হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
অন্যায়ের দুর্গ যতই মজবুত হোক সত্যের আঘাতে তার পতন অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) কে দিয়ে মহাশক্তিধর বাদশাহ নমরুদের জুলুমবাজির শাসনব্যবস্থার পতন ঘটালেন। সেটা ছিল প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতা যার নিদর্শন আজও হারিয়ে যায়নি। তৎকালে সেটাই ছিল বিশ্বের শীর্ষ সভ্যতা। তারা অহঙ্কারে এতটাই স্ফীত হয়েছিল যে উঁচু মিনার তৈরি করে তারা আল্লাহর আরশ দেখতে চাইত। তারা ঝুলন্ত উদ্যান নির্মাণ করেছিল। কিন্তু যখনই সেখানে মানবতা ভুলুণ্ঠিত হয়েছে তখনই তা অর্ধম হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে। তখন মহান আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) কে পাঠালেন পুরাতন জীর্ণ পরম্পরার জাহেলিয়াতের বিনাশ সাধন করে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য। তিনি সেটা করলেন। আল্লাহ তাঁকে মিল্লাতের পিতা বলে অভিহিত করলেন (সুরা ইব্রাহিম ৭৮)। তিনি আল্লাহর তওহীদের শিক্ষা দান করলেন তাঁর পুত্রগণকে। পুত্র ইসমাইল (আ.) কে নিয়ে তিনি মিল্লাতের ঐক্যের কেন্দ্র হিসাবে কাবাগৃহ পুনর্ণিমাণ করলেন। প্রবর্তন করলেন হজ্বের। সমস্ত শেরক কুফরের মূলোৎপাটন করলেন তিনি। বললেন, আমি আমার পূর্ণ মনোযোগ একনিষ্ঠভাবে (হানিফ) তাঁরই দিকে নিবদ্ধ করেছি, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মোশরেকদের অন্তর্ভুক্ত নই (সুরা আন’আম ৮০)।
কিন্তু তাঁর সাড়ে তিন হাজার পর এসে সেই তওহীদভিত্তিক দীন আবারও শেরক ও কুফরে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গেল। যেই মূর্তি ভাঙার দরুন ইব্রাহিম (আ.) কে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল আবারও বনি ইসমাইল কাবা প্রাঙ্গণে ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপন করল। তারা ধর্মের নামে অধর্ম আর ধর্মান্ধতার চর্চা শুরু করল। উলঙ্গ হয়ে মানুষকে হজ্ব করতে বাধ্য করা হলো। ধর্মের নামে হাজার রকমের বিধিনিষেধ আরোপ করল ধর্মব্যবসায়ী আবু জাহেলরা। মানুষ যখন অন্ধত্বে ডুবে গেল তখন ন্যায় অন্যায়ের আর কোনো পার্থক্য থাকল না। সভ্যতা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা থেকে তারা ছিটকে গেল। ওদিকে গড়ে উঠল রোমান সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা। কিন্তু আরবরা সেদিকে গেল না, তারা পরিচিত হলো মারামারি আর কামড়া-কামড়িতে ব্যাপৃত একটি বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠী হিসেবে। তাদের যুগের নাম দেওয়া হলো আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগ। যে জাহেলিয়াতকে ইব্রাহীম (আ.) দূর করেছিলেন সেই জাহেলিয়াত যখন আবার পুনর্বাসিত হলো আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে পাঠালেন। সেই জাহেলিয়াতকে নির্মূল করার জন্য তাঁকে সকল অজ্ঞতার মস্তকে প্রচ- বেগে আঘাত করতে হয়েছে।
