ইসলামি স্বর্ণযুগ বলতে অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সময়কালকে বোঝায়। এই সোনালি যুগের সূচনা হয় ৬২২ সালে মদিনায় প্রথম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক দীন প্রতিষ্ঠা ও উম্মতে মোহাম্মদী নামক মহাশক্তির উত্থানের সময় থেকে। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদ অবরোধের সময়কে এর শেষ ধরা হয়।
মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগের অন্যতম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ছিলেন আল ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর প্রকৃত নাম আবু নাসর মোহাম্মদ ইবন তারখান। জন্ম ট্রানসক্সিয়ানা এর ফারাব নামক স্থানে। এ কারণে তিনি ফারাবী নামে খ্যাত হন। মূলত তিনি ছিলেন তুর্কি গোত্রভুক্ত। এছাড়াও তিনি একজন মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ, যুক্তিবিদ এবং সুরকার ছিলেন। পদার্থ বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতিতে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনিই ‘শূন্যতা’-র অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন।
বাগদাদে এবং হাররানে তিনি ঐ যুগের দক্ষ জ্ঞানযোগীদের শীষ্যত্ব লাভ করেন। বাগদাদে তার শিক্ষক ছিলেন দার্শনিক আবু বিশর মাত্তা ইবনে ইউনুস। অতঃপর তিনি হাররানে চলে যান। সেখানে তার শিক্ষক ছিলেন ইউহান্না ইবনে খল্লিকান। এ সময়ে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা আরবদের মধ্যে ব্যাপকতা লাভ করে।
যদিও আল ফারাবী ছিলেন গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সংগীতেও ছিলেন তিনি অসাধারণ সফল (S.M Tagor Universal History of Music)। আল ফারাবীর প্রিয় সংগীত যন্ত্র ছিল ক্লাসিক্যাল বীণা বা উদ কাদিম (আল ফীদ: Annals’ Muslem)।
সংগীতে আল ফারাবীর দক্ষতা ও সুনাম বহু দিকে ছড়িয়ে পড়ে। হামদানী সুলতান সাইফ আল দাওলা আল ফারাবীকে হামদানী রাজধানী আলেপ্পো নগরীতে স্থায়ী ভাবে বসবাসের আহ্বান জানান। তাঁকে কেন্দ্র করে ঐ সময় আলেপ্পোতে জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনার বিকল্প সাধিত হয়। তাঁর ভক্ত এবং শিষ্যদের মধ্যে তার প্রতি আর্কষণের একটি কারণ সংগীত চর্চা। তার সংগীতের জলসা অনুষ্ঠিত হতো প্রাসাদের উপকন্ঠে অবস্থিত এক সমৃদ্ধ বাগানে।
ফারাবী এর জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থগুলো ছিলো দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, রসায়ন, আঙ্কশাস্ত্র, নীতিজ্ঞান (Ethics) রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সংগীত। তার বহু গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয় এবং পাশ্চাত্য সভ্যতাকে প্রভাবিত করে। ইউরোপীয়দের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আরব দার্শনিক এবং খ্যাত ছিলেন দ্বিতীয় এরিস্টটল হিসাবে। (আল-ওয়াররক, ফিহরিস্ত, পৃষ্টা-২৬৩; এম. কাসিরী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৮৯)।
আল ফারাবী রচিত সংগীত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ঃ-
১. কিতাব আল মিউসিকি আল কাবির (সংগীতের ওপর মহাগ্রন্থ)।
২. কিলাম ফিল মিউসিকা (সংগীতের স্টাইল)।
৩. কিতাব ফি ইহসা আল-ইসা (রিদমের শ্রেণী বিন্যাস গ্রন্থ)।
৪. কিতাব ফিল নোকরা মুদাফ ইলা আল ইকা (রিদম সম্পর্কে সম্পূরক জ্ঞাতব্য বিষয়)। (Steins Chneider, Al- Farabi, p- 79)
সংগীতের ওপর তার গ্রন্থাবলীর মধ্যে শুধুমাত্র কিতাব আল মিউসিকি আল কাবির সংরক্ষিত হয়েছে মাদ্রিদ, Leiden, মিলান এর প্রাচীন গ্রন্থাগারে। অন্য গ্রন্থগুলোর অংশবিশেষ বিভিন্নভাবে সংরক্ষিত হয়েছে (Henry George Farmer : Arabian Influence on Musical Theory p- 1516)।
