রিয়াদুল হাসান:
শহিদ সাইফুল্লাহ হেযবুত তওহীদের ইতিহাসে এক মাইলফলকের নাম। সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বে সত্যের জন্য কিছু মানুষকে নিজেদের প্রাণসহ সমস্ত কিছুই কোরবানি দিতে হয়; ঠিক যেভাবে একটি ইমারত গড়ে তোলার জন্য কিছু ইটকে ভিত্তি হয়ে চিরকালের জন্য মাটির নিচে আশ্রয় নিতে হয়। আল্লাহ সত্যসহ নবী ও রসুলগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা যখন সেই ‘সত্য’ কালাম তথা তওহীদের ডাক মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন যাদের কায়েমী স্বার্থে ও প্রাচীন বিশ্বাসে আঘাত লেগেছে তারা সেই নবী-রসুলদের মুখ বন্ধ করার জন্য তাঁদেরকে হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। অগণিত নবী-রসুল এই কাফের, সত্য-প্রত্যাখ্যানকারীদের দ্বারা শহিদ হয়েছেন। সেই সঙ্গে শহিদ হয়েছেন তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারীগণও। আল্লাহ বলেন, এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহিদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না (সুরা ইমরান ৩:১৪০)।
সময়ের কাঁটা ঘুরে এখন আখেরি যুগে উপনীত হয়েছে। ১৩ শ’ বছর ধরে বাড়াবাড়ি আর অতি-বিশ্লেষণ করে রসুলাল্লাহর রেখে যাওয়া সহজ সরল দীনকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। ইসলাম বন্দী হয়েছে ধর্মব্যবসায়ী চক্রের হাতে। দীনের সুফল থেকে বঞ্চিত মানুষ এখন পাশ্চাত্যের তৈরি বস্তুবাদী আত্মাহীন আল্লাহহীন সভ্যতার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত। দুর্বলের উপর চলছে সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা। সবুজ পৃথিবী রক্তে প্লাবিত। প্রতিটি হৃদয় স্বার্থপরতায় অন্ধ। প্রতিটি মানুষ অধিকারহারা অতৃপ্ত। সর্ব প্রকার অপরাধ তুঙ্গ স্পর্শ করছে। প্রতিটি মানুষ ভীত, শঙ্কিত। নারীরা লাঞ্ছিত অপমানিত। কোটি কোটি নর-নারী উদ্বাস্তু। কোটি কোটি শিশু অনাহারক্লিষ্ট। মানবজাতি দুর্বত্তের হাতে বন্দী। পৃথিবীর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে মানুষ, সে এখন কেবল তার কর্মের পরিণতি চাক্ষুষ করার অপেক্ষা করে যাচ্ছে। সেই পরিণতি হচ্ছে মহাবিধ্বংস। পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের পারমাণবিক বোমা নিয়ে বসে আছে সেই ধ্বংসের সাধনের জন্য। এ অবস্থায় যদি মানবজাতির অস্তিত্বকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হয়, এবং তাদেরকে ন্যায়পূর্ণ শান্তিপূর্ণ একটি জীবনপদ্ধতি উপহার দিতে হয় সেটার ক্ষমতা আর মানুষের হাতে নেই। এটা করতে হলে স্বয়ং স্রষ্টাকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
স্রষ্টা কিন্তু স্বয়ং কিছু করেন না, তিনি তাঁর প্রতিভূ মানুষকে দিয়ে করান। তিনি সত্য প্রেরণ করেন। সেই সত্য মহাশক্তিশালী। সকল অনিয়মকে নিয়মে আনার জন্য সেই সত্য তিনি প্রেরণ করেন মানুষের কাছে। যারা সেটিকে আলিঙ্গন করে নেয় তারা হয় মো’মেন। আখেরি নবী চলে গেছেন ১৪শ’ বছর আগে। রেসালাত ও নব্যুয়তের দুয়ার বন্ধ। কিন্তু সত্যের দুয়ার আল্লাহ বন্ধ করেননি। তিনি মানবজাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাঁরই একনিষ্ঠ এক বান্দাকে সত্যের বোধ দান করলেন, সত্যটি উপলব্ধি করালেন। তিনি আর কেউ নন, হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী জমিদার পরিবারের উত্তরসূরি এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তাঁর থেকে আবার সেই মহাসত্যের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, যে সত্য মানবজাতিকে ত্রাণ করতে পারে। সেই আলোয় স্লান করে কিছু মানুষ নিজেদেরকে আলোকিত করল, তারা সাক্ষ্য দিল- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। তারপর বেরিয়ে পড়ল সত্য প্রচারের বেপরোয়া অঙ্গীকার নিয়ে। শহিদ সাইফুল্লাহ ছিলেন এদেরই একজন।
