রিয়াদুল হাসান:
কখনও তথাকথিত গণতান্ত্রিক সিস্টেমের ধারবাহিকতা রক্ষায় আবার কখনও সংবিধানের বাধ্য-বাধকতায় গত কয়েক দশক ধোরে আমাদের দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চোলছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নির্বাচন সরকারের জন্য বিরাট ব্যয়বহুল একটি কর্মকাণ্ড। গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে এটাই নিয়ম। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলে অঢেল অর্থব্যয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়- সাম্প্রতিক জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বাবদ রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাবদ নির্ধারিত ছিল ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন সাংসদ বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় প্রায় অর্ধেক খরচ লাঘব হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থসহ নির্বাচন কমিশন তাদের হাতে থাকা সম্পূর্ণ অর্থই উপজেলা নির্বাচনে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে গত তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় এবারের চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে বহুগুণ বেশি। নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির পেছনে ভর্তুকী পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ, ক্ষেত্রবিশেষে বহুগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি প্রার্থীর নিজস্ব প্রচার প্রচারণার জন্য ব্যয়কৃত কোটি কোটি টাকা হিসাবের মধ্যে আনলে দেখা যাবে একেকটি নির্বাচনের পেছনে আমরা পাহাড় পরিমাণ অর্থ ব্যয় কোরছি যা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের জন্য বড়ই করুণ পরিসংখ্যান।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই নির্বাচন প্রক্রিয়া, কেন এই বেসুমার অর্থব্যয়? জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র অর্থনীতির প্রতি এত বড় বোঝা চাপানো কতটা অপরিহার্য? জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের কি আর কোন পন্থা নেই? হৃদয়ের গভীরে অনেকেই হয়তো চিন্তা করেন যে, যে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের তিনবেলা অন্ন সংস্থান নেই, মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই সে দেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য এই বিপুল অর্থব্যয় কি মানানসই? অন্য কোন পদ্ধতি কি নেই? থাকলে সেটা কোনটা? অথবা নির্বাচন কোরেই কি সাধারণ মানুষের ভাগ্যে, জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন আসছে? অনেকেই হয়তো বোঝেন যে এতে দেশের ক্ষতি, মানুষের কোন কাজে আসে না এই বিপুল অর্থ তবু চুপ থাকেন তাদের সামনে অন্য কোন বিকল্প না থাকায়, বা এই ব্যবস্থার পরিবর্তন তাদের আওতার বাইরে। কিন্তু যারা সত্যিই দেশপ্রেমিক, জাতির ভালো চান তাদের এই সিস্টেমের বিকল্প নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসন্ধান করা উচিৎ।
ব্রিটিশরা দীর্ঘ দুই শতাব্দী আমাদেরকে শাসন-শোষণ করার পর যখন আপাত স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেল তখন ঘাড়ে চাপিয়ে দিল গণতন্ত্র নামক একটি সিস্টেম। তারা নিজেরা চালিয়েছে জুলুমের শাসন, নিজেরা আজও মেনে চোলছে রাজতন্ত্র অথচ আমাদের বেলায় কেন তারা গণতন্ত্রকে পছন্দ কোরল তা আমাদের অবশ্যই ভাববার বিষয়। ১৯৪৭ সনে যাদের হাতে তারা পাকভারতকে ভাগ কোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে যায় তাদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রিটিশদের শিক্ষায় শিক্ষিত, ব্রিটিশদের প্রতি হীনম্মন্যতায় আপ্লুত, ব্রিটিশদের অন্ধ অনুকরণকারী। সুতরাং ইংরেজরা যা দিয়েছে আমাদের তদানীন্তন নেতৃত্ব সেটাই নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক মনে কোরেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, আগে দেশটা স্বাধীন হোক, আগে ইংরেজ বিদায় হোক। তারপরে প্রায় সত্তর বছর পার হোয়ে গেছে, এই দীর্ঘ সময়ে গণতন্ত্রের প্রচার প্রচারণায় মুগ্ধ হোয়ে আজ আমরা সেই গণতন্ত্রকেই সর্বান্তকরণে গ্রহণ কোরে নিয়েছি। এটা এখন আমাদের ‘ঈমানে’ পরিণত হোয়েছে যে, গণতন্ত্র ছাড়া এ পৃথিবীতে চলা যাবে না। আমাদের দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আমলাদের হাতে, তাদের আমলাতন্ত্রের ভারে আমাদের দেশ আজ ন্যূব্জ। