মনিরুজ্জামান মনির, পাবনা থেকে:
গত মঙ্গলবার রাতে পাবনা শহরের চরঘোষপুর ইউনিয়নে এক চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। নিষ্ঠুর, হিংস্র, মনুষত্বহীন একদল সন্ত্রাসী নিরীহ কিছু মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের কাপুরুষোচিত ওই হামলায় প্রাণ হারান হেযবুত তওহীদের নিবেদিতপ্রাণ সদস্য মো. সুজন শেখ। ঘৃণ্যতম এই হামলার ঘটনার পর ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। তাদের ক্ষোভের আগুনে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।
সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম-বর্ণ-দল-দেশ নেই। নেই কোন আইনি বা গণভিত্তি। তাদের পরিচয় তারা অপরাধী, খুনী, শয়তানের মানসপুত্র এবং মানবসভ্যতার নিকৃষ্টতম প্রাণী। তাদের সমাজে কোন স্বীকৃকি নেই। তারা ধিকৃত হবে, নিন্দিত হবে। এভাবে তারা একদিন সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে। এর প্রমাণ মেলে নিহত সুজনের মরদেহ যখন হাসপাতাল থেকে তার গ্রামে আসে তখনকার পরিস্থিতি দেখে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের মর্গ থেকে পোস্ট মর্টেম ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, লাশ আসতে আসতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেই দুপুর থেকেই পাবনার সাধারণ মানুষ, সুজনের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা করছিলেন কখন সুজনের লাশ আসবে।
এদিকে সুজনের মরদেহ আসার খবর শুনে সন্ত্রাসীদের মদদদাতা, ইন্ধনতাদারা আবারো একত্রিত হতে শুরু করে। তারা দাবি তোলে এখানে কোন খ্রিস্টানদের কবর দেওয়া যাবে না। কিন্তু এলাকাবাসীর তোপের মুখে তাদের সে দাবি ধোপে টেকে নি। কারণ, এলাকাবাসী দেখেছে সুজনকে বড় হতে, বাবার আঙুল ধরে মসজিদে যেতে, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে। ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচারে প্রভাবিত সেই ধর্মান্ধদের কথায় কান দেয়নি জনসাধারণ। সুজনের লাশ আসার পূর্বমুহূর্তে প্রেসক্লাবে স্থানীয় হেযবুত তওহীদ সদস্যগণ ও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত থেকে এ হত্যকাণ্ডের বিচারের দাবি করেন। কথা বলেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দও।
যখন লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স শহরে এসে ঢুকল তখন মাগরিবের নামায শেষ। পাবনা টাউন হল মাঠেই মুসুল্লিরা মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলেন। লাশ পৌঁছানোর পর এক হৃদয়-বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে শত শত মানুষ ছিলেন যারা পূর্বে কখনও সুজনকে দেখেন নি। কিন্তু তারা টগবগে এই তরুণ প্রাণের নির্মম হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা করেন হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। তারা এই জঙ্গিবাদী হামলা ও খুনের বিচারের দাবিতে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন।
সুজনকে যখন তার বাড়ি চড়ঘোষপুরে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে তখন মানুষের ঢল নেমেছে। আশেপাশের গ্রামের সমস্ত মানুষ, অগণিত নারী-পুরুষ সুজনকে একনজর দেখার জন্য ভিড় করে আসে। জনস্রোত সামলাতে শৃঙ্খলা কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। সন্ত্রাসীরা নিশ্চয়ই দেখেছে, সুজনের প্রতি সাধারণ মানুষের এই সুগভীর ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি। জনগণ সন্ত্রাসীদের পক্ষে নয়। যে আদর্শের জন্য সুজন জীবন দিয়ে দিল, তারা সেই আদর্শের পক্ষে, তারা সুজনের পক্ষে। সুজনের দ্বিতীয় নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় তার গ্রামের বাড়িতে, স্কুল মাঠে। সেখানই তাকে দাফন করা হয়।
এই সারাদিন সুজনের মরদেহের জন্য গ্রামবাসীর প্রতীক্ষা, শহরে ও গ্রামে দুইটি জানাজা, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের দ্বিধাহীন প্রকাশ প্রমাণ করে যে মানুষ সন্ত্রাসীদের ঘৃণা করে, তারা চাপাতির পক্ষে নয়, রামদা’র পক্ষে নয়। তাদের আত্মা এই অন্যায়ের বিচার দাবি করে। সাধারণ মানুষের এই যে ভালোবাসা, এই সমর্থন সন্ত্রাসীদের জন্য এক কঠিন বার্তা। নেপথ্যের ফতোয়াবাজ খলনায়কদের জন্য, হুজুগ গুজব সন্ত্রাসের ইন্ধনদাতাদের জন্য, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বিস্তারকারীদের জন্য এক সতর্কবার্তা বহন করছে। কারণ পাবনার মাটিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সুজনের আত্মদান ও রক্তের কাছে পরাজিত হয়েছে সন্ত্রাস। এভাবেই পরাজিত হবে সর্বত্র।