তিনি বাল্যকাল থেকেই সমাজ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। যুক্তির বাইরে তিনি কোনো কিছু ভাবতে পারতেন না। চিন্তা না করে কিছু বলতেন না। তাঁর উপর প্রথম যে আয়াতটি নাজেল হলো সেটা হচ্ছে – ইক্বরা অর্থাৎ পড়। তিনি বললেন, ‘আমি তো পড়তে পারি না’। তিনবার তাঁকে পড়তে বলা হলো, তিনি প্রতিবার বললেন, ‘আমি তো পড়তে পারি না’ (আয়েশা রা. থেকে বোখারি)। কিন্তু তাকে ছাড় দেওয়া হলো না, তাঁকে পড়ার জ্ঞান দান করলেন আল্লাহ। সেই হেরাগুহার পাদদেশ থেকে নতুন ইতিহাসের সূচনা হলো। মানুষ জানি না বললে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে না। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলছেন, “আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে। (সুরা বনি ইসরাইল ৩৬)।
সাফা পর্বতের পাদদেশে যেদিন তিনি প্রথম প্রকাশ্যে তওহীদের আহ্বান জানালেন সেদিনই শুরু হলো পাথর নিক্ষেপ। বর্ষিত হলো গালি। তিনি সত্যের মশাল নিয়ে এগিয়ে চললেন। বজ্রনিনাদে ঘোষণা করলেন – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। তখন ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি ঐ সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। শোষণ করছে জোঁকের মতো। গোত্রপতিরা শাসন করছে নিজেদের মর্জিমত। রসুলাল্লাহর চাচা আবু তালিবের কাছে প্রস্তাব দেয়া হলো তাকে থামানোর জন্য। এজন্য তাকে সম্পদ, ক্ষমতা, নারী সবকিছুর লোভই দেখানো হলো। কিন্তু তিনি কোনো প্রলোভনে দুর্বল হলেন না, আত্মসমর্পণ করলেন না। পাহাড়ের মতো অটলভাবে বললেন, “যদি আমার এক হাতে চাঁদ, আরেক হাতে সূর্যও তুলে দাও, তবু আমি আমার এ পথ পরিত্যাগ করব না। এতে হয় আল্লাহ আমাকে বিজয়ী করবেন, নয়তো মোহাম্মদ (সা.) ধ্বংস হয়ে যাবে।” (সিরাতে রসুলুল্লাহ সা.- ইবনে ইসহাক)।
পরিশেষে আল্লাহর বিজয় হলো, মানবতার বিজয় হলো। আল্লাহর বিজয় কীসে? মানবতার বিজয়ের মধ্যেই আল্লাহর বিজয়। আল্লাহর রসুল এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন যেখানে এমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলো – একজন নারী একা শত শত মাইল পথ দিনে রাতে হেঁটে যেতে পারতেন। তখন একা একটা মেয়ে রাতের বেলায় হেটে যেতে পারতেন। যে বেলালদের মানবেতর জীব বলে গণ্য করা হতো, হাটে বাজারে বিক্রি করা হতো, সেই বেলালকে(রা:) তিনি কাবার উপরে ওঠিয়ে আল্লাহর বিজয়ের ঘোষণা প্রচার করলেন। ধর্মব্যবসা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। ক্রমান্বয়ে বিক্ষুব্ধ বঞ্চিত অবদমিত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। ঐশী নেতৃত্ব পেয়ে গেল আল্লাহর পক্ষ থেকে। একটি রেনেসাঁর সৃষ্টি হলো। একটি মহাজাগরণ বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল। সেই রেনেসাঁর প্রথম আঘাতে শেরক আর কুফরের মস্তক মরুর বালুতে লুটিয়ে পড়ল। মূর্তির নামে চলা হুকুমত ধ্বংস হয়ে গেল। আরবের মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধ হলো। যারা অপরিচ্ছন্ন থাকত তারা পাঁচ ওয়াক্ত ওজু করতে শিখল। যারা বিশৃঙ্খল ছিল তারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে সালাহ কায়েম (নামাজ) করতে শিখল। বিবদমান মানুষগুলো ভাই ভাই হয়ে গেল। যারা ছিল চিন্তাহীন, কাঠ পাথরের মূর্তির সামনে মাথা নোয়ানোর জাতি, তারা চিন্তায় ও কর্মে, বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে, আবিষ্কারে ও গবেষণায়, ধনে ও শক্তিতে বিশ্বের সকল জাতির শীর্ষে চলে গেল। তাদের সমাজ থেকে সকল অন্যায় দূরীভূত হয়ে গেল। সেই রেনেসাঁর ঢেউ আছড়ে পড়ল বাকি দুনিয়ায়। গোটা মানবজাতিই সমৃদ্ধ হয়ে উঠল ইসলামের উদ্বোধনে (সুবাহানাল্লাহ)।