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হোচ্ছে অনুৎপাদনশীল আমলাদের হাত দিয়ে যা প্রতি পদে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে কোরছে মন্থর, পশ্চাদমুখী। সরকারের যে কোন জনহিতকর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হলো আমলাদের, অথচ দেখা যায় তাদেরই সৃষ্ট জটিলতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে স্থবির। বস্তুত আমলাদের কাছে থেকে জাতি উপকার বোলতে কিছুই পায় নি। দুর্নীতিসহ অন্যান্য কারণে দেশের সরকার একের পর এক বদল হলেও দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক এই আমলারা আছেন যে যার জায়গাতেই। এর যথার্থ কারণও আছে। আমলারা ন্যায়-অন্যায় বা জনগণের স্বার্থ-অস্বার্থের আগে বিবেচনায় আনেন কীভাবে তাদের মাথার উপরে থাকা সরকারের মন জয় করা যায় সেটাকে। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের তোষামোদ করাই হলো তাদের নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ। তারা যে কোন উপায়ে সরকারের খরচ বৃদ্ধি করার পক্ষে। আমলাদের বড় বড় অনেকের কার্যক্রম বার বার প্রমাণ করেছে যে, তারা এদেশের মাটিতে থাকতে চান না। বিদেশের আলো-বাতাসের প্রতি তাদের রয়েছে দুর্নিবার আকর্ষণ। তারা বিদেশের বোতলের পানি খান, বিদেশেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করান। অথচ অপরদিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে তাদের অবস্থান। এসব বিবেচনা কোরলে এই মাথাভারি আমলাতান্ত্রিক সিস্টেম আমাদের কতটুকু দরকার তা ভাবার সময় হোয়েছে।
কাজেই এখন প্রকৃতপক্ষেই জরুরি হচ্ছে, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সহজ পথ বের করা, সমস্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার উর্দ্ধে উঠে কিভাবে দেশের আপামর জনতার জন্য প্রকৃতপক্ষেই কাজ করা যায় সেটা নিরূপণ করা। মনে রাখতে হবে, বিল্ডিং, ব্রিজ, ইমারত, রাস্তাঘাট এগুলো উন্নতির মাপকাঠি নয়, উন্নতির মাপকাঠি হলো শান্তি, সুখ, মানবতা, সভ্যতা, মানুষ হিসেবে আমরা কতদূর উঠতে পারলাম সেটা। উন্নতি-প্রগতির জন্য নির্বাচনের দোহাই দিলেও বাস্তবে এই নির্বাচন পদ্ধতির কারণে আজ আমাদের জাতীয় থেকে শুরু কোরে গ্রাম পর্যন্ত সকলের চারিত্রিক অবনতি হচ্ছে। যতই বিধিনিষেধ আর নির্বাচনী আচরণবিধি থাকুক, বাস্তবে আমাদের দেশে দেখি, নির্বাচন উপলক্ষে ২০ টাকা থেকে শুরু কোরে লক্ষ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মাথা কেনাবেচা হয়। কেউ নমিনেশন বিক্রি কোরে খায় আর কেউ ভোট বিক্রি কোরে খায়। যে কোন নির্বাচনেই নেট ফলাফল হয়- প্রার্থিদের প্রতারণা, তাদের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় কোন্দল, অনৈক্য-বিভেদ, হত্যা-রাহাজানি এবং শত্র“তা। এর যেন কোন শেষ নেই। এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি জাতিকে ক্রমেই ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ কোরে দিচ্ছে। কাজেই প্রচলিত নেতা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। ভাববার সময় এসেছে আমলাতান্ত্রিক সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়েও। সর্বোপরি, যারা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে কতজন ক্ষমতার কাঙাল আর কতজন দেশসেবা কোরতে আগ্রহী সেটাও জনগণ জানে। তারা জানে যে, এই নির্বাচনে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। তবু তারা ভোট দিতে যান অভ্যাসে, কোন আশা নিয়ে নয়।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ আছে। প্রশ্ন হোচ্ছে সেই পথে জাতির নেতারা হাঁটবেন নাকি নিজেদের স্বার্থ সমুন্নত রেখে দেশের স্বার্থকে উপেক্ষা কোরে পরবর্তী আরেকটি বিরাট ব্যয়বহুল নির্বাচনের পথ চেয়ে থাকবেন।