একই তো পৃথিবী, একটাই মানবজাতি। কিন্তু কোথাও দেখি আদিগন্ত জনহীন প্রান্তর আবার কোথাও কাঁটাতারের সীমানায় বন্দী লক্ষ লক্ষ মানুষ; পা রাখবার জায়গাটি নেই। সেখানে অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই। মানুষ পশুর জীবন কাটায়। তবে কি পৃথিবীর আয়তন এর জনসংখ্যার তুলনায় অপর্যাপ্ত, নাকি মানুষই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এই দমবন্ধ করা অবিচার সৃষ্টি করেছে?
হ্যাঁ। এই অবিচারের অপর নাম ভৌগোলিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ১৯৩টি রাষ্ট্র জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আর দুটো আছে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র যাদের স্ট্যাটাস হচ্ছে হড়হ-সবসনবৎ ড়নংবৎাবৎ ংঃধঃব যার একটি হচ্ছে ক্যাথেলিক খ্রিষ্টানদের তীর্থস্থান ভ্যাটিক্যান সিটি, আরেকটি ফিলিস্তিন যেখানে আরব মুসলিমদের একাংশ বাস করে। আমাদের প্রসঙ্গ হচ্ছে ফিলিস্তিন, যাকে ১৯৮৮ সনে পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দেন। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১৩৮টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি (উরঢ়ষড়সধঃরপ ৎবপড়মহরঃরড়হ)প্রদান করেছে, এবং ইউরোপের আরও চারটি দেশ স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত একে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং ১৯১৭ সনের বেলফোর ডিক্লেয়ারেশনের মাধ্যমে ১৯৪৮ সনে সৃষ্টি হওয়া ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোড়া থেকেই ‘নিগূঢ় বন্ধুত্ব’ রক্ষা করে আসছে। কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অবৈধ আগ্রাসন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কাজেই ইসরাইলের সঙ্গ ত্যাগ করেনি মানিকজোড় যুক্তরাষ্ট্র।
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকা। এখানে ১৯৩০’র দশকে পোল্যান্ড থেকে উৎখাত হয়ে আসা ইহুদীরা কৃষি খামার গড়ে তুলেছিল। ইহুদিদের পাশেই ছিল ফিলিস্তিনী আরবদের বসবাস। সেখানে আরবদের কৃষি খামার ছিল। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছিল। সে সময় মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৯৩০’র দশকে ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারলো, তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে-দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় সাত লাখের মতো ফিলিস্তিনী বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারা ভেবেছিল দ্রুত সমস্যার প্রথম পৃষ্ঠার পর:
সমাধান হলে তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু ইসরায়েল তাদের আর কখনোই বাড়িতে ফিরতে দেয়নি।
দুই হাজার বছর আগে ঈসা (আ.) কর্তৃক ইহুদি জাতিকে অভিশাপ দেওয়ার কিছুদিন পর ৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইহুদি জাতির উপর রোমান সাম্রাজ্যে নির্যাতন আরম্ভ হয়। কারণ খ্রিষ্টান যাজকরা যিশুকে হত্যার জন্য ইহুদি জনগণকে সম্মিলিতভাবে দায়ী করেছিল, যদিও এর দায় ছিল একান্তভাবে ইহুদি ধর্মব্যবসায়ী রাব্বাই-সাদ্দুসাইদের। বোস্টন কলেজ গাইড টু প্যাশন প্লেস-এ যেমন বলা হয়েছে, “সময়ের সাথে সাথে খ্রিষ্টানরা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে সকল ইহুদিই যীশুকে হত্যার জন্য দায়ী। কারণ তারা যীশু খ্রিষ্টের মৃত্যুতে উপস্থিত ছিল। সুতরাং ইহুদি জনগণ সম্মিলিতভাবে এবং সর্বকালের জন্য ‘ঈশ্বর-হত্যা’র পাপ করেছে। ১৯০০ বছরের জুডিও-খ্রিষ্টান ইতিহাসে এই ‘ঈশ্বরহত্যা’র অভিযোগ ইউরোপ ও আমেরিকার খ্রিষ্টানদেরকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, সহিংসতা এবং হত্যার দিকে পরিচালিত করেছে।”
৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সেনাপতি টিটাস ইহুদিদের আক্রমণ করে তাদের পাইকারি ভাবে হত্যা করল, তাদের মেয়েদের নিয়ে গেল, ধন-সম্পত্তি সব লুটে নিল, ইহুদিদের ডেভিড মন্দির (ঞবসঢ়ষব ড়ভ উধারফ) সহ তাদের রাজধানী জেরুজালেম শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল এবং তারপর সমস্ত সিরিয়া থেকে সমস্ত জাতিটাকে সমূলে উচ্ছেদ করে দিল। হাজার হাজার বছরের বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়ে ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিল। সেই ৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় দুই হাজার বছর এই ইহুদি জাতির ইতিহাস কি? তাদের ইতিহাস হচ্ছে এই যে আল্লাহর লা’নতের ফলে ইউরোপের যে দেশেই তারা আশ্রয় নিয়েছে, বসতি স্থাপন করেছে, সেই দেশের সমস্ত মানুষ তাদের অবজ্ঞা করেছে, ঘৃণা করেছে। শুকর যেমন আমরা ঘৃণা করি- তেমনি ঘৃণা করেছে। শুধু ঘৃণা করেই তারা ¶ান্ত হয় নি। মাঝে মাঝেই ইউরোপের খ্রিষ্টানরা দলবদ্ধ হয়ে ইহুদিদের বসতি আক্রমণ করে তাদের পুরুষদের হত্যা করে মেয়েদের বেঁধে নিয়ে গেছে, সম্পত্তি লুটপাট করে বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই কাজটা ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা প্রতিটি ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রে এতবার করেছে যে ইউরোপীয় ভাষায় একে বোঝাবার জন্য একটি নতুন শব্দেরই সৃষ্টি হয়েছে। সেটা চড়মৎড়স, যার আভিধানিক অর্থ হলো ঙৎমধহরুবফ করষষরহম ধহফ চষঁহফবৎ ড়ভ ধ ঈড়সসঁহরঃু ড়ভ চবড়ঢ়ষব, বাংলায় “সুসংগঠিত ভাবে সম্প্রদায় বিশেষকে হত্যা ও লুণ্ঠন।” দু’হাজার বছর ধরে অভিশপ্ত ইহুদিদের উপর ঐ চড়মৎড়স চালাবার পর শেষ চড়মৎড়স আল্লাহ করালেন হিটলারকে দিয়ে। তাকে দিয়ে তিনি ইউরোপের ইহুদিদের উপর চরম অত্যাচার করালেন ও ৬০ ল¶ ইহুদি হত্যা করালেন।
এখন মনে হয় আল্লাহ তাদের উপর থেকে লা’নত উঠিয়ে নিয়েছেন। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তাদের উপর আর চড়মৎড়স হচ্ছে না এবং তারা বর্তমানে একটি শক্তিশালী ও সম্মানিত জাতি। তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রাচীন বাসভূমি জেরুজালেমের নিকটে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র লাভ করার পর থেকে ফিলিস্তিনি আরবদের উপর যেন ‘অভিশাপ’ হিসাবে আপতিত হল। বাকি দুনিয়া থেকে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিনিদেরকে উৎখাত করে তাদের জায়গা জমি দখল করে নিচ্ছে। তাদেরকে এই কাজে মদদ যুগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জনসংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ ৬ হাজার আর বর্তমানে ৯৭ লাখ। এ সময়ে তারা ১৪,০০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি জমি দখল করেছে। এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের পারস্পরিক হামলায় কত নিরপরাধ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধের প্রাণ গেছে, কত মানুষ আহত ও উদ্বাস্তু হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে এটি একটি যুদ্ধের জনপদ যেখানে বাতাসে মিশে আছে বারুদ আর লাশের গন্ধ।