পূর্ব থেকে চলে আসার বিকৃত ধর্মের ধ্বজাধারীরা তাদের সহিংস অনুসারীদের নিয়ে হেযবুত তওহীদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করল বাংলাদেশ জুড়ে। তারা আক্রমণ করতে লাগল তওহীদের আহ্বানকারীদের, কখনও সংঘবদ্ধভাবে, কখনও অতর্কিতে। পুরোহিত শ্রেণি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গর্জন তুলল ফতোয়ার। অনিরাপদ হয়ে পড়ল হেযবুত তওহীদের সদস্যদের জীবনযাত্রা। আজ এখানে হামলা, কাল ওখানে বাড়িঘর ভস্মীভূত। মাননীয় এমামুয্যামানের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত তাঁর আত্মার সন্তানেরা কেউ দমবার পাত্র নয়। তারা শহিদ হওয়ার বাসনা নিয়েই সত্য প্রচারে নিয়োজিত থাকলেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তারা আল্লাহর কাছে শাহাদাতের প্রত্যাশা জানিয়ে দোয়া করতেন। মাননীয় এমামুয্যামান প্রায়ই বলতেন, হেযবুত তওহীদের সদস্যদের মধ্যে কে প্রথম শহিদ হবে, কে হবে সেই সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী? এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন শহিদ সাইফুল্লাহ। তিনি শেষ যুগে যখন সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেই সত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম সাক্ষী হিসাবে অনাগত ইতিহাসের পাতায় নিজের নামটি তিনি রক্তের অক্ষরে লিখে দিলেন।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ৫ মে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ। প্রকৃত ইসলামের ডাক শিরোনামের একটি প্রচারপত্র নিয়ে মাদারীপুরের কালকিনি থানার অন্তর্গত ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ডে যান শহিদ সাইফুল্লাহ। সঙ্গে আরো কয়েকজন সদস্য। বেশকিছু দোকানপাট গড়ে উঠে জায়গাটি একটি বাজারের রূপ নিয়েছে। গ্রাম থেকে লোকজন এসেছে প্রয়োজনীয় সদাই নিতে। তাদেরকে বলতে লাগলেন প্রকৃত ইসলাম ও প্রচলিত ইসলামের পার্থক্য। তারা কি জানতেন ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ডেই ঘাপটি মেরে ছিল ইবলিশ শয়তান?
একজন ধর্মান্ধ ষণ্ডা প্রকৃতির মানুষ সত্যের প্রচারে বাধ সাধল। সে একটি লিফলেট নিয়ে মানুষকে ভুল বোঝাতে শুরু করল। বোঝালো যে এই লোকগুলো খ্রিষ্টান, তারা ইহুদির দালাল। তারা ইসলামের শত্রু। এদেরকে মেরে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তাদের ঈমানী দায়িত্ব। ইবলিশ তার ঈমানী দায়িত্ব পালনে শয়তানদের খুঁজে নিল। তারা হামলে পড়ল হেযবুত তওহীদের গুটিকয় সদস্যের উপর। ধর্মীয় উন্মাদনা দাবানল হয়ে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে। শত শত মানুষ এসে পৈশাচিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের উপর যারা মুক্তির বার্তা নিয়ে তাদের দুয়ারে কড়া নাড়তে গিয়েছিল। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন আত্মরক্ষার, চেষ্টা করলেন মীমাংসার, চেষ্টা করলেন ফিরে যাবার। তাদের মোকাবেলার সামনে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছিল বিশৃঙ্খল হামলাকারীরা। মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। এই অসম সংঘর্ষে মো’মেনদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাইফুল্লাহ। তাঁর মাথা ভেঙে ফেলার জন্য বার বার হামলাকারীরা বাঁশ দিয়ে মারছিল। তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। এ অবস্থায় সঙ্গীরা তাঁকে বহন করে মহাসড়ক ধরে নিজ এলাকার দিকে কিছু পথ এগিয়ে গিয়েছিলেন। দফায় দফায় হামলা চালাচ্ছিল ধর্মোন্মাদ নরপশুরা। তারা আবারও শক্তি সংগ্রহ করে হেযবুত তওহীদের আহত রক্তাক্ত সদস্যদের ঘিরে ফেলল। এমনই এক মুহূর্তে আল্লাহ চাইলেন শহিদ সাইফুল্লাহকে তাঁর নিজের সান্নিধ্যে তুলে নিতে। জ্ঞান ফিরে এলো সাইফুল্লাহর। তিনি পুনরায় রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হলেন, এবার অন্য এক মূর্তি নিয়ে। হামলাকারীদের উপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁর হৃদয়ে তখন শাহাদাতের জন্য একবুক পিপাসা। প্রতিরোধের এক পর্যায়ে তিনি আবারও শত্রুপরিবেষ্টিত হয়ে পড়লেন। তাকে বিচ্ছিন্ন করে ভয়ানকভাবে প্রহার করতে লাগল হায়েনার দল। একে একে অন্যরাও সংজ্ঞা হারিয়ে মহাসড়কের উপর পড়ে যেতে থাকলেন। তাদের নিষ্প্রাণ নিস্পন্দ দেহগুলোকে ফেলে রেখে একসময় বিদায় নিল হায়েনারা। তওহীদের ঘোষণা প্রদান করতে করতে শহিদ সাইফুল্লাহর দেহ থেকে আত্মা পৃথক হয়ে গেল।
শহিদ মানে অমর। শহিদদের মৃত বলতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তাঁদের এই অমরত্বের একটি কারণ তারা সময়ের শেষ অবধি সত্য প্রতিষ্ঠাকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকেন। শহিদ সাইফুল্লাহর পরে আরো অনেকেই ইবলিসের দোসর ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেছেন। কিন্তু প্রথম শহিদ তো একজনই হতে পারেন। শাহাদাত বরণের ১৯তম বর্ষপূর্তিতে শহিদ সাইফুল্লাহর পবিত্র আত্মার উদ্দেশে আমাদের শত সহস্র সালাম।
লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।