হুমায়ূন কবির:
কোকিলানাং স্বররূপং, স্ত্রীনাং রূপং পতিব্রতম,
পুরুষাণাং বিদ্যারূপং, তপস্বীনাং ক্ষমারূপং।
ভাবার্থ: কোকিলের রূপ তার কণ্ঠস্বরে হয়, পতিভক্তি হলো নারীর রূপের পরিচয়,
পুরুষের রূপ তার বিদ্যাগুণে হয়, ক্ষমাগুণে তপস্বী চিরকান্তিময়।
সুপ্রাচীন এই সংস্কৃত প্রবচনটিতে আমরা জানতে পারি একটি নিগুড় সত্য যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিতর্কের কোনো শেষ নেই। বিতর্কটি হচ্ছে মানুষের রূপের মানদণ্ড কী? মানুষের প্রকৃত রূপের পরিচয় পাওয়া যায় তার চারিত্রিক গুণাবলীতে, চেহারায় নয়। নারীর রূপের মানদণ্ড হচ্ছে তার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ততা, আনুগত্য ও ভক্তি। এটাই হচ্ছে নিত্যসত্য, যার অস্বীকার পারিবারিক জীবনের শৃঙ্খলাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে।
মানুষের জন্য সবচেয়ে নির্মল, শান্তিদায়ী, চিত্ত-প্রশান্তিকর, ক্লান্তি নিবারক, স্বস্তির আশ্রয় তার পরিবার। কারণ নিজ পরিবারে একজন মানুষ যেমন নিখাদ ভালোবাসা লাভ করে তার তুলনা আর কোথাও নেই। পারিবারিক শান্তিবিধানে পুরুষ ও নারী উভয়ের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এই দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলি যুগে যুগে আল্লাহ নবী রসুল অবতারদের মাধ্যমে মানুষকে জানিয়েছেন, যার ফলে পারিবারিক জীবনের একটি ব্যবস্থা, সংস্কৃতি আমাদের সমাজে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ পৃথিবীতে একাধিক ধর্ম পাঠান নি, তিনি পাঠিয়েছেন একটি দীন, যার নাম বাংলায় সনাতন জীবনব্যবস্থা বা ধর্ম আর আরবিতে দীনুল কাইয়্যেমাহ। পারিপার্শ্বিকতাভেদে এই দীনের বিধান পরিবর্তন হয়েছে। একেক জাতি গোষ্ঠীতে একেক অবতার, নবী, রসুল এসেছেন যাদেরকে অন্য জাতির লোকেরা অজ্ঞতাবশত গ্রহণ করে নেয় নি। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সনাতন ধর্ম মানুষের নৈতিক চরিত্র তৈরি করে, মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্ব অঙ্গনের বিধান দেয়। মানুষের নৈতিক শিক্ষার একমাত্র উৎসই হচ্ছে ধর্ম। আজকে পৃথিবীর সকল মানুষ, সকল ধর্মের অনুসারীরাই তাদের জীবন-বিধাতা হিসাবে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে গ্রহণ করে নিয়েছে, সুতরাং তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক, জাতীয়, সামষ্টিক জীবনের ক্ষেত্রসমূহ পরিচালিত হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, রোমান দণ্ডবিধি, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি মতবাদের দ্বারা। লক্ষণীয় যে, মানবরচিত কোনো জীবনব্যবস্থাতেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন সুখময়, শান্তিময় করার পথ দেখায় না। পাশ্চাত্যের কোনো মতবাদে বলা নেই যে, বাবা-মাকে সেবা করতে হবে, বড় ভাইকে পিতার মতো জানতে হবে, ওয়াদা দিলে রক্ষা করতে হবে, ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান করতে হবে, কিভাবে মানুষ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘোটিয়ে মানুষ হিসাবে মহান হবে ইত্যাদি। ধর্মকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে আমাদের সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে চরম আত্মিক শূন্যতা, নৈতিকতাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে ধর্ম থেকে আগত যে নৈতিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিগুলি আমাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে ধরে রেখেছিল, সেই শৃঙ্খলার বাঁধন, বিশেষ করে আত্মিক বাঁধন ঢিলে হয়ে গেছে, বহু স্থানে কেবল ঢিলেই হয় নি, একেবারে নিশ্চিহ্নও হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলিতে অধিকাংশ বিয়েই স্থায়ী হয় না, যতদিন বিয়ে থাকে বনিবনা থাকে না, অশান্তি চলতে থাকে। যে বাবা মা সন্তানদেরকে অসীম মায়া মমতায় তিলে তিলে বড় করে তোলে, সেই বাবা মাকে বৃদ্ধ বয়সে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। সমাজের প্রতিটি নারী পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত, ব্যভিচার কোনো অপরাধ হিসাবেই গণ্য হয় না। পাশ্চাত্য সভ্যতার তৈরি জীবনব্যবস্থা ও সংস্কৃতি এভাবেই গ্রাস করে নিয়েছে মানুষের সকল মনুষ্যত্ব। সে শিখিয়েছে- ধর্ম নারীর অধিকারকে খর্ব করে, নারীকে বন্দী করে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে নারীদেরকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে, এভাবে সে নারী-পুরুষের মধ্যে একটি øায়ুযুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে, এরই ফলশ্র“তিতে আমাদের সমাজের অধিকাংশ ‘আধুনিক’ পরিবারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নেই কোনো শ্রদ্ধাবোধ। তারা কে কার উপরে কর্তৃত্ব করবে তা নিয়ে চরম দ্বিধাগ্রস্ত, একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তারের কলহে লিপ্ত। শুরুতেই যে কথাটি বলেছিলাম যে, পরিবার হচ্ছে শান্তির আগার, সেই কথাটি বর্তমানের পরিবারগুলির ক্ষেত্রে আর প্রযোজ্য নয়। এই অবস্থা পেছনের কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতার তৈরি আত্মাহীন, ভারসাম্যহীন জীবনব্যবস্থা ও বস্তুবাদী সংস্কৃতি গ্রহণ করে নেওয়া।