রিয়াদুল হাসান
মানুষ বিশ্বাসগতভাবে আজ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। একদল ধর্মকে সমর্থন করে আরেকদল করে না। দ্বিতীয় দলের মধ্যে অনেকেই ধর্মের প্রতি তাদের অবজ্ঞাকে প্রকাশ করে থাকে। অনেকে সামাজিকতা রক্ষার জন্য ধর্মকে ভক্তি করার ভান করেন। কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করেন যে ধর্ম এ যুগে অচল মতবাদ, এটা দিয়ে দেশ জাতি পরিচালনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর যারা ধর্মভীরু অংশের মানুষ তারা ধর্মের আচার-আচরণগুলো খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, তা হলো সওয়াব হবে। সওয়াব কী, কেন সওয়াব হবে এসব নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো যুক্তিশীল চিন্তাও নেই। অন্ধবিশ্বাসটাই তাদের ধর্মাচারের ভিত্তি। ধর্মগুলো কেন এসেছিল, মানবসমাজে তার কী প্রভাব পড়েছিল সেটা যদি আমরা বিবেচনায় নেই তাহলে দেখব ধর্ম এসে মানুষের দুনিয়ার জীবনকে আগে সুন্দর করেছে, মানবসমাজকে একটি নতুন জীবনচর্যা, সিস্টেম উপহার দিয়েছে যার ফলে অন্যায় অবিচার লুপ্ত হয়ে শান্তি সুবিচার নেমে এসেছে। ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য এই শান্তি, এজন্যই এর নাম ইসলাম- মানে শান্তি। সনাতন ধর্মের মন্ত্র – ওম শান্তি।
মানবজাতি যখন ঘোর সঙ্কটে নিপতিত হয় তখন আল্লাহ তাঁর নবী-রসুলদের প্রেরণ করেন। তাদের সেই সংকট সমাধানের জন্য বড় বড় যুদ্ধও করে গেছেন, বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বিপ্লবের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে যুদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণ করেছেন কুরুক্ষেত্র, শেষ রসুল করেছেন বদর ওহুদ খন্দক। ইব্রাহিম (আ.), মুসা (আ.) দাউদ (আ.) সবাইকেই লড়াই করতে হয়েছে বড় বড় অপশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু আজ ধর্ম যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আর জীবনের কোনো প্রয়োজন পূরণ করছে না, কোনো বাস্তব সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না।
আজ যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন তাদেরকে এই চিন্তাবিন্দুতে আসতে হবে। এই বিষয়টা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে যে, ধর্ম যেহেতু জীবনের পথনির্দেশিকা তাই ধর্ম কখনোই সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু আজ ইসলাম ধর্মের যারা ওলামায়ে কেরাম আছেন তারা মানুষের এই নির্মল বিনোদনের সুযোগটুকু কেড়ে নিতে ফতোয়ার কোপ বসাচ্ছেন। তারা ঘোষণা দিচ্ছেন যে গান শোনা হারাম, বাদ্য বাজানো হারাম, ছবি আঁকা, ছবি তোলা হারাম, যাত্রাপালা, নাটক করা, সিনেমা দেখা হারাম ইত্যাদি। তাদের অনুসারীদের উগ্রপন্থী অংশটি উদীচী, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, সিনেমা হলে বোমা হামলা চালিয়েছে।
জনসাধারণকে এই বিষয়টাই সুস্পষ্ট হতে হবে যে, সিনেমা দেখা হারাম নয়, হারাম হলো অশ্লীলতা। অশ্লীল দৃশ্য দেখায় বলে তুমি সিনেমা হলে হামলা চালাচ্ছো? সিনেমা হলের কী দোষ? রসুলাল্লাহ গান শুনতে মানা করেন নি, কেবল গানের কথায় বা পরিবেশনায় যদি মিথ্যা, আল্লাহর নাফরমানি বা অশ্লীলতা থাকে সেটুকু কেটে ফেলে দিয়েছেন। ধরুন একটি ফলের কিছু অংশ পচে গেছে। তখন কি আমরা পুরো ফলটাই ফেলে দেব নাকি ছুরি দিয়ে কেবল পচা অংশটুকু ফেলে বাকিটুকু খাব?
