আজ সমস্ত পৃথিবী এক সাংঘাতিক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। পৃথিবীময় যুদ্ধ-রক্তপাত, হানাহানি, হত্যা, গুম, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জ্বালানি সংকট সব মিলিয়ে সর্বত্র এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরই মধ্যে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের ঘটনার পর বহু রাষ্ট্রনায়ক, বহু সেনাপ্রধান ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই হামলার মধ্য দিয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়ে গেছে। এ আক্রমণের ফলে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। পরাশক্তিধর অস্ত্রব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোকে যারা দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে সবেমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থ, বাণিজ্য, যোগাযোগব্যবস্থাসহ অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলোর উন্নয়নের দিকে আমরা মাত্রই পা বাড়িয়েছি। এরই মধ্যে বিশ্বসংকটের জালে আমাদের দেশটিকেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে হচ্ছে।
১৯৭১ সালে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হল কিছুদিন আগে। এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে হানাহানি, দ্বন্দ, সংঘাত, স্বার্থের রাজনীতি, ক্ষমতা দখলের কামড়াকামড়ি ও অসুস্থ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে ধর্মকে ব্যবহার করেও চলছে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোড়াপন্থী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও পেশীশক্তি প্রদর্শনের মহড়া, চলছে রমরমা ধর্মব্যবসা, সন্ত্রাসবাদ, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা ও হুজুগ-গুজবের ছড়াছড়ি। মোটকথা বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি স্মরণকালের সংকটময় কাল অতিক্রম করছে। যারা দেশকে নিয়ে ভাবেন, দেশকে ভালবাসেন, যারা দেশের কল্যাণ চান, স্থিতিশীল পরিবেশ ও শান্তি চান তারা সংখ্যায় অগণিত হলেও তারা নানারকম চিন্তা, বাদ-মতবাদের দ্বন্দ্ব ও বিভক্তিতে আক্রান্ত এবং ধর্মীয় ভাবে হাজারো ফেরকা, মাজহাব, তরিকায় খণ্ডবিখণ্ড। এই ঐক্যহীনতার কারণে কোনো প্রকার অন্যায়ের প্রতিবিধান তারা করতে পারছেন না। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। একদিকে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে পুরাতন রাজনৈতিক দলগুলোর চিরন্তন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি বিবেচনা করে শান্তিকামী মানুষ আজ দিশেহারা! তাদের চোখের সামনে পতন হয়েছে শ্রীলঙ্কার, পতনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান। এই যে সংঘাত-সংঘর্ষ, যুদ্ধ-রক্তপাত, অভাব-দারিদ্র্য, স্বার্থপরতা-আত্মকেন্দ্রিকতা এর কি কোনো শেষ নেই?
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
মানবতার কল্যাণে নিবেদিত অরাজনৈতিক আন্দোলন ‘হেযবুত তওহীদ’ স্পষ্ট করে বলতে চায়- এই সংকট একদিন-দুইদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী ও পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অশুভ কালো হাত। তারাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে নানারকম বাধা সৃষ্টি করে রেখেছে যেন আমরা কখনও স্বাবলম্বী, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত না হতে পারি এবং সর্ববিষয়ে তাদেরই মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল হয়ে থাকি। আমাদেরকে তাদের সিস্টেমের দাস বানিয়ে রাখার জন্য তারা চায় না বা চাইবে না যে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। যে জনগোষ্ঠী নানা ধরনের রাজনৈতিক দলে-উপদলে, নানারকম মতাদর্শে এবং ধর্মীয় মতবিরোধে বিচ্ছিন্ন, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যেভাবে পুরো জাতি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে থাকে তাদেরকে শাসন শোষণ করা সহজ হয়। তাই বাংলাদেশের সামনেও যে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করে আছে তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন। চলমান বৈশ্বিক সংকট থেকে বাংলাদেশের মানুষের রক্ষা পাওয়ার একটা মাত্র পথ খোলা রয়েছে- সেটা হলো সমস্ত জনগোষ্ঠীকে আজ যে কোনো মূল্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
কীভাবে এবং কোন সূত্র দিয়ে আমরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করব?
আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বলে যাচ্ছি, ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছি যে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য যে সূত্র দরকার সেটা আল্লাহর রহমতে আমাদের কাছে আছে। আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর রসুল (সা.) যে সমাজে আসলেন, ইতিহাসের পাতায় সেই সময়টিকে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগ। সেই সমাজে সর্বত্র চলত গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অবিশ্বাস, সুদ-ঘুষ, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, নারীদের উপর নির্যাতন, দাসব্যবসা, কুসংস্কার, হুজুগ-গুজব, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক অশান্তি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি। পুরো আরব এমন জাহেলিয়াতের অন্ধকারে ডুবে ছিল। তাই সে সমাজকে বলা হত জাহেলি সমাজ। ঐ সমাজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, আমানতদার, সাহসী, পরোপকারী মানুষটি মানুষের দুর্দশা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সেই মুক্তির পথ দেখালেন। তিনিই হলেন আল্লাহর শেষ রসুল, আখেরী নবী, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ তাঁকে বোঝালেন যে, এই জাহেলি সমাজের অশান্তি দূর করতে হলে, প্রথমেই জাতির প্রতিটি সদস্যের মধ্যে ঐক্যচেতনা জাগ্রত করতে হবে। অর্থাৎ তাদেরকে একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সেই কথাটি হচ্ছে তওহীদের ঘোষণা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.) অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম-বিধান ছাড়া আর কারো হুকুম মানি না এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রসুল। এই একটি কথার দিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি মানবজাতিকে ডাক দিয়েছেন।
সত্যের পথে বাধা আসবেই!
তওহীদের ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই আরবের একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী, স্বার্থান্বেষী, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তাঁকে নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে। ফলে আসহাবদের অবর্ণনীয় কষ্ট, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তাদেরকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, তিনি অটল, অনড় থেকে এক দেহ, এক মন হয়ে মানুষের কল্যাণে, মানবতার মুক্তির জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর প্রিয় সাহাবীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, কঠোর নির্যাতন সহ্য করে, অসম্ভব ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, কোরবানি ও শাহাদাতের বিনিময়ে পুরো জাজিরাতুল আরবে আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার ফল কী হয়েছিল, সংক্ষেপে সে ইতিহাস তুলে ধরছি।
আল্লাহর রসুল (সা.) কেমন সমাজ নির্মাণ করেছিলেন?
আল্লাহর হুকুম দিয়ে সমাজ পরিচালনার ফলে এমন ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, মানুষ দরজা খুলে ঘুমাত, চুরি ডাকাতির কোনো ভয় ছিল না। একা একজন নারী রাতের অন্ধকারে শত শত মাইল পথ চলে যেত, না ছিল তার সম্পদ হারানোর ভয়; না কোনো ইজ্জত হারানোর ভয়। জীবন ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হলো। আদালতে মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ আসত না, কারণ সেখানে চূড়ান্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেল। মানুষের অভাব দারিদ্র্য দূর হয়ে গেল, মাদকাসক্তি নির্মূল হয়ে গিয়ে মানুষ সুস্থচিন্তার অধিকারী হল। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ব্যভিচার ইত্যাদি দূর হয়ে মানুষ সুস্থ জীবনযাপন করতে থাকল। অর্থাৎ এক কথায় ঘরে-বাহিরে, বিচারালয়ে, রাষ্ট্রে, অর্থনীতিতে, শিক্ষাক্ষেত্রে, বাণিজ্যে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মানুষের সমৃদ্ধি আসল। নারীরা তাদের প্রকৃত অধিকার ফিরে পেল। ইতিহাস সাক্ষী আল্লাহর সত্যদীন মানুষের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে অশিক্ষিত, অবজ্ঞাত, পশ্চাৎপদ আরব জাতি পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে আসীন হলো। রসুলাল্লাহ (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন এই আদর্শ পুরো জাজিরাতুল আরবে (আরব উপদ্বীপে) প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। তাঁর ওফাতের পর আসহাবরা সেই একই আদর্শ দিয়ে একই প্রক্রিয়ায় বাকি অর্ধ-পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে মানবজীবন থেকে সমস্ত প্রকার অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করলেন।
ইতিহাস পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই মাত্র এক শতাব্দীর ব্যবধানে পৃথিবীর সবচেয়ে অবজ্ঞাত, মূর্খ, অশিক্ষিত জাতিটি শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, ভূখণ্ডে, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে আসীন হয়েছিল। তখন তাদের সামনে চোখ তুলে তাকানোর মত হিম্মত কারো ছিল না। তৎকালীন দুইটি সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য নবগঠিত জাতিটির সামনে ঝড়ের মুখে তুলার মত উড়ে গিয়েছিল। কীসের শক্তিতে, কী দিয়ে, কোন মন্ত্রবলে তারা বিশ্বের সেরা জাতিতে পরিণত হয়েছিল? হ্যাঁ, তাদের একমাত্র শক্তি ছিল তারা ছিলেন সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ। তাদের জীবনের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, জীবন-সম্পদ উজাড় করে দিয়ে সংগ্রাম করে আল্লাহর দীনকে মানবজাতির জীবনে কার্যকর করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর প্রিয় সাহাবিরা চলে যাওয়ার পর, তাদের বংশধরেরা একে একে বিদায় নেওয়ার পর, কয়েক শতাব্দী পার হয়ে গেল। আমরা সেই মহান আদর্শ হারিয়ে ফেললাম, সেরাতুল মোস্তাকিম/সঠিক পথ ত্যাগ করলাম। এভাবে চললো কয়েকশ বছর। ইবলিসের প্ররোচনাসহ নানা কারণে আমরা আজও ঐক্য ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠছি।
ঐক্য ধ্বংস কিভাবে হলো ?
আল্লাহর রাসুলের (সা.) ওফাতের ৬০/৭০ বছর পর উম্মাহ ভুলে গেল কেন তাদের উত্থান ঘটানো হয়েছিল। কী তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কেন রসুল (সা.) উম্মতে মোহাম্মদী নামক জাতি গঠন করেছিলেন। জাতির মধ্যে প্রবেশ করল বিকৃত সুফিবাদী তরিকা ও দরবারি আলেম। এদের কাজ ছিল দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তর্ক-বাহাস ও নানা বৈষয়িক স্বার্থ হাসিল। সুফিবাদী তরিকার প্রসারের ফলে নির্জনে বসে আত্মার ঘষামাজা করতে গিয়ে উম্মাহর বহির্মুখী চরিত্র বদলে অন্তর্মুখী হয়ে গেল। অন্যদিকে ইমাম, ফকিহ, মুজতাহিদ, মুফসসির-মুহাদ্দিসদের কোর’আন-হাদিসের বিধিবিধানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তর্ক বিতর্কের পরিণামে জাতি শিয়া, সুন্নি, শাফেয়ী, হাম্বলী, মালেকী, হানাফি ইত্যাদি শত শত মাজহাব ও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে গেল। এভাবে জাতির ঐক্য ধ্বংস হতে লাগল। ঐক্য ভঙ্গের বৃহত্তম কারণ হলো মতানৈক্য ও গীবত। যেটা আমাদের সমাজে এখনও চালু রয়েছে। এক আলেম আরেক আলেমকে দেখতে পারেন না, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ওয়াজ মাহফিলে বসে সমালোচনা করেন, আরেক মতাদর্শের অনুসারীদের উপর আক্রমণের উষ্কানি দেন, অপ্রয়োজনীয় গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে বাহাস করেন। এসবের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মুসলিম জাতির ঐক্য টুকরো টুকরো হচ্ছে।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের নামে শত শত দল খণ্ডে-বিখণ্ড হয়ে আছে। তাদের অনুসারীরাও একদল আরেকদলকে দেখতে পারে না। একদলের অনুসারী আরেকদলের অনুসারীর কার্যালয়ে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে, প্রতিপক্ষকে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে, মানহানি করে। কারণ, এই রাজনৈতিক সিস্টেম ব্রিটিশদের তৈরি। তাই তাদের তৈরি করা সিস্টেমে আমরা একদিনও ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারিনি। অর্থাৎ আমরা জাতিগতভাবে যেমন বিভক্ত তেমনি ধর্মীয় দিক থেকেও কোন্দলে লিপ্ত। সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনের উভয়ের ঐক্য যে কত জরুরি তা বর্তমান সমাজের করুণ পরিণতির দিকে তাকালে বোঝা যায়।
সমাজে আবার শান্তি ফিরে আসবে কীভাবে ?