আল ফারাবী তার রচিত কিতাব আল মিউসিকি আল কাবীর এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রণয়ন করেন- যা বর্তমানে অবলুপ্ত। পাশ্চাত্য এবং কন্সটানটিনোপোলের প্রাচীন গ্রন্থাগারের বহু পাণ্ডুলিপিতে আল ফারাবী রচিত গ্রন্থের উল্লেখ করা হয় (Toderini: Volume 1, p- 248-52)।
আল ফারাবীর সংগীত সংক্রান্ত অন্যান্য গ্রন্থেও মধ্যে আছে “কিতাব ফি ইহসা আল উলুম (বিজ্ঞান সমূহের শ্রেণী বিভাগ)। এই গ্রন্থটি ল্যাটিন, হিব্রু ভাষায় একাধিক বার অনুদিত হয়েছে। কিতাব আল আদওয়ারও আল ফারাবীর রচনা হিসাবে উল্লেখ করা হয় (হিলাল, ২৮ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৪)।
আল ফারাবির যুগেও মোল্লাতন্ত্র এই গুণী ব্যক্তিদেরকে নাস্তিক মুরতাদ কাফের ফতোয়া দিয়ে দেশছাড়া করত, অপমানিত করত, এমন কি হত্যা পর্যন্ত করত। সেই মোল্লাতন্ত্রের উত্তরাধিকাররাই এখনও সঙ্গীত, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকে হারাম বানিয়ে রেখেছে। আল ফারাবির দার্শনিক/বৈজ্ঞানিক অবদান নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই অথচ তিনি কত বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন সেটাকে আলোচনায় আনা হয় না।
তিনি গ্রিক দার্শনিক প্লেটো থেকে সমৃদ্ধ হয়েছেন, আবার ইউরোপ ফারাবি থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে। জ্ঞানের এই প্রবাহ চিরন্তন। মোল্লাতন্ত্র এই প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে ফতোয়ার জ্ঞানকে একমাত্র প্রয়োজনীয় জ্ঞান আর বাকিসব জ্ঞানকে অসার দুনিয়াবি জ্ঞান বলে অর্জনে নিরুৎসাহিত করেছে। রসায়নের (আলকেমি) মতো বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখাকে পর্যন্ত গুপ্তবিদ্যা ও কালোজাদু আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। মুসলিম জাতির এই ধ্যান-ধারণা তাদেরকে জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল সম্মানের আসন থেকে ছুঁড়ে ফেলেছে কালের গহ্বরে। পরিণামে এখন মুসলিমরা সবচেয়ে কূপমণ্ডূক, পশ্চাৎপদ ও অসহিষ্ণু জনগোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত। রাজনৈতিকভাবেও তারা এখন পশ্চিমা সভ্যতার গোলামি করছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অনেকেই বলছেন আবার মুসলিমদেরকে শিক্ষা ও জ্ঞানের সাধনায় নিবিষ্ট হতে হবে। বস্তুত তা নয়। জ্ঞান জগতে রেনেসাঁ সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামরিক শক্তি। মহানবীর (সা.) হাত ধরে মুসলিম জাতি প্রথমে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারপর সামরিক শক্তি অর্জন করেছে। তারপর পৃথিবীর বৃহৎ ভূখণ্ডকে পদানত করে সেখানে আল্লাহর দীন চর্চা করেছে। ফলে তাদের বিরাট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। মানুষ পেটের চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তখন তাদের মস্তিষ্কের দরজা খুলে গেছে।
যে জাতি মগজে-মননে দাস, যারা রাজনৈতিকভাবে অন্য জাতির পদানত তাদের মগজের দরজা তালা মারা থাকে। তাদের মগজ ব্যস্ত থাকে দুটো অন্ন যোগানোর চিন্তায়। সেখানে সঙ্গীত, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন জায়গা পায় না। এজন্য মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আগে সকল ফেরকা মাজহাব, রাজনৈতিক দর্শনকে একপাশে সরিয়ে রেখে আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্যই তাদেরকে শক্তিশালী ও বিজয়ী জাতিতে পরিণত করবে। বাকি সব উন্নতি অগ্রগতি জাগতিক প্রাপ্তি আসবে সেই বিজয়ের সূত্র ধরে।