এবার দেখা যাক ফিলিস্তিনি মুসলমানদের নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও দেশের নাগরিকদের কী প্রতিক্রিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ (মোট ১৮টির মধ্যে ১৩টি) আরব বিশ্বের অংশ। আরব দেশগুলো বাকি পৃথিবীতে ইসলামের ধ্বজা বহনকারী। আরবীয় পোশাক-আশাক, ভাষা সংস্কৃতি থেকে শুরু করে খোরমা খেজুর পর্যন্ত সবকিছুকেই ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করা হয়। কিন্তু তারা বাকি দুনিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপদে কতটুকু সাড়া দিয়েছে অতীতে? মায়ানমার থেকে যখন দশ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে মেরে কেটে বৌদ্ধ রাখাইন সন্ত্রাসীরা উৎখাত করে দেয়, তারা অকূল সমুদ্রে ভাসতে থাকে। মক্কা-মদীনার খাদেম, মুসলিমদের হজের আমির আরব শেখরা কি একজন রোহিঙ্গা মুসলিমকেও আশ্রয় দিয়েছিল? দেয়নি। বিগত ৭৫ বছর ধরে মার খেতে খেতে ফিলিস্তিনের মুসলিমরা আজ যখন একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে তখনও আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তারা বলেনি যে আমার আরব ভাই, আমার মুসলিম ভাই- তোমরা ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাদের সঙ্গে থেকে তোমাদের মানবাধিকার ও ভূখণ্ডের জন্য লড়াই করব। তারা কথা বলছে কূটনীতির ভাষায়। সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করার এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলার আহ্বান দায়িত্ব পূর্ণ করেছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর সহিংসতার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে মিশর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যতটা সম্ভব সংযত থাকা এবং বেসামরিক মানুষদের আরও বিপদের মধ্যে ঠেলে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ানও সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন। তুরস্কের মতো একই আহ্বান জানিয়েছে কাতারও। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে তোলার জন্য ইসরায়েলকেই এককভাবে দায়ী করেছে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সংঘাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কুয়েত। যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলকে দোষারোপ করেছে দেশটি। কথিত মুসলিম ভাই হিসাবে প্রতিবেশী আরব দেশগুলো যখন এসব আহ্বান, নিন্দা, নৈতিক সমর্থন জানিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে, তখন ইসরাইলের সহায়তায় বিমানবাহী রণতরী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একইভাবে যখন ইউক্রেন আক্রান্ত হয় তখন তার পাশে রণশক্তি নিয়ে এসে দাঁড়ায় ইসরাইল। কারণ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একজন ইহুদি। তারা প্রত্যেক নির্যাতিত ইহুদিকে ইসরাইলে আমন্ত্রণ জানায়। রাশিয়ার হামলার পর দেশ ছেড়ে ৯০ শিশুসহ ৪০০ ইহুদির ইসরাইলে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি সারা বিশ্বে প্রচার পেয়েছিল। কিন্তু আরব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে অসম্ভব ধনী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমদের পাশে কখনও দাঁড়াতে দেখা যায় নি। বর্তমানে বিশ্বের প্রধান অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যতম প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক দেশ সৌদি আরব ও কাতার। কিন্তু তাদের অস্ত্র সর্বদাই ব্যবহৃত হয় তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তারা মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কথা মুখে বললেও বাস্তবে সবাইকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, তারা মিত্র ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে নানা বাণিজ্যিক, সামরিক, কূটনৈতিক চুক্তিতে বন্দী। যদি ফিলিস্তিন নামক এলাকাটি বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছেও যায়, যদি সমস্ত ফিলিস্তিনি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তবু আরব রাষ্ট্রগুলো পাশ্চাত্যের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তাদের চুক্তির ‘অমর্যাদা’ করবে