কিন্তু সব সভ্যতার ধারকদেরই পদস্খলন হয়। রসুলাল্লাহর সামনে বসে যে সাহাবিরা ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছিলেন, সেই সাহাবিরা যখন একে একে ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদায় নিলেন, তখন প্রকৃত ইসলামের আকিদা বিকৃত হতে শুরু করল। রসুলাল্লাহর বিদায়ের ৬০/৭০ বছর পর জাতি তার লক্ষ্য ভুলে গেল। জাতির নেতৃত্ব উম্মতে মোহাম্মদীর নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলো। তাদের উপর দায়িত্ব ছিল সমগ্র পৃথিবীকে এই শান্তি-সুখের আওতায় নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। তারা সেই সংগ্রাম ত্যাগ করল। ফলে জাতি শক্তি হারিয়ে ফেলল। তারা অন্তর্কলহে খ- বিখ- হয়ে গেল। ওদিকে শত্রুরা হয়ে উঠল শক্তিশালী, সুযোগসন্ধানী ও প্রতিশোধ-পরায়ণ। তারা হামলা চালাতে লাগল একটার পর একটা। তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে মুসলিম জাতি ইউরোপীয় জাতিগুলোর দাসে পরিণত হলো।
দুইশ বছর দাসত্বের পর এ জাতি আবারও মূর্খের জাতিতে পরিণত হলো। আবারও তারা ধর্মান্ধ হলো। তাদের কাছে কোন পীর কী বলল, কোন দরবেশ কী বলল, কোন মৌলভি কী বলল সেটাই ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার তাদের কাছে মানবতার চেয়ে মাসলা-মাসায়েল বড় হয়ে দাঁড়ালো। মানুষ নিষ্পেষিত হতে লাগল ধর্মের যাঁতাকলে। তিন কোটি ভারতবাসী রাস্তাঘাটে না খেয়ে মারা গেল। এভাবেই দিন যাচ্ছে। ইজ্জত হারাচ্ছে নারীরা, অগ্নি সংযোগে প্রাণ হারাচ্ছে নুসরাতরা। একটি বৃক্ষ যখন অতি বৃদ্ধ হয় তখন তার পতন হয়। এই সভ্যতারও পতনের সময় এসে গেছে। এখন তাকে মরতে হবে। এই মৃত্যুর প্রাক্কালে নতুন সভ্যতার বীজ আল্লাহ ধরাপৃষ্ঠে রোপণ করেছেন। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন রেনেসাঁ।
সুখবর এই যে, আজ দিকে দিকে সেই নতুন রেনেসাঁর ঢেউ লেগেছে। আবারো লাখো কণ্ঠে মানুষ বলছে, এই অন্ধত্বের দেওয়াল ভাঙতে হবে। এই কূপম-ূকতার চর্চা, ধর্মের এই অপব্যবহার আমরা আর চাই না। আমরা চাই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও যুক্তি-বুদ্ধি, জ্ঞান ও মানবতার প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ যা বলেছেন রসুল যা করেছেন, সেটাই হবে ইসলাম। এখানে আর কারো খবরদারি চলবে না। আমরা ধর্মব্যবসায়ীদের দেখেছি, তাদের কথা শুনেছি। তোমরা এখন আর আল্লাহর খেলাফত করছ না। তোমরা শয়তানের খেলাফত করছ। তোমরা ধর্মকে স্বার্থের কল বানিয়ে নিয়েছ। তোমরা যা বলো মিথ্যা বলো। তোমাদের ধবধবে লেবাসের অন্তরালে যে কুৎসিত চেহারা লুকায়িত আছে, আমরা তা দেখেছি। আমরা আর তোমাদের মানব না। আমরা সবাই বলব, আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নাই – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ (সা.)। আল্লাহর হক সত্য, তার হুমুকও হক সত্য। কিন্তু তোমরা সত্য নও। আমরা তোমাদের প্রত্যাখ্যান করলাম। এখন সত্যকে ধারণ করে আমরা হবো মো‘মেন, আমরা হবো উম্মতে মোহাম্মদী।
[লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ, ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ফেসবুক পেইজ: facebook.com/emamht]