রিয়াদুল হাসান:
ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষকে সম্পূর্ণরূপে পদানত করার জন্য যতগুলি ষড়যন্ত্র করেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন। তারা ঐ সময়ের সকল শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করে নতুনভাবে দুইটি ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল। এর একটি অংশ ধর্মীয় অংশ এবং অন্যটি সাধারণ শিক্ষা। এর মাধ্যমে মানুষকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে ফেলল। ১) ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি, ২) সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি এবং ৩) শিক্ষাবঞ্চিত শ্রেণি।
ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি:
উপমহাদেশের বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ১৭৮০ সনে ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করল। এই মাদ্রাসায় ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার জন্য খ্রিস্টান পন্ডিতরা বহু গবেষণা করে একটি নতুন ইসলাম দাঁড় করালেন যে ইসলামের বাহ্যিক দৃশ্য প্রকৃত ইসলামের মতোই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটার আকিদা এবং চলার পথ আল্লাহর রসুলের ইসলামের ঠিক বিপরীত।
এই শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাসে অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদির কোনো কিছুই রাখা হলো না, যেন মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে এসে আলেমদের রুজি-রোজগার করে খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য এই দীন, ধর্ম বিক্রি করে রোজগার করা ছাড়া আর কোনো পথ না থাকে। খ্রিস্টানরা এটা এই উদ্দেশ্যে করল যে তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষিত এই মানুষগুলো যাতে বাধ্য হয় দীন বিক্রি করে উপার্জন করতে এবং তাদের ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে বিকৃত ইসলামটা এই জনগোষ্ঠির মন-মগজে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। খ্রিস্টানরা তাদের এই পরিকল্পনায় শতভাগ সাফল্য লাভ করল। এই মাদ্রাসা প্রকল্পের মাধ্যমে দীনব্যবসা ব্যাপক বিস্তার লাভ করল এবং এর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যেও অন্যান্য ধর্মের মতো একটি স্বতন্ত্র পুরোহিত শ্রেণি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করল। তারা দীনের বহু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্ক-বাহাশ এবং ফলশ্র“তিতে বিভেদ-অনৈক্যের সৃষ্টি করতে থাকল, যার দরুন জাতি খ্রিস্টান প্রভুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলল। এই পুরোহিত শ্রেণির কর্মকাণ্ডের ফলে তাদেরকে অনুসরণকারী বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠির চরিত্র প্রকৃতপক্ষেই পরাধীন দাস জাতির চরিত্রে পরিণত হলো, কোনদিন তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চিন্তা করারও শক্তি রইল না। ফলে তারা চিরতরে নৈতিক মেরুদণ্ড হারিয়ে ফেলে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মুখাপেক্ষি হয়ে রইল।
এভাবেই খ্রিস্টান পন্ডিতরা নিজেরা অধ্যক্ষ থেকে ১৯২৭ সন পর্যন্ত ১৪৬ বছর ধরে এই মুসলিম জাতিকে এই বিকৃত ইসলাম শেখালো। অতপর তারা যখন নিশ্চিত হলো যে, তাদের তৈরি করা বিকৃত ইসলামটা তারা এ জাতির হাড়-মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং আর তারা কখনও এটা থেকে বের হতে পারবে না তখন তারা ১৯২৭ সনে তাদের আলীয়া মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষিত মওলানা শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন আহমেদ (এম.এ.আই.আই.এস) এর কাছে অধ্যক্ষ পদটি ছেড়ে দিলো, এর আগে পর্যন্ত মোট ৪৬ জন খ্রিস্টান পণ্ডিত এই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদে আসীন ছিল। (আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আঃ সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুণ, ইসলামী ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ, Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal” by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Faundation Bangladesh), মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ইতিহাস, মাওলানা মমতাজ উদ্দীন আহমদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি:
অপরদিকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত অংশটিতে এই বিরাট এলাকা শাসন করতে যে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের কেরাণীর কাজ করার জনশক্তি প্রয়োজন সেই উপযুক্ত জনশক্তি তৈরি করার বন্দোবস্ত করা হলো। তারা এতে ইংরেজি ভাষা, সুদভিত্তিক অংক, বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক, প্রযুক্তিবিদ্যা অর্থাৎ পার্থিব জীবনে যা যা প্রয়োজন হয় তা শেখানোর বন্দোবস্ত রাখল। এখানে আল্লাহ, রসুল, আখেরাত ও দীন সম্বন্ধে প্রায় কিছুই রাখা হলো না। ইসলামের গৌরবময় ইতিহাসের পরিবর্তে ইউরোপ-আমেরিকার রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস, তাদের শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনীই শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ফলে এই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণিটি মনে-প্রাণে প্রভুদের সম্বন্ধে একধরনের ভক্তি ও নিজেদের অতীত সম্বন্ধে হীনম্মন্যতায় ভুগতে লাগল। বাস্তবতা এমন দাঁড়াল যে তারা নিজেদের প্রপিতামহের নাম বলতে না পারলেও ইউরোপীয় শাসক, কবি, সাহিত্যিকদের তস্য-তস্য পিতাদের নামও মুখস্ত করে ফেলল। নিজেদের সোনালী অতীত ভুলে যাওয়ায় তাদের অস্থিমজ্জায় এটা প্রবেশ করল যে সর্বদিক দিয়ে প্রভুরাই শ্রেষ্ঠ।
শিক্ষাবঞ্চিত শ্রেণি:
এই দুই অংশের বাইরে বাকি ছিল উভয়প্রকার শিক্ষাবঞ্চিত এক বিশাল জনসংখ্যা। এখন যখন প্রভুদের এদেশ ছেড়ে যাবার সময় হলো তখন তারা কাদের হাতে শাসনভার ছেড়ে যাবে তা নিয়ে মোটেও তাদের চিন্তা করতে হলো না। একে তো মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটি শাসন করার যোগ্য নয়, এমনকি শাসন করার ব্যাপারে আগ্রহীও নয় (বর্তমানেও এদের উত্তরসূরিদের একটা অংশ তাই মনে করে। এরা মনে করে শাসন যে-ই করুক, আমরা ধর্ম-কর্ম করতে পারলেই চলবে), আর সাধারণ মূর্খ জনতার হাতে শাসনদণ্ড ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই অবশ্যই বাকি থাকে সাধারণ শিক্ষিত অংশটি। এদের হাতে শাসনভার ছেড়ে যাওয়ার লাভ বহুমুখী। একে তো তারা প্রভু বলতে অজ্ঞান, তাছাড়া প্রভুরা না থাকলেও তারা যে প্রভুদের স্বার্থই রক্ষা করে চলবে এ ব্যাপারে প্রভুরা একেবারেই নিশ্চিত ছিলেন।
এরাই যে প্রভুদের অনুপস্থিতিতে শাসনভার পাওয়ার অধিকারী এবং পাশ্চাত্য প্রভুরা আগে থেকেই তাদের জন্য এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করে তুলেছে তার একটি বড় প্রমাণ তাদেরকে অধিকার আদায়ের পথ শিক্ষা দেওয়ার নামে তাদের পছন্দসই রাজনীতি শিক্ষা দেওয়া। এই প্রভুদেরই একজন, এলান অক্টাভিয়ান হিউম (Allan Octavian Hume. 1829-1912) নামে কথিত ‘ভারতপ্রেমী’ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (Indian National Congress) নামে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে এদেশীয় শিক্ষিত শ্রেণিটিকে এদেশীয়দের অধিকার আদায়ের রাজনীতি শিক্ষা প্রদান করেন। অবাক করা ব্যাপার এই যে তিনি তাদের কাছে ‘ভারতপ্রেমী’ নামে পরিচিত। তারই শিক্ষায় শিক্ষিত এই রাজনীতিকরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রভুদের পছন্দসই রাজনীতি শিক্ষা লাভ করেছেন। বর্তমানে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের ঘৃণা কুড়ানো রাজনীতিকরা তাদেরই বর্তমান উত্তরসূরি।
কাল অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু আমাদের প্রতি প্রভুদের পূর্ব মানসিকতা এখনো যায় নি। আমাদের সম্পদ থেকে ভাগ নেওয়ার মানসিকতাও এখন পর্যন্ত তাদের দূর হয় নি। ঐ সময়ে নিয়েছে জোর করে আর এখন নেয় নেতা-নেত্রীদেরকে ক্ষমতা বসিয়ে দেওয়ার নামে আঁতাত করে। যারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারাই তাদের আনুকূল্য পায়। আর এই আনুকূল্যের রসদ হচ্ছে আমাদের নেতাদের বিভিন্ন দাসত্ব চুক্তি, দাসখত।