না। কারণ মুসলমানের এক জবান। তাছাড়া ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তারা দেখেন না, বরং তাদের অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত। ১৯৬৭ সালে সংঘটিত আরব ইসরাইল যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান সম্মিলিতভাবেও ইসরাইলকে পরাজিত করতে পারে নি, বরং নিজেরাই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল, সাথে হাজার হাজার নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। যুদ্ধের পরিণতিতে মাত্র ছয়দিনের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক মানচিত্র পাল্টে যায়। ইসরায়েলের দেশের আকার ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরাজিত শক্তি মিশরের কাছ থেকে গাজা ভূখণ্ড ও সিনাই উপদ্বীপ, জর্দানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেম সহ পশ্চিম তীর ও সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমির অধিকার পেয়ে যায় ইসরাইল।
এ তো গেল মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোর অক্ষমতার গল্প। এবার আসুন দেখি মুসলিম নাগরিকদের কী প্রতিক্রিয়া। ইসলামের শিক্ষা হল, সকল মোমেন ভাই-ভাই (সুরা হুজরাত ১০)। সমগ্র মুসলিম একটি দেহের ন্যায়। এর একটি অঙ্গে আঘাত পেলে সমগ্র শরীরই অসুস্থ হয় (মুসলিম)। এই বিশ্বভ্রাতৃত্বের একটি বোধ সকল মুসলিমের মধ্যে অনেকাংশে হ্রাস পেলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। তাই যখনই ফিলিস্তিনে বা বিশ্বের অন্য কোনো অংশে মুসলিমদের উপর কোনো আঘাত আসে মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের প্রতি সমবেদনায় আক্রান্ত হয়, তারা আহাজারি করতে থাকে। আর নির্যাতনকারীদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে, তাদের পরাজয় কামনা করে। কোথাও মুসলিমদের জয়ের ছিটেফোঁটা ঘটনা ঘটলেও তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আলহামদুল্লিাহ বলে, হাততালি দেয়। গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে হামাসের হামলায় ইসরাইলের ১২০০ নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় ফেসবুকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম উল্লাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর পরে কী ঘটতে চলেছে সেটা নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা দেখা যায়নি। ঘটনার পর থেকেই শুরু হয় ইসরাইলের লাগাতার বিমান হামলা। পাঁচ দিনের মধ্যে পুরো গাজাকে ধ্বংসের জনপদে পরিণত করে ইসরাইল। ধসে পড়েছে অসংখ্য ভবন। দেখা দিয়েছে খাবারের চরম সংকট। অনেক জায়গায় নেই বিদ্যুৎ। সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন গাজাবাসী। গত ছয় মাসে প্রায় ৩৩ হাজার ৯১ জন বেসামরিক সাধারণ ফিলিস্তিনি মুসলমানকে হত্যা করেছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। হামলায় আহত হয়েছে ৭৫ হাজার ৮১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশই নিরপরাধ শিশু ও নারী।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ইসরাইলের হামলায় গাজায় ১৭ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তবে কি হামাসের এই হামলা করা ভুল ছিল? আসলে ফিলিস্তিনের মুসলমানেরা যে ভয়াবহ দুর্দশা নিয়ে বেঁচে আছেন, তারা এখন মরিয়া হয়েই এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারাগারের নিষ্ঠুর নিপীড়নের শিকার বন্দীদেরকেও একটা সময় কারা বিদ্রোহ করতে দেখা যায়। গাজা তো একটা বড় কারাগার বৈ কিছু নয়।
প্রশ্ন হল, সেদিন যারা হামাসের হামলার পর হাততালি দিলেন, আলহামদুলিল্লাহ বললেন, তারা এখন কী মন্তব্য করবেন? এখন তো তারা ইন্নালিল্লাহ পড়বেন। হ্যাঁ, তারা আসলে এর বেশি কিছুই করার ক্ষমতা রাখেন না। তারা দুঃখ পেতে পারেন, আহাজারি করতে পারেন, ওয়াজে খোতবায় বিক্ষোভ মিছিলে গর্জন ও শ্লোগান দিতে পারেন, কিন্তু ইসরাইলের একটা কেশাগ্র স্পর্শও করার ক্ষমতা তারা রাখেন না। তাদের এই অক্ষমতার কারণ ভৌগোলিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, জাতিরাষ্ট্র বা নেশন স্টেট। কথা ছিল বিশ্বের মুসলিম হবে এক জাতি, এক দেহের ন্যায়। তাদের নেতা হবে একজন। সেই নেতার আদেশে তারা সমগ্র পৃথিবীতে লড়াই করে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র মানবজাতির জীবনে শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে। আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে রসুলাল্লাহর হাতে গড়া সেই ক্ষুদ্র জাতি অর্ধ দুনিয়ায় সেই অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ছিল দুর্ধর্ষ অপরাজেয় যোদ্ধাজাতি। তাদের সামনে চোখ তুলে তাকানোর কোনো হিম্মৎ কারো ছিল না। একই সাথে দু’দুটো পরাশক্তিকে তারা সামরিক শক্তিবলে পরাভূত করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন। পক্ষান্তরে আজ এই পৃথিবীর ১৮০ কোটি মুসলমান ৫৬ টি পৃথক পৃথক জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত। তাদের অন্তর্গত ফেরকা মাজহাবের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ৫৬টি দেশে পৃথক সরকার আছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ফিলিস্তিনে বা মায়ানমারে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে যতই ক্ষুব্ধ হোক রাষ্ট্র চলে তারা নিজস্ব নীতি দিয়ে। রাষ্ট্র আইনের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে জনগণকে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেয়। বাড়াবাড়ি করলে লাঠিচার্জ, জলকামান, টিয়ারশেল মজুদ আছে। তাই নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য অন্যান্য দেশের মুসলমানদের আদতে কিছুই করার নেই। তাদের চোখের সামনেই ইরাক ধ্বংস হয়েছে, আফগানিস্তান ধ্বংস হয়েছে, সিরিয়া ধ্বংস হয়েছে, কোটি কোটি মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে, আর তারা হায় হায় করেছেন, বুক চাপড়েছেন, তাদের ওয়াজকারীরা গর্জন করেছেন কিন্তু অসারের গর্জনই সার, তাতে বর্ষণ হয়নি। কারণ তারা সবাই পাশ্চাত্যের দেখানো ভৌগোলিক সীমারেখা চিহ্নিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন বহু আগেই। এখন তাদের যাবতীয় কান্নাকাটি, সমবেদনা ও আস্ফালন কাঁটাতারের বেষ্টনির ভিতরে।
এখন তাহলে উপায় কী?
প্রথম কথা হলো, নিজেদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আগে সচেতন হতে হবে। কেন আমাদের এই অবস্থা সেটা জানতে হবে। জানতে হবে আল্লাহর রসুল আমাদের জাতিটিকে কী অবস্থায় রেখে গেছেন। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে রসুলাল্লাহর সেই ইসলাম যা আমাদেরকে বিশ্বের সেরা জাতিতে পরিণত করেছিল, আর আজকে আমরা যেটা মেনে সকল জাতির হাতে মার খাচ্ছি, এটা সেই ইসলাম নয়। আজ আমরা আমাদের উদ্দেশ্য ভুলেছি, সংগ্রাম ভুলেছি। আমরা হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়েছি। এখন দুর্বলরা সবলের মার খাবে এটাই তো প্রকৃতির বিধান। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে ইহুদিরা যেমন নিশ্চিহ্ন হতে হতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, জাতির সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তি অর্জন করেছে, আমাদেরকেও এই প্রাকৃতিক নিয়মই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যথায় এই মার, এই পরাজয়, এই দুর্গতি চলছে – চলবে।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]