আল্লাহ এক, রসুল (সা.) এক, আমাদের কেতাব এক, আমরা এক জাতি ছিলাম- উম্মতে মোহাম্মদী। সেই এক জাতিসত্তার ধারণা থেকে সরে গিয়ে আজ হাজারো রকম ফেরকা, মাজহাবে, তরিকা, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে আছে বর্তমান মুসলিম উম্মাহ। বিভিন্ন সুফিবাদী তরিকা, রাজনৈতিক দলাদলি, ধর্মীয় কোন্দল, উগ্রবাদী সংগঠন তৈরি করে এবং ধর্মীয় আলেমদের মতবিরোধ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তর্ক-বাহাসের দ্বারা এক জাতি আজ হাজারো খণ্ডে বিখণ্ড হয়ে আছে। ঐক্যহীন হয়ে গেলে যেকোনো কিছুই তার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। যে মুসলিমরা এক সময় ছিল শ্রেষ্ঠ জাতি সেই আমরা ঐক্য ভঙ্গ করার পরিণামে অন্য জাতির কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হই। অন্য জাতি আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় আল্লাহর লা’নত নেমে আসে মুসলিম জাতিটির উপর। ইউরোপ থেকে ক্রুসেডার বাহিনী আর মোঙ্গল থেকে তাতার বাহিনী এসে মুসলিম জাতিকে পদদলিত করে। তবুও আমরা সতর্ক হই নি, ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। সর্বশেষ ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা পুরো অর্ধ-দুনিয়ায় আটলান্টিকের তীর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সামরিক শক্তিবলে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো দখল করে এ জাতিকে পায়ের নিচে গোলাম বানিয়ে দিল। তারা প্রায় চারশো বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসন ও শোষণ করল। চিরতরে আমরা যেন মাথা তুলে না দাড়াতে পারি সেজন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ভঙ্গুর করে দিয়ে তাদের তৈরি ব্যবস্থা আমাদের উপর চাপিয়ে দিল। তারা চলে যাওয়ার পর আমরা আজও আমাদের জাতীয় জীবনে তাদের তৈরি অর্থব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক সিস্টেমের অনুসরণ ও অনুকরণ করে যাচ্ছি। এখন আমরা জাতীয় জীবনে মানি ব্রিটিশদের দেওয়া সিস্টেম। এর মধ্যে একটি হচ্ছে তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক ব্যবস্থা; এই স্বার্থের রাজনীতি, কামড়াকামড়ির রাজনীতি, হানাহানি, বিভিন্ন দল, বিভিন্ন মতাদর্শ, কোনোটা বাম, কোনোটা ডান, কোনোটা সেক্যুলার আদর্শ ইত্যাদি। এসব রাজনৈতিক কোন্দল জাতিকে একদিনও ঐকবদ্ধ থাকতে দেয়নি।
ইতিমধ্যে ভৌগোলিকভাবে মুসলিম উম্মাহ প্রায় ৫৫ টি রাষ্ট্রে, শরিয়াহগতভাবে হাজার হাজার ফেরকা মাজহাবে, আধ্যাত্মিকভাবে বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত। বর্তমানে এই মুসলমান নামক জাতি সংখ্যায় প্রায় ১৮০ কোটি অথচ সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮ কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু। একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশে দেশে। কেউ তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না, এমনকি অনেক মুসলিম দেশও তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে না। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো মিথ্যা অজুহাতে একের পর এক তাদের দেশগুলো ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে মুসলিমদের গণকবর রচনা করছে। যেমন: ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সুদান, সোমালিয়া, ইয়েমেন, তুর্কমিনিস্তান, বসনিয়া, চেচনিয়া ইত্যাদি। ফিলিস্তিনে আজও পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। পৃথিবীর যেদিকেই চোখ যায় সেখানেই মুসলিমদের করুণ দুর্দশা চোখে পড়ে। তারপরও আমাদের প্রায় প্রত্যেকটা মুসলিম দেশ তাদের মুখাপেক্ষী।
এখন এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুক্তির পথ কী ?
আমরা যারা নিজেদের মো’মেন, মুসলিম, উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে দাবি করি। আমাদের আজকে একটি কথায় আসতে হবে, আমরা যে সেরাতাল মুস্তাকিম হারিয়েছি, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছি, সত্যদীন ত্যাগ করেছি সেই তওহীদ ভিত্তিক সত্যদীন আবার আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব ? সেই রূপরেখা আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ অতীব দয়া করে হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। হেযবুত তওহীদ মানুষের সামনে সেই হেদায়াহ ও তওহীদভিত্তিক অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক দীনুল হক মানুষের সামনে তুলে ধরছে। আল্লাহর রসুল (সা.) যেভাবে জাতিটাকে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আমাদের আজ সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ঐক্যবদ্ধ হব কীসের ভিত্তিতে?
- আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, ইসলামের বুনিয়াদ ৫টি।
- ১) তওহীদের উপর ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না এই সাক্ষ্য প্রদান করা।
- ২) সালাহ কায়েম করা।
- ৩) যাকাত প্রদান করা।
- ৪) হজ্জ পালন করা।
- ৫) সওম পালন করা।
এখানে প্রথম বুনিয়াদ হল তওহীদ বা কলেমা, বাকিগুলো আমল। আমাদের শক্তিশালী জাতিগঠনের প্রথম ভিত্তি বা পূর্বশর্ত হবে তওহীদের ওপর জাতিটাকে ঐক্যবদ্ধ করা। এবং এই তওহীদের উপর একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সূত্র বা কর্মসূচি ৫টি। সেগুলো হলো-
- ১) ঐক্য
- ২) শৃঙ্খলা
- ৩) নেতার আনুগত্য
- ৪) সকল অন্যায় থেকে হিজরত
- ৫) জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম বা জেহাদ
এই ৫ দফা কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে একটি জাতিসত্তা যখন তৈরি হবে, একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে আত্ম-উৎসর্গিকৃত একদল মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হবে তখন তারা হবে ভাই-ভাই। তাদের ভাতৃত্ব, পরস্পরের প্রতি অনুভূতি, আমানতদারিতা, ওয়াদা রক্ষায় তারা হবে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ। তারা সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিবে। সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। যারা এই ৫ দফা কর্মসূচির বন্ধনে যারা নিজেদেরকে বাঁধবেন তাদের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার ৫টি। সেগুলো হলো-
- ১) খাদ্যের অভাবে তারা কেউ না খেয়ে থাকবে না,
- ২) কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না,
- ৩) বস্ত্রের অভাবে কেউ কষ্ট পাবে না,
- ৪) কেউ বাসস্থান থেকে বঞ্চিত হবে না
- ৫) শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।
যারা আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হবেন তাদের প্রতি আমাদের ৫টি মূলনীতি। সেগুলো হলো-
- ১) কেউ কোন ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হবে না।
- ২) অবৈধ অস্ত্রের সংস্পর্শে যাবে না।
- ৩) ধর্মের কাজ করে কেউ কোনো বিনিময় গ্রহণ করবে না। যারা বিনিময় নেয় তাদের অনুসরণ করা যাবে না।
- ৪) কর্মক্ষম কেউ বেকার থাকবে না
- ৫) আন্দোলনের কাজের জন্য হেযবুত তওহীদের বাইরের কারো অর্থ গ্রহণ করা যাবে না।
এই ৫টি মূলনীতি অনুসরণ করে আমরা হেযবুত তওহীদ প্রায় দুই দশক ধরে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে যাচ্ছি। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের এই কার্যক্রম চলছে। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে, মানবতার কল্যাণে, ঈমানী দায়িত্ব কাধে নিয়ে শত বাধাবিপত্তি সহ্য করে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্বময় মানবসমাজে ন্যায়-সুবিচার, শান্তি, মানবতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শত শত মাজহাব ফেরকায় বিভক্ত এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রথম কর্তব্যই হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব তথা তওহীদকে ঐক্যসূত্র হিসেবে গ্রহণ করে একতাবদ্ধ হওয়া। হেযবুত তওহীদ বিগত ২৭ বছর ধরে সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি, গুজব, হুজুগ, সাম্প্রদায়িকতা, নারীর অবমাননা, মাদক ইত্যাদির বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ জনসচেতনতামূলক সভা, সেমিনার, পথসভা, ইত্যাদি অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। এছাড়া পত্রিকা, বই, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, অনলাইনে প্রচার করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের আহ্বান মানুষের কর্ণকূহরে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টার চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ যা আমাদের কাছে রয়েছে তা যদি ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়, তাহলে সমাজের যাবতীয় ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, উগ্রবাদ, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি দূর হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এনশা’আল্লাহ।