প্রশ্ন হচ্ছে, পচবে কেন? এটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা। পচার তো কথা না। আমাদের তো সেট সংরক্ষণ করা উচিত ছিল যেন ভাইরাস ধরতে না পারে। তেমনি সংস্কৃতির মধ্যেও তো অশ্লীলতার অনুপ্রবেশ ঘটার কথা ছিল না। এটা হলো আমাদেরই দোষে। এখন মওলানা সাহেবরা চাচ্ছেন পুরো সংস্কৃতিটাই ফেলে দিতে। হ্যাঁ, যদি পুরোটাই ফেলে দিতে হয় তাহলে নতুন আরেকটা সংস্কৃতি নিয়ে আসুন যা মানুষের হৃদয়গ্রাহী হবে। কিন্তু ফল যেমন খেতে হবে, তেমনি সংস্কৃতিও লাগবে।
সংস্কৃতি ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। গান মানুষকে শুনতেই হবে, সব মানুষই নিভৃতে মানুষ গান শুনতে শুনতে বিশ্রাম নেয়, ঘুমিয়ে পড়ে। কেন? কারণ ¯্রষ্টাই মানুষের মধ্যে সুরের প্রতি এই অনুরাগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহই সুরের ¯্রষ্টা। কেয়ামতের দিন আল্লাহ নাকি দাউদ (আ.) কে কোর’আন তেলাওয়াত করতে বলবেন। কেন? কোর’আন তো নাজেল হয়েছে শেষ নবীর উপর। সেটা দাউদের (আ.) কণ্ঠে কেন শুনানো হবে? কারণ তাঁর সুরেলা কণ্ঠের কারণে। তাঁর কণ্ঠ ভালো। এসব কথা তো আলেম সাহেবরাই ওয়াজের মধ্যে বলেন। তাহলে বোঝা গেল সুর একটি নেয়ামত। সুরকে বর্জন করা যাবে না। ফল ফেলে দেওয়া যাবে না, ফেলতে হবে পচা অংশটুকু।
আজকে তারা সম্পূর্ণটাকে হারাম করে দিয়েছে। যার ফলে সাংস্কৃতিক অংশটাই অচল হয়ে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে। এভাবে তো একটি জাতি চলতে পারবে না। এই ফতোয়াবাজ শ্রেণিটি অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে নারীদেরকে ঘর থেকেই বের হতে দেয় না। এটা তো নারীদের উপর অন্যায় করা হয়েছে। উচিত ছিল অশ্লীলতা দূর করা। এমন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেন মানুষ অশ্লীলতাই না করতে পারে। অপরদিকে কেউ যেন নারীকে উত্যক্ত বা ইভটিজিং করারও সাহস না পায়। সমাজে এসব অন্যায় চলে বলে নারীদেরকেই আটকে রাখা মানে একটা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে নেওয়া। এর পরিণামেই জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী ঘরে বন্দি হয়ে আছে। এখন নারীদেরকে যদি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হয় তাহলে তাদের কাছে ইসলামের প্রকৃত আকিদাটা সুস্পষ্ট করে দিতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে ইসলাম নারীদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে, কী করেছে। এই অন্ধত্ব ভাঙানোর দায়টা সমাজের সকল চিন্তাশীল ও সচেতন মানুষের, বিশেষ করে যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সক্রিয় রয়েছেন তাদের এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। যারা সঙ্গীতে আছেন তারা সঙ্গীতের মাধ্যমে এই বক্তব্য তুলে ধরবেন। যারা সাহিত্যিক তারা সাহিত্য রচনা করবেন। যারা নাটকে সিনেমায় আছেন তারা অভিনয় করবেন। সবাই কথা বলবেন সত্যের পক্ষে, সুন্দরের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, ঐক্যের পক্ষে, হকের পক্ষে। একটা কনসেপ্ট মনে রাখতে হবে যে আমি মানব জাতির জন্য কী রেখে গেলাম। আমাদের গানের মধ্যে অশ্লীলতার বিপ্লব ঘটাবো না, বিপ্লব ঘটাবো ঐক্যের। এটাই হচ্ছে মো’মেনের কাজ।
পশ্চিমা ‘সভ্যতা’ মানুষকে শান্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তা নিজেই মৃত্যুর প্রহর গুনতেছে। পশ্চিমাদেরকে আর অনুসরণ করার কিছু নাই। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তারা ধর্মকে বাদ দিয়ে প্রতিটি মানুষকে ভোগবাদী বানিয়েছে। এখন তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কোনোমতে আর কয়দিন নিজেদের অন্তঃসারশূন্য ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু পারবে না। তাদের পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিণতিতে মাত্র ২৬ জনের হাতে দুনিয়ার চারশ কোটি মানুষের সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থা এখন ধ্বংস হবে।
কিন্তু আমরা কেন এই ধ্বংসযজ্ঞের নিচে চাপা পড়ব? আমাদের মুক্তির রাস্তা তো খোলা আছে। আমরা কেন দৌড়ে বের হচ্ছি না। আমাদের তো চাপা পড়ার দরকার নেই। শিক্ষিত সমাজ ধর্মকে ঘৃণা করছে, কিন্তু ধর্মের মধ্যেই মুক্তির পথ রয়েছে। তারা ঘৃণা না করে পারছে না কারণ মেয়েরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা হবে এটা কে মেনে নিবে? যেখানে মঙ্গল গ্রহে অভিযানে যাচ্ছে মেয়েরা সেখানে এই ফতোয়াবাজি চলে? আপাদমস্তক মেয়েদেরকে ঢেকে রাখতে বলছে, এমন কি মেয়েদের চোখের সামনেও কালো জালি দিয়ে দিয়েছে। নারীদের দৃষ্টিই যখন বন্ধ করে দিয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মঙ্গলগ্রহে যাওয়া তো দূরের কথা, দুনিয়া দেখার উপায়ই রইল না। ধর্মের নামে কতবড় ক্ষতিকর ষড়যন্ত্র যে তারা করেছে তা মানুষ বুঝেও না। এটা ধর্ম নয় – অধর্ম। এই অধর্মের বিনাশহেতুই শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ করেছেন, মোহাম্মদ (স.) যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের যুদ্ধ অন্যায় করার জন্য নয়, অন্যায় ধ্বংস করার জন্য, মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া জন্য। সেই যুদ্ধ এখন আমাদেরকেও করতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; facebook.com/riyad.hassan.ht, ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫]