আল্লাহর রসুল আইয়্যামে জাহেলিয়াতের জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থাকে অর্থাৎ দাসত্ব ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে একটা সেবাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি কেবল মুখেই মানবতা ও সাম্যের বাণী প্রচার করেন নি, সেটাকে বাস্তবায়ীত করে দেখিয়েছেন। তাঁর কথা আর কাজ এক ছিল। কখনও এমন হয় নি যা তিনি মুখে বলেছেন কিন্তু কাজে তা করেন নি বা অন্যটা করেছেন। তাঁর কথা আর কাজ ছিল সমাস্তরাল।আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেনদের সম্মান কত ঊর্ধ্বে হলে তিনি স্বয়ং তাঁর মালায়েকদেরকে নিয়ে মো’মেনদের উদ্দেশে সালাহ পেশ করেন বলে ঘোষণা করেন (সুরা আহযাব ৪৩)। তিনি এও বলেছেন, ‘সকল সম্মান, ক্ষমতা ও গৌরবের অধিকারী তো কেবল আল্লাহর, তাঁর রসুল ও মো’মেনগণ, কিন্তু মোনাফেকরা তা জানে না’ (সুরা মুনাফিকুন ৮)। আর মো’মেনদের সম্মান সম্পর্কে আল্লাহর রসুলের মূল্যায়ন আমরা বহু হাদিস ও ইতিহাস থেকে জানতে পারি। আব্দাল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, “একদিন আলস্নাহর রসুল কাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, লা এলাহা এলস্নালস্নাহ। তুমি অত্যন্ত পবিত্র এবং তোমার ঘ্রাণ অতি মিষ্ট। তুমি অতি সম্মানিত। তবে একজন মো’মেনের পদমর্যাদা ও সম্মান তোমার চেয়েও অধিক। আলস্নাহ একজন মো’মেন সম্পর্কে এমনকি মন্দ-ধারণা পোষণ করাকেও হারাম করেছেন (তাবারানি)
অপর বর্ণনায় আবদাল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, “আমি রসুলাল্লাহর একদিন কাবা তাওয়াফ করার সময় বলতে শুনেছি, ‘হে কাবা! কী বিরাট তোমার মহিমা আর কী মিষ্টি তোমার সুবাস। তুমি কত মহান আর তোমার পবিত্রতাও কত মহান! কিন্তু তাঁর শপথ যাঁর হাতে মোহাম্মদের প্রাণ, আল্লাহর দৃষ্টিতে একজন মো’মেনের পবিত্রতা তোমার পবিত্রতার চাইতেও অধিক (ইবনে মাজাহ)। আল্লাহর রসুল একদিন বহু নবী-রসুলের স্পর্শধন্য পবিত্র প্রস্তর হাজরে আসওয়াদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছিলেন, “হে কালো পাথর। কসম সেই আলস্নাহর যাঁর নিয়ন্ত্রণের অধীন আমার সকল অনুভূতি! একজন মো’মেনের সম্মান ও পদমর্যাদা (Rank) আল্লাহর কাছে তোমার সম্মান ও মর্যাদার চাইতেও অধিক মহিমান্বিত।” (ইবনে মাজাহ, আস-সুয়ূতি, আদ-দার আল মানসুর)।সুতরাং যে মো’মেনদের প্রতি আল্লাহর ও মালায়েকগণ সম্মিলিতভাবে সালাহ পেশ করেন, যাঁদের সম্মান কাবারও ঊর্ধ্বে তাঁদেরকে আল্লাহর রসুল বাস্তব কীভাবে সম্মানিত করেছেন সেটাই এখন দেখা যাক। যায়েদ (রা.) আর বেলাল (রা.) উভয়েই জাহেলি যুগে ক্রীতদাস ছিলেন তবে তাঁদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য ছিল।
তা হলো, যায়েদ (রা.) কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের হারিয়ে যাওয়া ছেলে। আর আবিসিনয়ার কৃষ্ণাঙ্গ বেলালের (রা.) উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতনের প্রধান কারণ তাঁর হীন সামাজিক অবস্থান। অভিজাত কোরায়েশ সমাজের কাম্য ছিল যে ক্রীতদাসরা সর্বদা বোবা পশুর মতো বিনা বাক্যে কেবল হুকুম তামিল করবে আর জুলুম সহ্য করবে। তাদেরও যে হৃদয় আছে এটা তারা মনেই করত না। বেলাল (রা.) যেমন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তেমনি আরো অনেকেই করেছিলেন কিন্তু তাঁর মতো ক্রীতদাসদের বেলায় কোরায়েশদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেকটা এমন যে, একজন ক্রীতদাস যে কিনা নরাধম জীব, সে কেন ধর্ম নিয়ে চিন্তা করবে, সে কেন নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে, তার তো এসব চিšত্মা করারই অধিকার নেই। একজন দাস হয়ে মক্কায় বাস করে কোরায়েশদের ধর্মকে অস্বীকার করবে এবং সামাজিক-রাজনীতিক ক্ষেত্রে তাদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে এই ইচ্ছা পোষণই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ধৃষ্টতা, তাঁর এহেন আচরণ প্রতাপশালী মালিক উমাইয়ার জন্য ছিল ভীষণ অবমাননাকর। এমন একটি সমাজে থেকেও বেলাল (রা.) নিজের পরিণতি জেনেও সত্যের জন্য জীবন কোরবান করে দিয়েছিলেন। মরুভূমির আগুনঝরা রোদে উত্তপ্ত বালু, কাঁটাগাছ ও জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
গলায় রশি বেঁধে ছাগলের মতো দুষ্ট ছেলেপেলেরা তাকে মক্কার অলিতে গলিতে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। তার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আবু জাহেল তাঁকে কখনো উপুড় করে, কখনো চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে পিঠের উপর বড় বড় পাথর রেখে দিত। মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রচন্ডখরতাপে তিনি যখন অস্থির হয়ে পড়তেন, আবু জাহেল বলত, “বেলাল, এখনো মোহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ র্ক।” কিন্তু তখনো তাঁর পবিত্র মুখ থেকে ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ অর্থাৎ তওহীদের ঘোষণা ধ্বনিত হতো।তাঁকে শান্তিদানের ব্যাপারে উমাইয়া ইবনে খালফ ছিল সর্বাধিক উৎসাহী। সে শান্তি ও যন্ত্রণার নিত্য নতুন কলাকৌশল প্রয়োগ করত। নানা রকম পদ্ধতিতে সে তাঁকে কষ্ট দিত। কখনো উটের কাঁচা চামড়ায় তাঁকে ভরে, কখনো লোহার বর্ম পরিয়ে উত্তপ্ত রোদে অভুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখতো। একদিন ‘বাতহা’ উপত্যকায় তাঁর বুকের উপর পাথর চাপিয়ে রাখা হয়েছিল, এমন সময় আবু বকর (রা.) তাঁকে পাঁচ উকিয়া রৌপ্যের বিনিময়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি মুসলিম উম্মাহর কর্মপ্রবাহে যোগ দিলেন। তিনি তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, আনুগত্য দ্বারা মুসলিম সমাজে একজন সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। তিনি যেমন রসুলাল্লাহ সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তেমনি আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) এর যুগেও তিনি খলিফাদ্বয়ের অনুরোধে তাঁদের সঙ্গী হিসাবে ছিলেন।
সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। আবু বকরের (রা.) কন্যার সঙ্গে রসুলাল্লাহর নিজে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। রসুলাল্লাহর যদি বেলালকে (রা.) ভালো না বাসতেন তাহলে পৃথিবীর কোনো মানুষই বেলালকে (রা.) ভালো বাসত কিনা সন্দেহ। হেজরতের পর আব্দালস্নাহ ইবনে আব্দুর রহমান খাসয়ামীর (রা.) সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাস্তায় সদাপ্রস্তুত আসহাবে সুফফার অন্তর্ভুক্ত। এই সাহাবিরা ছিলেন এতই দরিদ্র যা তাদের পোশাক ব্যবহারের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, আমি সত্তরজন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি, যাদের কারো কোনো চাদর ছিল না। কারো হয়তো একটি লুঙ্গি এবং কারো একটি কম্বল ছিল। তাঁরা এটাকে নিজেদের গলায় বেঁধে রাখতেন। কারোরটা হয়তো তার পায়ের গোছার অর্ধাংশ পর্যন্ত পৌঁছতো; কারোরটা হাঁটু পর্যন্ত। লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হওয়ার ভয়ে তারা হাত দিয়ে তা ধরে রাখতেন (বোখারি)।
