রিয়াদুল হাসান
আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি মানুষ। সেই মানুষের মধ্যে দু’টি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সৃষ্টি হচ্ছে পুরুষ এবং নারী। তাদের উভয়কেই আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করলেও নারী ও পুরুষ হিসাবে তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পৃথক। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর জান্নাতের অঢেল সুখ ও শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করতে দিলেন। সেখানে তাঁর ছিল যেখানে খুশি যাওয়ার, যা খুশি খাওয়ার, যা খুশি করার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু এত কিছু পেয়েও আদম (আ:) এর হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এক অদ্ভূত শূন্যতার অনুভূতি। সব আছে তবু কি যেন নেই। জান্নাতের এত সুখ-সম্ভোগ ও রঙ-রূপ-রসও তাঁকে আনন্দ দিতে পারছে না, সব কিছু অর্থহীন, বিবর্ণ, নিরস মনে হয়। তখন আল্লাহ তাঁরই পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর সঙ্গিনী এবং সাহায্যকারী হাওয়াকে (বাইবেল- জেনেসিস ২:২২)। হাওয়াকে পেয়ে শান্তির সুধারসে আদমের হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন কিসের অভাবে তিনি এতকাল সব পেয়েও বিমর্ষ ছিলেন। এভাবে জান্নাতেই নির্ধারিত হয়ে গেল পুরুষ ও নারীর সৃষ্টিগত উদ্দেশ্য। আল্লাহর একটি হুকুম অমান্য করায় আল্লাহ তাঁদের উভয়কে শাস্তি-স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। শাস্তি হলো, পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে পরিবারের ভরণপোষণ করবে আর নারী গর্ভযাতনা সহ্য করবে, সন্তান লালন পালন করবে (বাইবেল- জেনেসিস ৩:১৬-১৭)। এভাবে তারা বেঁচে থাকবে কিন্তু তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য কিন্তু এটা নয়। আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে তাদের উভয়েরই জীবনের লক্ষ্য আল্লাহ ঠিক করে দিলেন তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কেবল পারিবারিক জীবনেই নয়, জীবনের সর্ব অঙ্গনের জন্য আল্লাহ নারীকে পুরুষের সঙ্গী এবং সাহায্যকারী হিসাবে নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি নারীকে সৃষ্টিই করেছেন রহমত, বরকত ও নেয়ামতে পূর্ণ করে। সে নিজেই এমন এক শান্তিময় সৃষ্টি যাকে ছাড়া জান্নাতও মানুষকে শান্তি দিতে পারে নি, পারবেও না। পৃথিবীর জীবনেও তাই নারী ছাড়া শান্তি কল্পনা করা যায় না। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ কর এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া।” (আর-রূম ৩০:২১) আর আল্লাহর রসুল বলেছেন, সমগ্র পৃথিবী আল্লাহর নেয়ামত আর সম্পদরাশিতে পূর্ণ এবং সেই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে মঙ্গলময় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ও নেয়ামত হচ্ছে সেই স্ত্রী যে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সদা সতর্ক (সহীহ মোসলেম, ২য় খণ্ড ৩৪৫৬)। এই হচ্ছে নারীকে আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টিগত মর্যাদা।
নারী কেবল তার স্বামীর জন্য শান্তির প্রতিমূর্তি নয়, জান্নাতকে যেভাবে সে শান্তিময় করে তুলেছে ঠিক সেভাবে মানবসমাজের প্রতিটি অঙ্গনে যেখানেই সে যাবে সেখানেই সে শান্তির সুবাস ছড়িয়ে দেবে। সে মা হিসাবে সন্তানের জন্য মমতার আশ্রয়, বোন হিসাবে ভাইয়ের জন্য আদরিনী আর স্নেহের আধার, স্ত্রী হিসাবে সে স্বামীর জন্য প্রেমময়, ঘরের কর্ত্রী, বার্ধক্যের অবলম্বন। কন্যা হিসাবে সে পিতা-মাতার জন্য নিরন্তর আনন্দের ফল্গুধারা। মানবসমাজের দেহ যদি পুরুষ হয় তবে নারী সে দেহের আত্মা বা প্রাণ। যে ঘরে, সমাবেশে, যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই, যে মসজিদে, সে সালাতে নারী নেই, যে হজ্বে নারী নাই সেটা প্রাণহীন ও অপূর্ণ। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে। সেই নারীদেরকে আজ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ভিতরে মনুষ্যত্ব আছে তার পক্ষে সম্ভব নয় একটি প্রস্ফুটিত গোলাপকে জুতার তলায় মাড়িয়ে যাওয়া, অথচ আজ অতুলনীয় সৌন্দর্য ও শান্তির উৎস যে নারী, সেই নারীকে আজ দাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। তাদের উপর নির্মম পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তাদের দেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, এসিড নিক্ষেপ করা হয়। এমন কি মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে তাদের উপর নির্যাতনও চালানো হয়। এই যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এর সূত্রপাত কোথায়?
