রাকীব আল হাসান
আমাদের সমাজের চিত্র তুলে ধরার জন্য একটি গল্প বলি-
আব্দুর রহিম খুব কষ্টে আছেন। তিনদিন ধরে প্রায় না খাওয়া। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তার কষ্ট নিজের জন্য নয়, তার বউ-বাচ্চাও যে না খাওয়া। সে দিন আনে দিন খায়, তাই অসুস্থ হলে আর খাবার জোটে না। স্ত্রী সেহেরিতে পানি খেয়ে রোজা আছে, তাই না খেলেও আজ চলবে কিন্তু তিন বছরের বাচ্চাটা শুয়ে কেবলই খাবার চাচ্ছে। আব্দুর রহিম এখন চিন্তা করছে- কী করবে সে।
পাশেই হাজি জহির চৌধুরীর বাসা। বিরাট চাকরি করে, অনেক টাকা বেতন। গত বছর হজও করে এসেছেন। এ বাড়িতে আব্দুর রহিমের স্ত্রী কাজ করত এক সময়। এখন আর শরীরে কুলায় না। জহির সাহেবের বাসার সবাই গ্রামে গেছে ঈদ করতে, তিনিও ছুটি আর বোনাসটা পেলেই গ্রামে যাবেন।
আব্দুর রহিম আর সহ্য করতে পারছিল না। হাজি সাহেবের বাসায় স্ত্রীকে পাঠিয়েছিল কিছু সাহায্যের জন্য। কিন্তু কাল শবে কদর ছিল, তাই সন্ধ্যায় ইফতার করে খাবার খেয়ে হাজি সাহেব মসজিদে চলে গেছে, আর ফেরেনি। আজ আবার গিয়েছিল, কিছু খাবার জুটেছে। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন চলবে?
আব্দুর রহিমের মাথায় একটা কু-বুদ্ধি এল। হাজি সাহেবের বাসায় সে চুরি করবে। তার আলমারিতে নাকি অনেক টাকা রয়েছে, বেতন-বোনাস পেয়েছে। টাকাগুলো নিয়ে বাড়িতে ঈদ করতে যাবে সে, যাকাতের কাপড় কেনার জন্যও বেশ কিছু টাকা রেখেছে। আব্দুর রহিম ঠিকই চুরি করল।
পরের দিন সকালে জহির চৌধুরী অত্যন্ত বিমর্ষ হলেন, চোরকে খুব বকাবাজিও করলেন, ক্রুদ্ধ হয়ে বাসায় ভাঙচুরও করলেন। অবশেষে পুলিশে খবর দিলেন। জহির সাহেবের আর বাড়ি ফেরা হলো না, স্বজনদের সাথে ঈদ আনন্দ করা হলো না। এই দুঃসংবাদে তার পরিবারের ঈদও মাটি হয়ে গেল।
এদিকে আব্দুর রহিম নিজের এবং তার স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে, চিকিৎসা করিয়েছে, কিছু ঋণ পরিশোধ করেছে। টাকাও শেষ হয়ে এসেছে। সে কাজে বের হবে। কিন্তু পরদিন সকালে তার দরজায় কড়া নাড়ল পুলিশ। তাকে পাঠানো হলো কারাগারে। তার পরিবার আগের মতোই না খেয়ে, অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছে…
ঘটনাটি যদি এমন হতো-
আব্দুর রহিম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কাজে যেতে পারেনি, ঘরে তেমন খাবারও নেই। বেশ কষ্টে আছে সে ও তার পরিবার। ছোট মেয়েটার জন্যেই তার বেশি চিন্তা। তার স্ত্রী পাশেই জহির চৌধুরীর বাসায় কাজ করত। ইদানীং শারীরিক অসুস্থতার জন্য সে কাজ করতে যায় না। আজ পরিবারের কথা চিন্তা করে কাজ করতে গেল। জহির চৌধুরী তার কাজ করতে যাওয়া দেখে সব জিজ্ঞাসা করে করে জানল।
জহির চৌধুরী কিছু টাকা নিয়ে আব্দুর রহিমের বাড়িতে এল। আব্দুর রহিমের হাত ধরে বলল- দেখ ভাই, প্রতিবেশী হিসাবে আমার উচিত ছিল তোমার খোঁজ রাখা। তোমার খোঁজ না রাখলে রসুলাল্লাহ (সা.) এর কথা অনুযায়ী আমি মো’মেন হতে পারব না, আর মো’মেন হতে না পারলে আমি জান্নাতেও যেতে পারব না। আমার সকল ইবাদত, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হজ করে আসা, সারা জীবনের নামাজ-রোজা সবই বৃথা হয়ে যাবে। নানা ব্যস্ততার জন্য আমি তোমার খোঁজ রাখতে পারিনি। আমি বেতনের সাথে ঈদ বোনাস পেয়েছি, যাকাতের জন্য এমনিতেই কিছু টাকা রেখেছিলাম। তুমি দয়া করে আমার এই টাকা গ্রহণ করে আমাকে মো’মেন হবার সুযোগ দাও, আমাকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর ভাই। তাছাড়া টাকা নিয়ে বাড়িতে গিয়ে সবাইকে নিয়ে ঈদ করে যে আনন্দ পাব তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দিত হব যদি এ টাকায় তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, যদি তোমাদের কষ্ট দূর হয়। আব্দুর রহিম খুব ইতস্তত করছিল কারণ সে কাজ করা বাদে কারো কাছ থেকে এভাবে টাকা নিতে অভ্যস্ত নয়। জহির সাহেবের জোর অনুরোধে সে টাকাটা নিতে বাধ্য হয়।
জহির সাহেব বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে এবার সে আব্দুর রহিমের পরিবারের সাথে ঈদ করবে। কিছু টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছে আর বাকি টাকায় রহিমের চিকিৎসা, তার বাচ্চার জন্য নতুন পোশাক আর ঈদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছে। জহির সাহেবের পরিবারও সব শুনে অনেক খুশি হয়েছে। আব্দুর রহিম সুস্থ হয়ে উঠেছে, তার পরিবার এখন অনেক খুশি। কাল থেকে সে আবার কাজে বের হবে।
উভয় ক্ষেত্রেই জহির সাহেবের টাকা খরচ করেছে আব্দুর রহিমের পরিবার কিন্তু প্রথম ঘটনায় সবাই অশান্তিতে পড়েছে, কষ্টে পড়েছে কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় সবাই অনেক খুশি হয়েছে, প্রশান্তি পেয়েছে। এই হলো সত্যনিষ্ঠ সমাজ ও মিথ্যাচ্ছন্ন সমাজের পার্থক্য। আমরা নিজেদের জীবন ও সম্পদের কোরবানির মাধ্যমে যাবতীয় অন্যায়, যাবতীয় মিথ্যা সমাজ থেকে দূর করে আল্লাহর হুকুম তথা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এরূপ সত্যনিষ্ঠ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এজন্যই হেযবুত তওহীদের সংগ্রাম।