বেলাল (রা.) প্রধান প্রধান সকল যুদ্ধেই অংশ নেন। বদর যুদ্ধে তিনি উমাইয়া ইবনে খালফকে হত্যা করেন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি রসুলাল্লাহর সঙ্গে কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করেন। বেশ কয়েকটি কারণে মানবজাতির ইতিহাসে এ দিনটির বিশেষ মাহাত্ম রয়েছে। মক্কা যে রসুলকে একদিন বের করে দিয়েছিল সে মক্কা এই ক্ষণে তাঁর পায়ের তলে। চতুর্দিকে মুসলিম সেনা কাফেরদের ঘেরাও করে আছে। আলস্নাহর রসুলের কৃপার উপরে আজ মক্কাবাসীর জীবন। তিনি আজ যাদেরকে জীবন ভিক্ষা দেবেন তারা বাঁচবে, যাদেরকে ঘরে থাকতে দেবেন তারা ঘরে থাকবে, যাদেরকে বাহিরে থাকতে দেবেন তারা বাহিরে থাকবে, রসুলালস্নাহ যাদেরকে আজ লোহিত সাগরে নিক্ষেপ করবেন তারা লোহিত সাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। আজকের দিনে মক্কা নগরীতে কারো সাধ্য নেই রসুলাল্লাহর কথাকে অমান্য করে। মক্কায় আজ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের নিরংকুশ বিজয়। আজকের এই দিন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত জনতার বিজয়ের দিন, অধর্মের বিরম্নদ্ধে ধর্মের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে আলোর বিজয়ের দিন। এ দিনেই রসুলাল্লাহর কোরায়েশদের ঘৃণিত ক্রীতদাস বেলাল (রা.)-কে দিয়ে “কাবার ঊর্ধ্বে মো’মেনের স্থান” এ কথাটিকে বাস্তব রূপ দান করেছিলেন। এ পর্যায়ে কাবার উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানাতে হচ্ছে।
আলস্নাহর ঘর বায়তুল্লাহর শরীফ সর্বপ্রথম আদম (আ.) নির্মাণ করেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করে থাকেন। পরবর্তীতে এটি ৫ থেকে ১২বার পুনঃনির্মিত হয়। নুহ (আ.) এর পল্লবনের সময় বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হলেও ভিত্তি আগের মতোই থেকে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তিভূমিতে এবরাহীম (আ.) তাঁর পুত্র এসমাইল (আ.) সহকারে তা পুনঃনির্মাণ করেন। কাবা শরীফ নির্মাণের সময় এবরাহীম (আ.) কেনান থেকে মক্কায় এসে বসবাস করেন। এরই ফলশ্রুতিতে মক্কায় বসতি গড়ে উঠে। অনেক ঐতিহাসিক এও মনে করেন যে, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আল্লাহর নির্দেশে মালায়েকরা কাবাঘর নির্মাণ করেন। কাবাঘরকে লক্ষ্য করে মহান আলস্নাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের মসজিদ হিসাবে নিরূপিত হয়েছে, তা ওই ঘর যা মক্কাতে অবস্থিত (সুরা আল-ইমরান ৯৬)। আদম (আ.) ও মা হাওয়ার পৃথিবীতে সাক্ষাৎ হলে তাঁরা উভয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং এবাদতের জন্য একটি মসজিদ আলস্নাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আলস্নাহ সে মতে আরশে অবস্থিত বায়তুল মামুরের আকৃতিতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন (শোয়াব-উল-ঈমান, হাদিসগ্রন্থ)।