আদমের (আ:) পর থেকে পৃথিবীতে যখন মানুষের বিস্তার হলো আল্লাহ তাদের শান্তিতে জীবনযাপনের জন্য নবী রসুলদের মাধ্যমে তাঁর বিধান পাঠাতে থাকলেন। সেই বিধানগুলি মানুষ যখন মেনে চোলত তাদের সমাজে অনাবিল শান্তি বিরাজ কোরত। কিন্তু নবীদের প্রস্থানের পর একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে প্রতিটি জাতির মধ্যে যারা ঐ বিধানের অর্থাৎ ধর্মের ধারক বাহক সেজে বসেছে। তারা নিজেদের পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর বিধানকে বিকৃত করে ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। ফলে ধর্মই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কল। সেই বিকৃত বিধানের ফলে সমাজের শান্তিময় পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। যেহেতু নারীরা চিরকালই পুরুষদের অধীন ছিল তাই স্বভাবতই তারা নিষ্ঠুরতার প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছে। যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম বিপন্ন হয় সেই পরিবেশের কোমলতর সৃষ্টিগুলি। শীতের আবির্ভাবে যেমন প্রকৃতি তার রঙ রূপ রস হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়, তেমনি সমাজে অমানবিকতা সৃষ্টি হলে কোমলতর সৃষ্টি হিসাবে নারী সর্বপ্রথম তার বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য্য হারায়। পুরুষ সমাজ যদি নারীকে রুজি রোজগারের জন্য কঠোর পরিশ্রমের কাজের দিকে, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার দিকে ঠেলে দেয় যা তার দেহ কাঠামো ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার চরিত্রে কোমলতার বদলে আসে পুরুষালী রুক্ষতা, তার কীন্নর কণ্ঠ হয়ে যায় কর্কশ। শান্তির প্রতীক নারীই আল্লাহর সার্বভৌমত্বহীন বস্তুবাদী ভারসাম্যহীন জীবন ব্যবস্থার প্রভাবে সাক্ষাৎ ডাইনীতে রূপান্তরিত হয়। ফুলের বাগান মরুভূমি হয়ে যায়। যার উদাহরণ আমাদের আজকের পৃথিবী। ‘আধুনিক’ পশ্চিমা সমাজের নারী পুরুষরা এখন মানুষের জীবন বাদ দিয়ে জীবজন্তুর মত ইন্দ্রিয়সম্ভোগের জীবন বেছে নিয়েছে। আমাদের এখানেও এখন সেটাকেই আধুনিকতা ও বন্ধনমুক্তির পথ বলে প্রচার করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদী খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র বস্তুবাদী জীবনের আকর্ষণ, সম-অধিকার, স্বাধীনতা জাতীয় প্রহেলিকামূলক মতবাদ, আর্থিক উৎকর্ষের পেছনে ছুটে ছুটে আমাদের নারী সমাজের বড় একটি অংশও তাদের সৃষ্টিগত আত্মিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছেন, তাদের সৌন্দর্য্য, করুণা, দয়া-মায়া, শিষ্টাচার, নম্রতা, লাজ-লজ্জা সবই প্রায় খুইয়েছেন। নিজেদের পরিবারে তারা একেকজন অশান্তির আকর। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, যে নারী তার পরিবারের জন্য অশান্তির কারণ, সেই নারী তার সমাজের জন্য কখনোই শান্তির কারণ হোতে পারে না। নারীর এই যে বিবর্ণতা এর পেছনে প্রাথমিকভাবে দায়ী কিন্তু পুরুষ সমাজই। যদি আপনি একটি মনোরম ফুলের বাগান তৈরি করেন, সেই বাগানের পরিচর্যা করার দায়িত্বও কিন্তু আপনার। আপনি যদি সেই বাগানে পানি না দেন গাছগুলি শুকিয়ে যাবে, ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে যাবে। এজন্য কি ফুলকে দায়ী করা যাবে? যে নারীকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন রহমত, বরকত ও শান্তির আধার হিসাবে সেই নারীকে তার উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করে তাকে সার্বিক সৌন্দর্য্যময় ও সুষমামণ্ডিত করে রাখার দায়িত্ব ছিল পুরুষের। কিন্তু পুরুষ তার এই দায়িত্ব পালনে প্রথম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে নারীও তার মর্যাদা, সৌন্দর্য্য, সম্মান হারিয়ে প্রায় ক্যাকটাসে পরিণত হয়েছে। ক্যাকটাসের ভিতরেও তবু কিছু পানি থাকে, কিন্তু দাজ্জালের তৈরি নারী প্রকৃতিতে যেন কেবলই শীতের শুষ্কতা আর গ্রীষ্মের খরতাপ।