সম্প্রতি গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর শিক্ষাব্যবস্থায় ভুত আছে বলে মন্তব্য করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। এতদিন মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা অধিক জঙ্গি হতো তখন সর্বত্র মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার নিয়ে কথা উঠেছিল। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গেলে এক শ্রেণির আলেম ওলামা এর বিরুদ্ধে ভয়াবহ উথাল পাথাল জুড়ে দেয়। ফলে সংস্কার বা পরিবর্তনের আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক বিত্তবান পরিবারের সন্তানেরাও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। এখন আবার কথা উঠছে বাংলা ইংরেজি মিডিয়ামের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কোথায় কোথায় কী সমস্যা আছে সেটা তলিয়ে দেখতে হবে। এই গলদটি কোথায় তা চিহ্নিত করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা দুটো কী লক্ষ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।
ভারতবর্ষে বহু শতাব্দি ধরে মুসলিমরা শাসন পরিচালনা করে আসছিল যদিও সেটা খাঁটি ইসলামের রূপ বলা যাবে না। তবু ন্যায়বিচার, শান্তি, সুবিচার মোটামুটি ছিল। তখন হিন্দু-মুসলিম কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটত না, কিছু রাজনৈতিক লড়াই ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা বণিকের বেশে ভারতে প্রবেশ করে এবং ক্রমে তারা ছলে বলে কৌশলে এদেশের শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়।
আমাদেরকে পদানত করার পর চিরকালের জন্য গোলাম বানিয়ে রাখতে ব্রিটিশরা একটি চক্রান্ত করল। তারা দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল- একটি সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা, আরেকটি মাদ্রাসা শিক্ষা। এই দুটো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চিন্তা-চেতনায় মৌলিক ব্যবধান ও বৈপরীত্য রয়েছে। এখানেই তারা আমাদের জাতিটিকে মানসিকভাবে ও বাস্তবে বিভক্ত করে দিয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য কী ছিল তা আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ ইয়াকুব শরীফ “আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস” বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল। বাহ্যত এই প্রতিষ্ঠানের পত্তন করা হয়েছিল আলাদা জাতি হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্ত, যাতে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি ও আদর্শ রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।” এই যে ধোঁকাটা দিল, কী সে ধোঁকা? মারটা কোন জায়গায় দিল সেটা বুঝতে হবে। এখন ফলাফল দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমরা কোথায় ধোঁকাটা খেয়েছি।
ব্রিটিশ পণ্ডিতরা অনেক গবেষণা করে একটি বিকৃত ইসলাম তৈরি করল যা থেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনাকে (জেহাদ) বাদ দেওয়া হলো এবং ব্যক্তিগত জীবনের মাসলা-মাসায়েল, ফতোয়া, দোয়া-কালাম, মিলাদের উর্দু-ফার্সি পদ্য, বিশেষ করে দীনের যে বিষয়গুলো স¤পর্কে পূর্ব থেকেই বিভিন্ন মাজহাবের ফকীহদের মধ্যে বহু মতবিরোধ সঞ্চিত ছিল সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করলো যেন সেগুলো নিয়ে মাদ্রাসাশিক্ষিতরা তর্ক, বাহাস, মারামারিতে লিপ্ত থাকে। সেই ইসলামটিকে জাতির মনে-মগজে গেড়ে দেওয়ার জন্য বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ১৭৮০ সনে ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করল। সেখানে নিজেরা অধ্যক্ষ থেকে পর পর ২৬ জন খ্রিষ্টান (প্রথম খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ এ.এইচ. ¯িপ্রঙ্গার এম.এ. এবং শেষ খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ এ. এইচ. হার্টি এম.এ.) ১৯২৭ সন পর্যন্ত ১৪৬ বছর ধরে মুসলিম জাতিকে সেই বিকৃত ইসলামটি শেখাল। [দেখুন- আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আ. সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Foundation Bangladesh)]।
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদির কোনো কিছুই রাখা হলো না। ফলে আলেমরা বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন। কিন্তু জীবিকা ছাড়া তো মানুষ চলতে পারে না। তাই অগত্যা তারা ধর্মের বিভিন্ন কাজ করে রুজি-রোজগার করাকেই নিয়তি হিসাবে গ্রহণ করলেন। ব্রিটিশরা এটা এই উদ্দেশ্যে করল যেন তারা সর্বদা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে এবং মেরুদণ্ড সোজা করে কখনো তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে। ইংরেজরা তাদের এ পরিকল্পনায় শতভাগ সাফল্য লাভ করল। সেখান থেকে কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান নিয়ে লক্ষ লক্ষ আলেম বেরিয়ে আসছেন কিন্তু তাদেরকে জাতির ঐক্য গঠনের গুরুত্ব, জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা, সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের পরিণামে তাদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের অহঙ্কার যেমন সৃষ্টি হলো, পাশাপাশি তাদের হৃদয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গতিশীল ভূবন থেকে পিছিয়ে থাকার দরুন একপ্রকার হীনম্মন্যতাও সৃষ্টি হলো। তাদের অন্তর্মুখিতা, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে গোঁড়ামি, বিভক্তি, নিস্পৃহতা, অন্তর্মুখিতা, স্বার্থপরতা ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষের কারণ এই শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াতেই গ্রথিত রয়েছে। আলীয়া আর কওমী ধারার মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, একটি সরকারি অর্থায়নে চলে আরেকটি জনগণের দানের টাকায় চলে, একটি কম গোঁড়া, আরেকটি বেশি গোঁড়া- এই যা। এই যে বর্তমানে ইসলামের নামে অন্ধত্ব, অযৌক্তিক, কুসংস্কার বিস্তার লাভ করেছে, এটার বীজ এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াতেই প্রোথিত রয়েছে। সঠিক শিক্ষা না পেলেও ধর্মীয় চেতনা ঠিকই রয়ে গেছে। বর্তমানে মানবজাতির জীবনে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া জীবনব্যবস্থার ত্রুটির দরুন যে হাজারো বাস্তব সমস্যার প্রাদূর্ভাব হয়েছে সেগুলোর সমাধান ঐ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী, বিজ্ঞানভিত্তিক, যৌক্তিকভাবে উল্লেখিত না থাকায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ইসলামিক রাজনীতির নামে, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জেহাদের নামে মাদ্রসা ছাত্রদের ঈমানী চেতনাকে নিজেদের মতবাদের অনুকূলে টেনে নিচ্ছে। কেউ অপরাজনীতিতে তাদের ব্যবহার করছে কেউ জঙ্গিবাদে কাজে লাগাচ্ছে – সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সে কিন্তু ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাটি পেল না। এই শূন্যতাটাই পূর্ণ করে দিচ্ছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো। এখানেই মাদ্রাসা শিক্ষার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় (General Education System) দীন সম্পর্কে প্রায় কিছুই শিক্ষা দেওয়া হয় নি। বরং সুদভিত্তিক অংক, ব্রিটিশ রাজা- রানির ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত, পাশ্চাত্যের ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শন ইত্যাদি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম সম্পর্কে, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিদ্বেষভাব (A hostile attitude) শিক্ষার্থীদের মনে প্রবেশ করানো হলো। ওখান থেকে লক্ষ লক্ষ কথিত আধুনিক শিক্ষিত লোক বের হচ্ছেন যারা চরম আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। নিজেদের বৈষয়িক উন্নতি ছাড়া আর কিছুই তারা ভাবেন না। তারা অধিকাংশই ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মকে মনে করেন সেকেলে, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা; ধর্মকে মনে করেন কল্পকাহিনী। তাদের দৃষ্টিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে ধর্ম অচল। তাদেরকে শেখানো হলো আধুনিক সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পশ্চিমাদের উদ্ভাবন। কিন্তু এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তি যে মুসলিমরাই নির্মাণ করেছিল সেটা তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হলো না। এদের মধ্যে অনেকেই আছে প্রচণ্ড ধর্মবিদ্বেষী অথচ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাদের জন্ম।
কিন্তু এই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে কিন্তু ধর্মবিশ্বাস লুপ্ত হয় নি। তারাও সমানভাবে পাশ্চাত্যের জীবনব্যবস্থার সমস্যাগুলো প্রত্যক্ষ করছে। তখন একটি গোষ্ঠী তাদের সামনে এ সকল সমস্যার সমাধান হিসাবে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থারূপে ইসলামকে তুলে ধরছে এবং তাদের নিজেদের মনমত ব্যাখ্যা তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করাচ্ছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাটি থাকতো তাহলে কেউ এভাবে তাদেরকে ভ্রান্তপথে নিয়ে যেতে পারত না। ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষব্যবস্থায় ধর্মের অনুপস্থিতি এই সংকট সৃষ্টির অন্যতম নায়ক।
উভয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষিতজনেরা একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুড়িতে লিপ্ত থাকেন, দিনকে দিন তাদের মধ্যে বিরাজিত বিদ্বেষ, অবিশ্বাসের ব্যবধান সরু নালা থেকে সাগরে পরিণত হচ্ছে। যেখানে এত বড় সঙ্কটে জাতি আজ নিমজ্জমান, তখন এরা উভয়েই দাম্ভিক আর অহঙ্কারী হয়ে একে অপরের ছিদ্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্ররা যখন জঙ্গিবাদী হামলা চালাচ্ছে তখন মাদ্রাসা শিক্ষিতরা আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে বলছেন, এই হামলা যদি মাদ্রাসার ছেলেরা চালাতো তাহলে কেমন হতো? আবার কলেজ ভার্সিটি থেকে শিক্ষিতরা যখন দেখেন যে জঙ্গি হামলাকারীরা কোনো মাদ্রাসার ছাত্র তখনই তারা খুব সহজেই পূর্বধারণার ছকটি ইসলামের উপর বসিয়ে দেন। এই যে দ্বন্দ্ব এর মূল কারণ এই দ্বিধাগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা।
কাজেই এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব করা যেতে পারে, যেখানে আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় থাকবে। শুধু ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষা দিয়ে হবে না। মানুষের দেহ যেমন আছে তেমনি আত্মা তথা বিবেকও আছে। সে বিবেকের দাবি পূরণ করার জন্য বিভিন্নভাবে এদিক ওদিক যেতে চাইবে। আবার বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে কেবল মাসলা-মাসায়েল, দোয়া কালাম, ফতোয়াবজির ইসলাম যা কেবল পরকালীন সওয়াবমুখী, সেটা দিয়েও হবে না। প্রস্তাবিত এই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছাত্ররা এমন মানুষ হয়ে বের হবে যারা ধর্মান্ধ নয়, ধর্মবিদ্বেষী নয়, যারা প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবোধসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, রুচিশীল, মার্জিত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, জাগ্রতবিবেক, স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন। তারা স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, দাম্ভিক, অহঙ্কারী না হয়ে বিনীত ও নম্র হবে, মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হবে। প্রতিটি মানুষ হবে আলোকিত, সত্য ও ন্যায়ের ধারক। মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ তারা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করবে না। এমন মানুষ তৈরি করতে পারে একটি ভারসাম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। এ ছাড়া চলমান অবক্ষয়ের কোনো সমাধান নেই।