয়, যে সমাজে চার বছরের শিশু কন্যা পর্যন্ত ধর্ষিত হয়, পৃথিবীর মাটি মানুষের রক্তে ভিজে আছে, সেখানে এক শ্রেণির লোক মসজিদে গিয়ে যিকির আজকার করেন আর মনে করেন ইবাদত করছেন, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে মনে করেন যে উপাসনা হচ্ছে, মক্কায়-কাশিতে গিয়ে মনে করেন যে, তারা নিষ্পাপ হয়ে গেছেন। ধর্মগুরুদেরকে অর্থদান করে ভাবেন মহাপুণ্যের কাজ করছেন আসলে তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে আছেন। তাদের ইবাদত করা হচ্ছে না। মানুষের প্রকৃত ইবাদত হলো মানবতার কল্যাণে কাজ করা। আল্লাহ বলেছেন, “পূর্ব এবং পশ্চিমদিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, মালায়েকদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসুলগণের উপর ঈমান আনবে, আর আল্লাহরই প্রেমে স¤পদ ব্যয় করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও দাসমুক্তির জন্যে। আর যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা স¤পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই মুত্তাকী (সুরা বাকারা ১৭৭)।
সুতরাং মানুষ কী করলে শান্তিতে থাকবে, দরজা খুলে ঘুমাবে সেই লক্ষ্যে কাজ করাই হলো ইবাদত। এটা সকল ধর্মের মানুষের জন্যই কর্তব্য বা ইবাদত। এই অর্থে যারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে আছেন তারা যদি কোনো দুর্নীতি না করে ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে অবস্থান করেন, মানুষকে শান্তি দেওয়ার কাজ করেন তবে তারাই স্রষ্টার অধিক নিকটবর্তী হবেন। যারা মানবতার কল্যাণে এই কাজগুলি করবে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য, তাদের চরিত্র সৃষ্টি করার জন্য দরকার হলো নামাজ, রোজা, হজ্বসহ অন্যান্য ধর্মের উপাসনাগুলি। যেমন একটি বাড়িতে খুঁটি দেওয়া হয় ছাদকে ধরে রাখার জন্য। যদি ছাদই না দেওয়া হয়, তাহলে শুধু খুটি গেঁড়ে কোনো লাভ নেই। উপাসনাগুলি হচ্ছে এই খুঁটির মতো। তেমনি যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করবে না, তাদের জন্য এই উপাসনাগুলি কোনো কাজে আসবে না। এগুলো তাদেরকে স্বর্গে বা জান্নাতে, হ্যাভেনে নিতে পারবে না। আমাদেরকে বুঝতে হবে, স্রষ্টা শুধু মসজিদে মন্দিরে থাকেন না। তিনি হাদিসে কুদসীতে বলেছেন, ‘আমি ভগ্ন-প্রাণ ব্যক্তিদের সন্নিকটে অবস্থান করি।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘বিপদগ্রস্তদেরকে আমার আরশের নিকটবর্তী করে দাও। কারণ আমি তাদেরকে ভালোবাসি।’ (দায়লামী ও গাজ্জালী)।
রসুলাল্লাহ (সা.) সমগ্র জীবন ধরে যে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন তা কিসের জন্য? এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, দুঃখ, দারিদ্র্য, সকল প্রকার বিভেদ দূর করে ঐক্য, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যক্ষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং যাবার আগে এই শান্তি ও ঐক্য সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তার হাতে গড়া জাতিটির উপর। ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানেই শান্তি প্রতিষ্ঠা। গৌতম বুদ্ধ (আ.) বুদ্ধত্ব অর্থাৎ নবুয়ত লাভ করার পর শিষ্যদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “হে ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও মঙ্গলের জন্য এমন ধর্ম প্রচার করো, যে ধর্মের আদি, মধ্য এবং অন্তে কল্যাণ।” সুতরাং বোঝা গেল, ধ্যান করে দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ নয়, মানুষের সমষ্টিগত কল্যাণই ছিল বুদ্ধের (আ.) প্রচারিত ধর্মের প্রকৃত লক্ষ্য। একইভাবে ঈসা (আ.) ইহুদিদের প্রার্থনার দিন শনিবারে শরিয়াতের বিধান লঙ্ঘন করে অন্ধ, রুগ্ন, খঞ্জকে সুস্থ করে তুলেছেন। (নিউ টেস্টামেন্ট: মার্ক ৩, লুক ১৪)। সাবাথের দিনে তিনি কেন মানুষের এই কল্যাণগুলি করলেন, ধর্মজীবী রাব্বাই সাদ্দুসাইদের দৃষ্টিতে এটাই ছিল যীশুর মহাপাপ। তাই তারা তাঁকে ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষসহ রাষ্ট্রশক্তিকে উষ্কিয়ে দিয়ে তাঁকে একেবারে হত্যা করে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। এভাবেই সকল নবী ও রসুল তাদের জীবন ও কর্ম দিয়ে মানুষের কষ্ট দূর করাকেই ধর্ম বলে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। মানুষের শান্তিই সকল ধর্মের আত্মা। ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, ইসলাম শব্দের অর্থও শান্তি, আবার বৌদ্ধ ধর্মেরও মূল লক্ষ্য “সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্ত- জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক।” যে ধর্ম মানুষকে শান্তি দিতে পারে না, সেটা আত্মাহীন ধর্মের লাশ। প্রদীপের শিখা নিভে গেলে সেটা আর আলো দিতে পারে না, দিতে পারে শুধু কালি। তাই আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোর বিকৃত অনুসারীরা মানুষকে আলোকিত করার বদলে কালিমালিপ্ত করছে, শান্তির বদলে বিস্তার করছে সন্ত্রাস। তারা ভুলেই গেছে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
ধর্মকে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ইত্যাদিতে ঢুকিয়েছে স্বার্থান্বেষী একশ্রেণির ধর্মজীবীর দল। এই পরাশ্রয়ী ধর্মজীবী শ্রেণিটি সকল ধর্মেই বিদ্যমান। এরা ধর্মকে বানিয়েছে তাদের বাণিজ্যের মূলধন, পুঁজি। নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে করেছে বিকৃত। এদের সামনে যত অধর্মই হোক, যত অন্যায়, অবিচার হোক এরা কোনো প্রতিবাদ না করে মাথা নিচু করে মসজিদে, মন্দিরে, প্যাগোডায়, গীর্জায় গিয়ে ঢুকবে। এদের গায়ে যেন ফুলের টোকাও না পড়ে এ জন্য এরা উপাসনালয়ে ঢুকে নিরাপদ ইবাদতে মশগুল থাকে। মানবতার কল্যাণ, মানবজাতির শান্তি নিয়ে এদের কোনো চিন্তা নেই, যত বেশি মানুষ নামাজ পড়বে, যত বেশি মানুষ পূজা করবে ততই এদের লাভ। দানবাক্স ভর্তি হবে, তাদের সম্মান বৃদ্ধি পাবে। এজন্যই তারা নির্যাতিত মানুষের শান্তি-অশান্তির দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে মসজিদে, মন্দিরে, গীর্জায়, প্যগোডায় ঢুকেছেন। তারা ধর্মকে বাস্তবজীবন থেকে অপসারণ করে উপাসনা, পূজা-প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত করেছেন।
ধর্ম ছাড়া মানুষের মুক্তি নাই, কিন্তু আত্মাহীন ধর্মও মানুষকে মুক্তি দিতে অক্ষম। কাজেই এখন মানবতার কল্যাণের জন্য, মানবজাতির ঐক্যের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্মকে চার দেয়ালের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সোনার গম্বুজওয়ালা মসজিদ, জাঁকজমকপূর্ণ গীর্জা, প্যাগোডা, আলিশান মন্দির নির্মাণের চেয়ে মানবতার কল্যাণ করা এখন জরুরি। নিরন্নকে অন্নদান, নির্বসনকে বস্ত্রদান, অসহায়, দরিদ্রকে সাহায্য করা এবং সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি বন্ধ করাই এখন আসল ইবাদত।