মনিরুয্যামান মনির:
সকল মহাপুরুষই চান মানবজাতির ঐক্য, কারণ তারা জানেন যে ঐক্যের মধ্যে কল্যাণ নিহিত। তা সত্ত্বেও ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি ধর্মকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখার জন্য বিভিন্ন মনগড়া প্রথাকে ধর্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। তাদের প্রচারের গুণে হিন্দুধর্মের মধ্যে আচার-বিচার, জাত-পাত এবং ছোঁয়াছুঁয়িটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। মহামানবদের শিক্ষা বইয়ের পাতায় মুদ্রিত থাকলেও বাস্তবে হিন্দু অর্থাৎ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের মধ্যে অনেকগুলি সম্প্রদায়ে বিভক্ত যেমন: বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য ইত্যাদি। এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যেও আছে নানা উপদল। এছাড়া আছে প্রাচীনকাল থেকে চলমান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, কায়স্থ, শুদ্র ইত্যাদি বর্ণভেদ। একত্ববাদী ব্রাহ্মরাও কম নয়। এতসব বিভক্তি বজায় রেখে একটি জাতি খুব বড় কিছু করতে পারে না।
এক গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরাও হীনযান, মহাযান, বজ্রযান, তন্ত্রযান ইত্যাদি উপদলে বিভক্ত। দেশ ও অঞ্চলভেদে ছোটবড় বিভক্তিও আছে অসংখ্য। খ্রিস্টানদের মধ্যেও আছে প্রধান দুই ভাগ- প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথোলিক; উইকিপিডিয়ার ‘অসম্পূর্ণ’ তালিকা অনুযায়ী খ্রিস্টধর্মের মোট উপদলের সংখ্যা ৪১,০০০। তথ্যটি অবিশ্বাস্য হলেও অসত্য নয়। ইউরোপের মধ্যযুগে এই ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বিবাদ চরম আকার ধারণ করেছিল। ত্রিশ বর্ষব্যাপী (১৬১৮-১৬৪৮) এক বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সমগ্র ইউরোপজুড়ে, যার মূল যুদ্ধক্ষেত্র ছিল মধ্য ইউরোপ যেখানে আজকের জার্মান রাষ্ট্রটি অবস্থিত। ইউরোপের প্রায় সকল দেশই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এটি ছিল ইউরোপের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কেবল সুইডিশ সেনাবাহিনীর হাতে জার্মানের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ নিহত হয়েছিল, দুর্গ ধ্বংস হয়েছিল ২,০০০টি; ১৮,০০০ গ্রাম ১,৫০০ শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল।
আজ আমরা হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই পাশ্চাত্য পরাশক্তিগুলির চাপিয়ে দেওয়া সিস্টেমের ফাঁদে পড়ে দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি, অন্যায়, দুর্নীতি, অবিচার ইত্যাদির মধ্যে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ১৯৪৭ সনে ব্রিটিশদের হাত থেকে আমরা এই উপমহাদেশের বাসিন্দারা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল আমরা স্বাধীন হই নি। ১৯৭১ সনে আবারও আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামক আরেকটি ভূখণ্ড লাভ করেছি কিন্তু যে জন্য এত সংগ্রাম অর্থাৎ অন্যায় অবিচারহীন একটি সমাজগঠন, সেটা কি আমরা করতে সক্ষম হয়েছি? না। আমরা দিন দিন আরও বেশি করে পাশ্চাত্যের পদানত গোলামে পরিণত হচ্ছি।
আল্লাহর শেষ নবী ও রসুল মোহাম্মদ (দ.) আরবের গোত্রের সঙ্গে গোত্রের সংঘাত নিরসন করে, গোত্র, বর্ণ, বংশ, আভিজাত্য প্রথা নির্মূল করে বৃহত্তর জাতি গঠন করেছিলেন, সেই মুসলিমরাও মানব সৃষ্ট মতবাদের অনুসরণ আর ফেরকাবাজির কারণে শত শত মাজহাবে, তরিকায় বিভক্ত। এই শিয়া-সুন্নী যুদ্ধে গত কয়েক শতাব্দী ধরে কত লক্ষ মুসলিম নিহত হয়েছে এবং আজও এই দ্বন্দ্বে শহর-বন্দর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব মেলানোই কঠিন। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য আজ অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে এই ফেরকাবাজির ফলে। কথায় কথায় মুসলিমরা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে গালি দিয়ে থাকেন মুসলিমদের উপর নানামুখি নির্যাতন, অত্যাচারের কারণে, শোষণ-বঞ্চনার কারণে। কিন্তু একবারের জন্যও মুসলিম নামক এই জাতিটি ভেবে দেখে না যে, নিজেরাই নিজেদের মধ্যে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে নানা তর্ক, বাহাস করে শত শত মাজহাব, তরিকায় বিভক্ত হয়ে জাতি হিসাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে তারা। আর তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। শত্রুরা দুর্বলতার সুযোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক। এটা তো শত্রুর দোষ নয়, বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা। কাজেই মুসলিমদের অধঃপতনের পেছনে পাশ্চাত্যরা যতটা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী তারা নিজেরাই। এখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষকে একটি মহাসত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ করতে করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আমরা সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই বাবা-মায়ের সন্তান। আমরা যে যে ধর্মের অনুসারীই হই না কেন, সব ধর্মই চায় মানুষ তার নিজের কল্যাণের জন্য ঐক্যবদ্ধ হোক।
মুসলিমরা শিয়া-সুন্নী বিভেদ ভুলে একতাবদ্ধ হোক, হিন্দু-মুসলিম একতাবদ্ধ হোক, বৈষ্ণব-শাক্ত একতাবদ্ধ হোক, হীনযান-মহাযান এক হোক, প্রোটেস্ট্যান্ট-ক্যাথোলিক এক হোক। তারা ধর্মের ছোটখাটো বিষয়গুলি নিয়ে নিজেদের মতভেদগুলি পাশে সরিয়ে রেখে ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলির উপর একতাবদ্ধ হোক। আসুন, আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলি ৭০০ কোটি আদমসন্তানের এক বিশাল ভ্রাতৃসমাজ।