মোহাম্মদ আসাদ আলী:
দৈনিক বজ্রশক্তির গতকালের সংখ্যায় আমার লেখাটিতে আদম সৃষ্টি ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। একনজরে মানবজীবনের মূল ঘটনাপ্রবাহ বলতে গিয়ে বলেছিলাম মানবজাতির ইতিহাস মূলত ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস, আরও গভীরে গেলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (তওহীদ) এবং ইবলিসের সার্বভৌমত্বের (শেরক, কুফর) দ্বন্দ্বের ইতিহাস। এ বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য সার্বভৌমত্ব কী তা জানা দরকার।
মানুষ সামাজিক জীব, কাজেই একটি জীবনব্যবস্থা ছাড়া সে পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে না এবং সেই জীবন-ব্যবস্থা বা দীনে আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজবিধি সবই থাকতে হবে। অবশ্য অবশ্যই থাকতে হবে এবং এর একটা সার্বভৌমত্বও অবশ্যই থাকতে হবে; কারণ যখনই আইন, দণ্ডবিধি অর্থনীতি বা যে কোন ব্যাপারেই কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তখনই একটা সার্বভৌমত্বের প্রয়োজন হবে। উদাহরণ- সমাজে অপরাধ দমনের জন্য নরহত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত কিনা। কিংবা সমাজের সম্পদ সঠিক এবং সুষ্ঠু বিতরণের জন্য অর্থনীতি সুদভিত্তিক হওয়া সঠিক কিনা? সমাজের নেতারা যদি ঐ সব বিষয়ে আলোচনা, পরামর্শ, যুক্তি-তর্ক করেন তবে তা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে- কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না, কারণ এইসব বিষয়ে প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে। একদল বলবেন- নরহত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড আইন না করলে সমাজে নরহত্যা থামবে না, বাড়বে; আরেক দলের মত এই হবে যে মৃত্যুদণ্ড বর্বরোচিত, নৃশংসতা, এ কখনো আইন হতে পারে না; আরেক দল হয়তো এই মত দেবেন যে একটি নরহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে একাধিক নরহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড আইন করা হোক। একাধিক অর্থে কয়টি নরহত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, দুইটি না একশ’টি তাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। এবং এ বিতর্ক অনন্তকাল চলতে থাকবে।
অনুরূপভাবে সমাজের অর্থনীতি সুদভিত্তিক হওয়া সঠিক না লাভ-লোকসানভিত্তিক হওয়া উচিত এ নিয়ে বিতর্কের কোনদিন অবসান হবে না যদি না সিদ্ধান্ত নেবার মত একটা ব্যবস্থা না থাকে। কাজেই যে কোন জীবন-ব্যবস্থায়ই শেষ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটি স্থান থাকতেই হবে। অন্যত্থায় জীবন-ব্যবস্থার যে কোন ব্যাপারে পরামর্শ আলোচনায় বসলে তা অনন্তকাল চলতে থাকবে। এই শেষ সিদ্ধান্ত নেবার ও দেবার কর্তৃত্ব ও অধিকারই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব।
এই সার্বভৌমত্ব হতে পারে মাত্র দুই প্রকার। যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর, স্রষ্টার; কিংবা সৃষ্টির অর্থাৎ মানুষের। স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের জন্য একটা জীবনব্যবস্থা দিয়েছেন যাকে তিনি বলেছেন দীন, সুতরাং তিনি নিজেই সেটার সার্বভৌম। ঐ দীনের মধ্যেই তিনি মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজ-নীতি, শিক্ষা, এক কথায় ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি যে কোন পর্যায়ে অবিচার, অশান্তি, অন্যায়, অপরাধহীন একটা সমাজ গঠন করে সেখানে বাস করার জন্য তার সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন। মানুষ যদি স্রষ্টার ঐ সিদ্ধান্ত অর্থাৎ আদেশগুলি মেনে নিয়ে সেই মোতাবেক তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন পরিচালিত করে তবে সে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মেনে নিলো। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের এই ঘোষণাই তওহীদণ্ড লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অর্থাৎ জীবনের যে অঙ্গনে আল্লাহর কোনো কথা আছে, আদেশ, নিষেধ আছে, সেখানে অন্য কারওটা মানব না এই সাক্ষ্য দেওয়া।
অন্যদিকে তওহীদ অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। সেক্ষেত্রে ঐ জনসমষ্টিকে অতি অবশ্যই আল্লাহর দেওয়া দ্বীনের বিপরীতে অন্য একটি জীবন-ব্যবস্থা অর্থাৎ দীন তৈরি করে নিতে হবে, কারণ একটা জীবনব্যবস্থা ছাড়া মানুষ পৃথিবীতে বাস করতে পারে না, তা অসম্ভব। এই নতুন জীবনব্যবস্থা তৈরি করতে গেলেই সেখানে অতি অবশ্যই একটি শেষ সিদ্ধান্তের স্থান, অধিকার থাকতে হবে; এবং যেহেতু স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে ত্যাগ করা হলো, সেহেতু এই শেষ সিদ্ধান্তের স্থান, কর্ত্তৃত্ব অধিকার (অঁঃযড়ৎরঃু) হতে হবে সৃষ্টির অর্থাৎ মানুষের। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ এতখানি সামর্থ্য দেন নি যা দিয়ে সে নিজের জন্য নিখুঁত ও ভারসাম্যযুক্ত একটি দ্বীন তৈরি করে নিতে পারে এবং তার প্রয়োগ করে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। কাজেই সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে তুলে নেওয়ার অর্থই হচ্ছে অনিবার্য অন্যায়, অত্যাচার, যুদ্ধ, রক্তপাতে নিমজ্জিত হওয়া এবং ইবলিশের বিজয়ী হয়ে যাওয়া।
তওহীদের গুরুত্বটা মূলত এখানেই। যেখানে তওহীদ থাকবে সেখানে সার্বভৌমত্ব থাকবে আল্লাহর, বিজয় হবে আল্লাহর, মানবজীবন হবে শান্তিপূর্ণ। যেখানে তওহীদ থাকবে না, সার্বভৌমত্ব চলে যাবে ইবলিসের হাতে, বিজয়ী হবে ইবলিস, মানবজীবন হবে অশান্তিময়।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।