এই কাবার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে ইয়ামেনের বাদশাহ আবরাহার হস্তি বাহিনীকে আলস্নাহ মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। যে কাবাকে মুসলিম উম্মাহর হৃৎপিন্ড বলা যায়, যা সমগ্র মানবজাতির ঐক্যের প্রতিক হিসাবে আলস্নাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যে কাবাকে সামনে রেখে কেয়ামত পর্যন্ত কোটি কোটি মো’মেন মুসলিম সাজদা করেছেন এবং করবেন সেই কাবার সম্মান কী বিরাট তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আল্লাহর রসুল দ্ব্যার্থহীনভাবে বললেন যে, একজন মো’মেনের সম্মান আলস্নাহর কাছে কাবারও ঊর্ধ্বে। কিন্তু কেন, কেমন করে একজন মো’মেনের সম্মান কাবারও ঊর্ধ্বে? এটা এক বিরাট প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে, মো’মেনই দুনিয়া থেকে অন্যায় অশান্তি অবিচার যুদ্ধ রক্তপাত দূর করে আলস্নাহর প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবনে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে আলস্নাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করে। পক্ষান্তরে কাবা একটি প্রতীকি গৃহ যা নিজের সম্মান রক্ষা করতেও সক্ষম নয়, এজন্য সে আল্লাহর এবং আলস্নাহর মো’মেন বান্দাদের উপর নির্ভরশীল। এজন্যই মো’মেনের সম্মান কাবার ঊর্ধ্বে। এব্রাহীম (আ.) এর পরবর্তীতে ৩৫০০ বছরে দীনে হানিফ ব্যাপকভাবে বিকৃত হয়েছে, কাবা প্রাঙ্গণে ৩৬০টি কাঠ পাথরের দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে, এমন কি এব্রাহীম (আ.) এর মূর্তি বানিয়ে সেটিরও পূজা করা হয়েছে, এই দীর্ঘ সময়ে পুরো আরব নোংরামি, পাপাচার, কদর্যতা আর অপবিত্রতায় লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
কাবা কিন্তু এ সময় আল্লাহকে জয়ী রাখতে পারে নি, এমনকি নিজের পবিত্রতাও রক্ষা করতে পারে নি। কারণ এটি সর্বোপরি জড়বস্তু, মর্যাদায় উচ্চ হলেও নিজে কিছু করতে অক্ষম। কিন্তু মহানবী ও তাঁর সঙ্গী মো’মেনরাই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে সেই ৩৬০টি উপাস্যমূর্তি অপসারণ করে কাবার পবিত্রতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই যার দ্বারা আল্লাহর এ বিজয় প্রাপ্ত হচ্ছে তার সম্মানই অধিক এ কথা বোঝার জন্য সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট। সুতরাং আল্লাহর কাছে তাঁর সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে মো’মেনের সম্মান ও পবিত্রতা সকলের ঊর্ধ্বে।কাবা বিজয়ের দিনে এরই স্বাক্ষর তিনি রাখলেন, মানবজাতির ইতিহাসের স্রোত উল্টো দিকে প্রবাহিত করে দিলেন। ইতিহাস বলে বেলালের (রা.) নাভির উপর থেকে কোনো কাপড় ছিল না, মাথায় পাগড়ির তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু লজ্জাস্থান ঢাকার মতো এক টুকরো কাপড় কোমরে প্যাঁচানো ছিলে। সেই অর্ধ উলঙ্গ বেলালকে (রা.) আলস্নাহর রসুল কাবার ছাদে উঠিয়ে দিলেন (আসহাবে রসুলের জীবনকথা-১ম খন্ড)। তারপর বেলাল (রা.) উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের আযান দিলেন। সেদিন বেলালের (রা.) পায়ের নিচে মহাপবিত্র বায়তুল্লাহ কাবা।
আল্লাহর রসুল প্রমাণ করে দিলেন যে মো’মেনের সম্মান কাবার ঊর্ধ্বে। একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে- আল্লাহর রসুলের সঙ্গে তো আরো দশ হাজার সাহাবি ছিলেন, তাদের মধ্যে কোরায়েশ সাহাবিরও অভাব ছিল না, তা সত্ত্বেও রসুলাল্লাহর বেলালকে (রা.) কেন কাবার উপরে ওঠালেন। প্রকৃতপক্ষে জাত্যাভিমানে অন্ধ কোরায়েশদের গালে এটি ছিল এক চপেটাঘাত। যে বেলালকে (রা.) তারা পশুরও অধম মনে করত, আজ সেই বেলাল (রা.) তাদের উদ্দেশে আযান গাইছেন। কথিত আছে, রসুলাল্লাহর পিতামহ আব্দুল মোত্তালেব যিনি ছিলেন এই কাবার সেবায়েত, তিনি তার দীর্ঘ শুভ্র শশ্রুরাশি দিয়ে কাবার ধূলা পরিষ্কার করতেন। এভাবেই কোরায়েশরা কাবাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করত। সেই কাবার উপরে যাকে তারা কিছুদিন আগেও মানুষ হিসাবে গণ্য করত না, আল্লাহর রসুল তাঁকে কাবার ঊর্ধ্বে উঠিকে মানুষের সম্মান, মো’মেনের সম্মান প্রতিষ্ঠা করলেন। মানুষের প্রকৃত সম্মান অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই কবি নজরুল লিখতে পেরেছিলেন,
মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; – গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোনো।
জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।
এ ঘটনা প্রমাণ যে সকল ধর্মগ্রন্থ, কাবাসমেত সকল উপাসনালয় মানুষের কল্যাণের জন্য এসেছে, মানবতার জন্যে এসেছে। তাদের কারো সম্মান মো’মেনের ঊর্ধ্বে নয়। এ ঘটনার দ্বারা আলস্নাহর রসুল কোরায়েশদের অহংকার, আরব জাতীয়তাবাদীদের অহংকার মরুভূমির বালুতে মিশিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই জাহেলিয়াত রসুলাল্লাহর থাকতেই বার বার কোরায়েশদের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে, রসুলাল্লাহর ও প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর বিদায়ের পর কোরায়েশদের বংশীয় আভিজাত্যের গরিমা আবার ফিরে এসে ইসলামকে কলঙ্কিত করেছে। এটা মহাসত্য যে, আরবি জোব্বা পরে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের আদলে আরবি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর যেমন তাঁর নবীকে পাঠান নি, তেমনি নবীও আরবি সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য উম্মতে মোহাম্মদী জাতি গড়ে যান নি। অথচ এটাই মুসলিম জাতির পরবর্তী দুঃখজনক ইতিহাস। আজও সেই আরবরাই আল্লাহর-রসুলের নাম আর ইসলামকে বিক্রি করে খাচ্ছে, তারা পশ্চিমা সভ্যতা তথা দাজ্জালের সঙ্গে আঁতাত করে মুসলিম নামক এই জাতিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
আরব রাজা-বাদশাহদের অর্থে পরিচালিত যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মুসলিম দাবিদারকে হত্যা করা হচ্ছে। আর আভিজাত্যের পূজারি আরব রাজা বাদশাহরা কাবার মোতয়ালিল্লা সেজে প্রতিবছর কাবার গেলাফ পরিবর্তনের অনুষ্ঠান করছে। আল্লাহর কাবাকে পোশাক পরাতে বলেন নি। এটা করুন উপহাস যে, জজিরাতুল আরবের বহু দেশেই যখন অন্ন-বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন মুসলিমদের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে, তাদেরকে আবাসন, খাদ্য-বস্ত্র না দিয়ে, জীবনের নিরাপত্তা না দিয়ে, তাদের মাতৃভূমি ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট না হয়ে তারা সাড়ম্বরে কাবা শরীফকে পোশাক পরিধান করায়। কারণ কাবা গৃহ, হজ্ব, ওমরাহ ইত্যাদি তাদের জাতীয় ধর্মব্যবসার উপকরণ। তারা গরীব দেশগুলো থেকে দাস-দাসী খরিদ করে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে, সর্বপ্রকার মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখছে, গৃহকর্মীদের উপর যৌন নির্যাতন পর্যন্ত করছে। এই অসভ্যরা আমাদের দেশের মানুষদেরকে বলে মিসকিন। তারা ভুলে গেছে যে, আল্লাহর রসুল ক্রীতদাস বেলালকে (রা.) কাবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন।ইসলাম গ্রহণকারী সকল ক্রীতদাসকেই আল্লাহর রসুল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, স্বাধীন মানুষের সমমর্যাদা দান করেছিলেন, মুসলিম উম্মাহর ভাই বানিয়ে সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এর থেকে ন্যায়বিচার, এর থেকে সাম্যবাদ, এর থেকে মানবতা পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ দেখাতে পারে নি।