কামরুল আহমেদ:
একটি সভ্যতার অনুসারীরা চরিত্রগতভাবে কেমন হবে সেটা নির্ভর করে ঐ সভ্যতা তাদের সামনে জীবনের কোন লক্ষ্যটি স্থাপন করে দিয়েছে তার উপর। যদি জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয় যে, যত বেশি টাকা থাকবে তত বেশি জীবন নিরাপদ ও সম্মানজনক হবে তখন সেখানকার মানুষগুলোর দিন রাতের চিন্তাই হবে আরো আরো টাকা কী করে পকেটে পোরা যায়। এই লক্ষ্য সামনে স্থির করে দেওয়ার পর আর তাদেরকে নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন হতে বলে লাভ নেই। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে তখন পুলিশ লাগবে, লাঠি লাগবে। মার খাওয়ার ভয়ে তারা অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে, অন্য কোনো কারণে নয়। সেটা শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক কোনো বেশকম হবে না।
শিক্ষকগণ ক্লাসে কম পড়াবেন আর প্রাইভেটে বা কোচিং – এ গেলে সব পড়াবেন, প্রশ্ন-সাজেশন দিয়ে দেবেন, প্রথম শ্রেণী থেকে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে – স্বার্থমুখী সভ্যতায় সেটাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি হবে। এটা কমন সেন্স, সামান্য জ্ঞান থাকলেও বোঝা যায়। সেখানে সরকার হাজারবার বলেও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, কারণ তাদের দরকার টাকা। টাকা থাকলেই সম্মান কেনা যাবে। আর ছাত্রদের দরকার জিপিএ-৫। এভাবেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বার্থের জন্য সবাই ইঁদুরের মতো দৌড়াবে। ডাক্তাররা বড় বড় টেস্ট দিয়ে গরীব রোগীদের গলা কাটবেন, কিছু না হতেই সার্জারি করে রোগীকে আজীবনের জন্য আতুড় বানিয়ে দেবেন। টাকা ছাড়া পুলিশ কোনো সহযোগিতাই করবে না, সরকার যতই বেতন বাড়াক না কেন, একেকজনকে এক কোটি টাকা বেতন দিলেও সে অন্যের সাথে দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। টাকা কারো খিদে মেটাতে পারবে না। হাজার উপদেশেও কেউ সত্যকে ধারণ করবে না।
এটাই হচ্ছে একটি স্বার্থমুখী সভ্যতার চিত্র। এখানে শৈশবেই বলা হচ্ছে গাড়িঘোড়া চড়াটাই লেখাপড়ার উদ্দেশ্য। এই সভ্যতাটা প্রতিষ্ঠা করেছে পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শন। আমরা সেটার অনুসারী। আমরা তাদের তৈরি প্রযুক্তি দেখে বিস্ময়ে হা করে থাকি, লালায়িত হই, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই কিন্তু সে আমাদের জীবনের কী লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা বিচার করি না। আমরা অপরাধ দমনের জন্য আইন করি, দুর্নীতি দমন কমিশন করি তবু আমাদের মন্ত্রীরা বলেন, দেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, চোর। সুযোগের অভাবে সৎ। সামান্য অর্থাভাবেই চরিত্র বিকিয়ে দেবে। এই যে মানুষের চরিত্র লুট হয়ে গেল, অধঃপতিত হলো এটা কে ফিরিয়ে দেবে?
প্রযুক্তির উন্নতি প্রতিযুগেই হবে এটা স্বাভাবিক। স্বাধীন জাতিগুলো আবিষ্কার করবে আর গোলাম জাতি সেই আবিস্কৃত পণ্য ক্রয় করে ডাঁট দেখাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসবোধ কে ফিরিয়ে দেবে? এখন কেউ কাউকে দশ টাকা দিয়েও বিশ্বাস করতে পারে না, রাস্তায় চলার সময় আতঙ্ক আর বিভীষিকা ভর করে পুরুষ নারী সবার ভিতরে। কে খুনী, কে ছিনতাইকারী, কে ধর্ষক চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। সবচেয়ে সভ্য উন্নত আর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। আর তাদেরকেই আমরা সভ্য জাতি বলে বাহবা দিচ্ছি আর তাদের মনন ও জীবনাচরণ ধারণ করতে পারলে সেটাকেই সফলতা বলে মনে করছি। একবার বিচার করছি না গোটা জাতিকে চোর বানালো কে, অন্যায়ের কাছে অসহায় করে দিল কে? কে সেই প্রতারক, ভদ্রবেশী শয়তান?
এমন একটি সভ্যতা সম্ভব যেখানে মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্যই হবে মানুষের উপকার করা, পরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, নিজের সম্পদ হোক বা জ্ঞান হোক সব দিয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ করে তোলা। তারা অর্থের পেছনে না ছুটে মানবকল্যাণের পানে ছুটবে, তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক হবে। এই চিন্তা করবে না যে অন্যায়ের নিরসন করবে বা মানুষের কল্যাণে কাজ করবে সরকার বা অন্য কেউ। সেই সমাজে রাস্তায় লাখো নিরাশ্রয় মানুষ পশুর জীবনযাপন করবে আর অন্যরা দালান কোঠায় বাস করবে এমন অন্ধ অমানবিকতা থাকবে না। সেই সভ্যতা নির্মাণের জন্য শুরুতেই প্রয়োজন জীবনের লক্ষ্যের পরিবর্তন। একটি শিক্ষা সবার মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে, আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্যের ধারক হবো, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো। নিজে অন্যায় করব না, অন্যকেও করতে দেব না। যে সমাজে অন্যায়কারী সম্মানিত হয়, সেই সমাজে মানুষগুলো ছুটে ছুটে যায় অন্যায়ের দিকে, বৈধভাবে অন্যায় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। বর্তমানে সারা পৃথিবীর নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি একজন স্বীকৃত দুশ্চরিত্রের লোক। সেই দুশ্চরিত্র এখন প্রশ্রয় ও প্রসংশার বস্তু। চরিত্র হারানোর শুরু সেখান থেকে যা শেষ হয়েছে আমাদের দেশের চৌকিদারের স্তরে এসে।