– শ্রী ডাঃ মঙ্গল চন্দ্র চন্দ দে
সাবেক সচিব, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট
ধর্ম কেবলই কোনো তত্ত্ব নয়, ধর্ম হচ্ছে অনুশীলনের বিষয়, পালনের বিষয়। স্রষ্টা যেমন কেবল একজন, ধর্মও কিন্তু একটি। আলাদা সম্প্রদায় হলেও সব মানুষের কিন্তু একই ধর্ম। তথাপি সাম্প্রদায়িক সংঘাতে, মানুষে মানুষে লড়াইয়ে পৃথিবীর পবিত্র মাটি বারবার রক্তাক্ত হয়েছে, মানুষের হিংস্রতার কারণে, আসুরিক আর দানবিক শক্তির উৎপাতের কারণে মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে, অনাহারে, দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে মানুষ কালাতিপাত করেছে। আমরা দেখেছি কী নৃশংসতা, বিভৎসতা! আমাদের ভিতরে যে হিংস্রতা আছে, আমাদের ভেতরে যে আসুরিক ও দানবীয় শক্তি আছে সেগুলো আমাদের মুছে দিতে হবে। আমাদের ভেতরে যে মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধের চেতনা আছে তা জাগ্রত করতে হবে। এই পৃথিবী মহামানবদের পদস্পর্শে পবিত্র, আলোড়িত, সুশোভিত। যুগে যুগে যে অবতার, পয়গম্বররা এসেছেন তারা একটা বার্তাই নিয়ে এসেছেন। সেটা হলো মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ। সেই মানবতাবোধ আমাদের মাঝে আবার জাগ্রত করতে হবে।
কবি বলেছেন, ‘নানান বরণ গাভীর ভাই/একই বরণ দুধ, জগৎ ঘুড়িয়া দেখলাম একই মায়ের সূত’। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘যারা সত্যাশ্রয়ী, যারা সত্যের সন্ধানী তারাই সনাতন ধর্মাবলম্বী।’ সনাতন ধর্মের মূল বক্তব্য কী? আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যাবে যার রক্ত সাদা বা কালো? সকল মানুষের রক্তই লাল। অথচ সব মানুষের রক্ত লাল হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীতে মানুষে মানুষে এই সংঘাত কেন? তবু কেন পৃথিবীর মানুষ নিপীড়িত হয়? তবু কেন মানুষের রক্তে হাত রঞ্জিত হয়? আর এই পৃথিবীতে যত সংঘাত হয়েছে তা হয়েছে মূলত তিনটি কারণে, সম্প্রদায়, বর্ণ আর ভাষা। কালো আর ধলোর দ্বন্দ্ব, ভাষার দ্বন্দ্ব, আর বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
আমাদের ভিতরে মহান সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সময় যে জ্ঞান দিয়েছিলেন সেই জ্ঞান তিনি কী কাজে ব্যবহার করতে বলেছেন? মানুষ যে আশরাফুল মাখলুকাত, সেরা জীব, সেই সেরা জীব হয়ে মানুষকে ভালোবাসার জন্য, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে তোলার জন্য তিনি মানুষকে সেই জ্ঞান দিয়েছেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ কবি নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক মানুষেতেই সুরাসুর।’ অথচ মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, সংঘাত আছে, শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব, বৌদ্ধ-খ্রিস্টিানের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের কারণে মানুষ যে সবার উপরে সত্য সেই কথা তারা ভুলে যায়। সকল মানুষ যে ভাই-ভাই এই মহাসত্য আমরা ভুলতে বসেছি। মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্বের যে প্রাচীর সেই প্রাচীরটা কিন্তু আমরা ভাঙতে পারি নি। সকল ধর্মেল মর্মকথা যে মানবতা, সেই মানবতা আমরা সবাই যদি নিজের মনের ভিতর ধারণ করতে পারি, তাহলে আমার মুখ থেকে আর মিথ্যা কথা বের হবে না। আমার মুখ থেকে অসত্য কথা বের হবে না। আমি মানুষকে ভালোবাসব আমার মধ্যে যে মনুষ্যত্ববোধ বিরাজ করছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিব। আমি পবিত্র মন্দিরে গিয়ে আরাধনা করলাম কিন্তু পরবর্তীতে সেই মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে আমি কোর্টে যেয়ে পরের দিন মিথ্যা সাক্ষী দিলাম। মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় গিয়ে আমি যে আরাধনা করলাম। আমি মহান স্রষ্টার নিকট ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। কিন্তু আমি মানুষের সেবায় নিয়োজিত হতে পারলাম না। সেই মন্দির, সেই মসজিদ, সেই গীর্জার কোনো সার্থকতা নেই। ভিন্ন সম্প্রদায়ের বলে আমরা যাদের ঘৃণা করি, যাদের পাপী বলি, তারাও কিন্তু মানুুষ। তাদেরও কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ আছে। পাপকে ঘৃণা করো, কিন্তু পাপীকে নয়। মানুষ মানে যার মান আছে, হুঁশ আছে, চেতনা আছে, বিবেক আছে, জ্ঞান আছে। সেই মানুষদের নিয়ে আমরা সৃষ্টি করতে চাই বিবেকধর্মী একটি সমাজ। সেই সমাজ সেই রাষ্ট্র হবে এমন যেখানে কোনো মারামারি, কাটাকাটি, দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ, হানাহানি থাকবে না, যেখানে নারী-পুরুষের বিভেদ থাকবে না। স্বামী-স্ত্রী মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে না, সাম্প্রাদায়িক বিদ্বেষ থাকবে না। চলুন ফিরে যাই সেই সত্য যুগে। মিথ্যা কথা বলতে কি বোঝায় সেটা তারা জানত না। রাজাহীন রাজ্যে একটি সুন্দর পৃথিবী ছিল। মানুষে-মানুষে ভালোবাসা ছিল, সবার মধ্যে মানবতা বিরাজিত ছিল। চলুন মানুষকে মানুষ হিসাবে ভালোবাসি। সবাই ভাই-ভাই হয়ে মিলেমিশে এই দেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলি।