আজকের পৃথিবীতে প্রধান প্রধান ধর্মীয় জাতিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে যতগুলো অমিল লক্ষ্য করা যায়, তার চেয়ে বহু বেশি মিল পরিদৃষ্ট হয়। অথচ রাজনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে কেবলমাত্র জাতিগুলোর অমিল বা মতদ্বৈততা আছে এমন বিষয়গুলোকেই বারংবার সামনে আনা হয়, আর মিলগুলোকে সুচতুরভাবে দূরে সোরিয়ে রাখা হয়। ধর্মব্যবসায়ী ও স্বার্থবাদী রাজনীতিকদের এই কপটতার বলী হয় সকল ধর্মের সাধারণ মানুষেরা। তাই ধর্মব্যবসায়ীরা যাতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত কোরে কোনোরূপ অনর্থ ঘটাতে না পারে তার জন্য সকল ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় অতি প্রয়োজনীয়।
সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং মোসলেমরা কিভাবে স্বজাতি?
আমাদের এই উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রায় ১১০ কোটি সনাতন ধর্মের অনুসারী রোয়েছেন। ধর্মীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মগ্রন্থের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ এই জাতিটি বরাবরই ধর্মানুরাগী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। পৃথিবীতে সম্ভবত তাদের মতো প্রাচীন গ্রন্থের অধিকারী দ্বিতীয় কোনো নৃ-গোষ্ঠী নেই। বহু নবী-রসুল অবতারের আগমন ঘটেছে এই ভারতবর্ষে যারা সকলেই ছিলেন সনাতন ধর্মের ধারক। সনাতন শব্দের অর্থ যা নিত্য, চিরসত্য, স্বতঃসিদ্ধ, শাশ্বত। আল কোর’আনে ইসলামকে বলা হোয়েছে ‘দীনুল কাইয়্যেমা’। এই কাইয়্যেমাহ শব্দের অর্থও ঐ একই- যা সনাতন, নিত্য, শাশ্বত। সে হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আর মোসলেমরা শুধু যে স্বজাতি তা-ই নয়, তাদের উভয়ের ধর্মের নাম পর্যন্ত অভিন্ন। কিন্তু অতি সুচতুরভাবে সনাতন ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ‘হিন্দু’ শব্দটিকে সনাতন ধর্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হোল। এই এলাকার মানুষের ধর্মকে হিন্দু ধর্ম কখনোই বলা হোত না। হিন্দু ধর্ম বা Hinduism এই শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যা ছিলো তাদের সুচতুর ষড়যন্ত্রের একটি পদক্ষেপমাত্র। আমার এ কথায় কারো সন্দেহ থাকলে দয়া কোরে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ২০ খণ্ডের ৫১৯ পৃষ্ঠায় Hinduism অধ্যায়টি দেখে নিতে পারেন। সেখানে বলা হোয়েছে, “The term Hinduism … [ was] introduced in about 1830 by British writers.” এর ফল হোল এটাই যে, হিন্দু ও মোসলেম দুটো দুই জাতি হোয়ে গেল। একে অপরের থেকে দূরে সরে গেলো। সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানো সহজ হোয়ে গেলো। হিন্দু কাকে বলে? ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চলকে হিন্দুস্তান বোলে আখ্যায়িত কোরত পারস্যে মোসলেমরা। অর্থাৎ এটি ছিলো একটি ভৌগোলিক পরিচয়ের বিষয়, ধর্মীয় পরিচয় নয়। এখন কথা হোচ্ছে, হিন্দুস্তানের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে যদি কোন জনগোষ্ঠীকে হিন্দু বোলে আখ্যা দেওয়া হয়, তাহোলে সিন্ধুর অববাহিকায় আরও যতো নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে এবং কোরবে তাদেরকেও হিন্দু বলা অযৌক্তিক হবে না।
সকল মানুষ একই পিতা-মাতা আদম হাওয়ার সন্তান, সকলেই ভাই-বোন। সনাতন ধর্মের গ্রন্থে এই আদি পিতা-মাতাকে আদম ও হব্যবতী বোলে উল্লেখ করা হোয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রাথমিকভাবে মহর্ষী মনুর (আ:) অনুসারী। মহর্ষী মনুই (আ:) হোচ্ছেন কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ:)। সুতরাং মোসলেম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আদিতে একই নবীর অনুসারী। নূহ (আ:) এর মাধ্যমেই মানবজাতির বংশ রক্ষিত হয়, তাই পৃথিবীতে বিরাজমান সকল মানুষের পূর্বপুরুষগণ একসময় নূহের (আ:) অনুসারী এতে কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তীতে ভারতবাসীকে পথ দেখাতে এবং ধর্মকে প্রতিষ্ঠা কোরতে আবির্ভূত হোয়েছেন আরও বহু নবী-রসুলগণ যাঁদেরকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় অবতার। শ্রীকৃষ্ণ (আ:), যুধিষ্ঠির (আ:), বুদ্ধ (আ:), মহাবীর (আ:) এঁরা সকলেই ছিলেন আল্লাহর সত্য নবী। সত্য কখনো পৃথক হয় না, সত্যের একরূপ। তাই সকল সত্যনবীর অনুসারীদেরও এক জাতি হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
খ্রিস্টানদের সাথে মোসলেমদের শত্র“তার পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থবাদীদের চক্রান্তই প্রধান হোলেও ধর্মীয় বিশ্বাসের তারতম্যও যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু আদতে খ্রিস্টান ও মোসলেম ভিন্ন জাতি নয়। মোসলেমরা যেমন আল্লাহ তথা ঈশ্বরের প্রেরিত নবী মোহাম্মদের (দ:) অনুসারী, তেমনি খ্রিস্টানরাও ঐ ঈশ্বরেরই প্রেরিত অপর এক নবী যিশুর (আ:) অনুসারী দাবিদার। খ্রিস্টান ও মোসলেম উভয়েই একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই মাতা-পিতার সন্তান। ইসলাম ধর্মে তাদেরকে বলা হোয়েছে আদম-হাওয়া, আর বাইবেলে বলা হোয়েছে অ্যাডাম-ইভ। খ্রিস্টানরা যাকে বলেন জেসাস-ক্রাইস্ট, মোসলেমরা তাঁকেই বলেন ঈসা (আ:)। যিশু খ্রিস্টকে (আ:) সম্মান করা, তাঁকে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু একজন মোসলেমের কর্তব্যই নয়, ঈমানী দায়িত্ব। কোন মোসলেম যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে সে কাফের হবে, কারণ তাঁকে অস্বীকার কোরলে প্রকারান্তরে স্রষ্টাকেই অস্বীকার করা হয় (সুরা নেসা- ১৫১)। ঈসা (আ:) আল্লাহর তওহীদ তথা একত্ববাদ শিক্ষা দিয়েছেন। বাইবেলে আমরা পাই, একদিন একজন লোক তাঁর কাছে জানতে চাইলো, সকল অনুশাসনের মধ্যে সর্বপ্রথম অনুশাসন কি? ঈসা (আ:) উত্তরে বোললেন, “শোন হে বনী ইসরাইল। সর্বপ্রথম অনুশাসন হোচ্ছে আমাদের প্রভু আল্লাহ হোচ্ছেন একমাত্র প্রভু [“The first of all the commandments is, Hear, O Israel; The Lord our God is one Lord.” (The 12th chapter of Mark) মোসলেমদের বিশ্বাসও তাই। যারা খ্রিস্টান নামধারী কিন্তু না মানে ইঞ্জিলের বিধান, না মানে ঈসা (আ:) এর উপদেশ এক কথায় যারা স্রষ্টার বিধান মানে না তারা আসলে ঈসা (আ:) এর অনুসারী নয়, যতোই তারা দাবী কোরুক। তেমনিভাবে যারা না মানে কোর’আনের বিধান, না অনুসরণ করে শেষ নবীর আদর্শ, তারা মোসলেম বংশোদ্ভূত হোলেও মোসলেম নয়, উম্মতে মোহাম্মদী নয় যতোই দাবি কোরুক না কেন। বাইবেল বলছে যিশু খ্রিস্ট আবার আসবেন, হাদিসেও বলা আছে তিনি আবার আসবেন এবং এসে দাজ্জাল ধ্বংস কোরবেন। খ্রিস্টানরা অপেক্ষা কোরছেন- যিশু খ্রিস্ট এসে এন্টি ক্রাইস্ট ধ্বংস কোরবেন, ‘কিংডম অব হ্যাভেন’ প্রতিষ্ঠা কোরবেন; মোসলেমরাও অপেক্ষা কোরছেন- ঈসা (আ:) পৃথিবীতে এসে দাজ্জালকে ধ্বংস কোরে এমন শান্তি প্রতিষ্ঠা কোরবেন যে, নেকড়ে আর ভেড়া এক সাথে থাকবে। তাহলে মোসলেম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে পার্থক্য রোইল কোথায়? উভয় জাতির মধ্যে শত্র“তার কোনো ভিত্তি রোইল কি?
পবিত্র কোর’আনে সুরা নেসার ১৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, “আহলে কিতাবদের প্রত্যেকে তাদের মুত্যুর পূর্বে তাঁহার [ঈসা (আ:) এর] উপর ঈমান আনবেই।” আবার সুরা আল এমরানের ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, “ তামার [ঈসা (আ:) এর] অনুসারীদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত কাফেরদের উপর প্রাধান্য দিতেছি।” ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাংলায় অনুদিত কোর’আনের ফুটনোটে ঈসার (আ:) অনুসারী বলতে মোসলেমদেরকেই বোঝানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে মোহাম্মদ (সা:) এর আবির্ভাবের পর থেকে ঈসা (আ:) এর প্রকৃত অনুসারী তো তারা যারা মোসলেম অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর সকল রসুলগণের উপরই বিশ্বাস রাখে। মোসলেম শব্দের অর্থ বিনা দ্বিধায় আত্মসমর্পণকারী। সুতরাং যারাই আল্লাহর হুকুমের প্রতি বিনা দ্বিধায় আত্মসমর্পণ কোরবে তারাই মোসলেম, তার বংশপরিচয় এখানে বিবেচ্য নয়। তাই উপরোক্ত আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহ পাকের কথা ও তাফসীরকারকদের ব্যাখ্যার আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কেয়ামতের পূর্বে সমগ্র মানবজাতি স্রষ্টার সিদ্ধান্তের প্রতি আত্মসমর্পণ কোরবে এবং মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ কোরে একজাতিতে পরিণত করার জন্যই ঈসা (আ:) এর পুনরাগমন হবে। সুতরাং এটাই যদি তাঁর কাজ হয় তবে কেন আমরা মিছেমিছি সেই ঐক্যকে বিলম্বিত কোরছি, আজই কেন আমরা এক জাতিতে পরিণত হোতে পারছি না? যেহেতু ঈসা (আ:) এসে বাইবেলে বর্ণিত Anti-Christ, The Beast, হাদীসে বর্ণিত দাজ্জালকে ধ্বংস কোরে সমস্ত মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ কোরবেন যার ফলস্বরূপ পৃথিবী হবে Kingdom of Heaven, সেহেতু আমরা সেই ঐক্যপ্রক্রিয়া এখনই কেন শুরু কোরি না?
এটা প্রসিদ্ধ ইতিহাস যে, রসুলাল্লাহ মক্কা বিজয়ের পর যখন কাবা ঘরে স্থাপিত বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি ভেঙে ফেলছিলেন তখন কাবার অভ্যন্তরভাগের দেওয়ালে যিশু খ্রিস্ট ও মাতা মেরির ছবিও ছিল। আল্লাহর রসুল সকল মূর্তি ভাঙলেও, সকল ছবি ধুয়ে ফেললেও ঐ ছবিটা নষ্ট কোরলেন না। কয়েক শতাব্দী ঐ ছবি সেখানেই ছিলো। পরে কাবাঘর পুনসংস্কার করার সময় সেই ছবিগুলি নষ্ট হোয়ে যায় (সূত্র: সিরাত ইবনে ইসহাক)। যে ছবি আল্লাহর ঘর ক্বাবায় ছিলো সে ছবি কারও ঘরে কেউ যদি রাখতে চায় তবে অন্যের আপত্তি থাকবে কেন? তিনি তো কেবল খ্রিস্টানদেরই নবী নন, মোসলেমদেরও নবী। নবী-রসুলগণ কোনো নির্দিষ্ট জাতির একার সম্পদ হোতে পারেন না। তাঁরা সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ, সমগ্র মানবজাতির সম্পদ। তাঁরা যে বিধান এনেছেন স্থান-কাল-পাত্রভেদে সেগুলোতে শরিয়াহর কিছু রদ-বদল থাকলেও মূল শিক্ষায় কোনো পার্থক্য ছিলো না। কারণ, পৃথিবীর সত্য, শাশ্বত, সনাতন নিয়ম-নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এই শাশ্বত শিক্ষা যেমন আল কোর’আনে আছে, তেমন বাইবেলেও আছে। কাজেই মোসলেমরা কোর’আনের পাশাপাশি বাইবেল থেকে শিক্ষা গ্রহণ কোরবেন, ইঞ্জিলের বহু কথা আল্লাহ কোর’আনেও উল্লেখ কোরেছেন। খ্রিস্টানরা বাইবেলের পাশাপাশি কোর’আন থেকে শিক্ষাগ্রহণ কোরবেন এমনটাই হওয়া উচিৎ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মোসলেম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে কার্যত হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ, হানাহানি তথা শত্র“তার যুক্তিসঙ্গত ধর্মীয় কোন কারণ নেই।
তাছাড়াও এব্রাহীম (আ:) তথা আব্রাহাম কে মোসলেমরা যেমন জাতির পিতা বোলে মান্য করেন। আল্লাহ উম্মতে মোহাম্মদীর উদ্দেশে পবিত্র কোর’আনে বোলছেন, “এটাই (ইসলাম) তোমাদের পিতা এব্রাহীমের দীন। আল্লাহ্ তোমাদের নাম রেখেছেন “মুসলিম”। পূর্বের গ্রন্থাবলীতেও আবার এই গ্রন্থেও (কোর’আন) ঐ নামই দেয়া হোয়েছে। (সুরা আল-হাজ্জ ৭৮)।
তেমনি খ্রিস্টানরাও তাঁকে জাতির পিতা বোলেই মান্য করেন। বাইবেলে বলা হোচ্ছে: Abraham is “the father of all those who believe”, both of the circumcised and the uncircumcised (Rom 4:9-12). অর্থাৎ আব্রাহাম খাৎনাকারী এবং খাৎনা বিহীন নির্বিশেষ সকল বিশ্বাসী মানুষের পিতা। ঈসা (আ:) তাঁর অনুসারীদের বোলছেন, “If you were Abraham’s children, then you would do what Abraham did. (John 8:39) অর্থাৎ যদি তোমরা এব্রাহীমের সন্তান হোয়ে থাকো তবে সেই কাজই তোমাদের কর্তব্য যা এব্রাহীম কোরেছেন। সুতরাং এদিক দিয়েও মোসলেম খ্রিস্টান একই পিতার দুই পূত্র।
এই যদি হয় মোসলেমদের সাথে খ্রিস্টানদের সম্পর্ক তাহলে এ দুই জাতির মধ্যে এত বিভেদ কেন? আমরা কি আজও এক সাথে বসতে পারি না? শত শত বছর ধরে বহু সংঘাত হোয়েছে, শত্র“তা হোয়েছে, ক্রুসেড সংঘটিত হোয়েছে, কিন্তু কী লাভ হোয়েছে? শান্তি এসেছে কি? শান্তি তো আসেই নি, মাঝখান থেকে ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানবতাটাই হারিয়ে গেছে। তাই আসুন আমরা একসাথে বসি, আমরা ভাই ভাই হোয়ে যাই। যে নবী-রসুলগণ একজন আরেকজনকে ভাই বোলে সম্বোধন কোরেছেন, সেই নবীদের অনুসারী হোয়ে আমরা কেন একে অপরের সাথে শত্র“তা কোরবো?
ঈসা (আ:) সম্পর্কে আল্লাহর শেষ রসুল (দ:) বোলেছেন, “মানবজাতির মধ্যে সবার চেয়ে ঈসা ইবনে মারিয়ামের (আ:) ভাই হবার ক্ষেত্রে আমি সর্বাধিক দাবিদার, তাঁর ও আমার মধ্যে আর কোন নবী নেই” (কানজুল উম্মাল, ১৭ খণ্ড, হাদিস ১০৩৩)। অন্যত্র বোলেছেন, “দুনিয়ায় এবং আখেরাতে আমি ঈসা ইবনে মারিয়ামের (আ:) সবচেয়ে নিকটতম। সকল নবীরাই ভাই ভাই, কেবল তাদের মা আলাদা। তবে তাদের সবাই একই ধর্মের অনুসারী। (হাদীস- আবু হোরায়রা রা. থেকে বোখারী)। আবার ঈসা (আ:) শেষ নবীকে কতখানি সম্মান কোরেছেন তা বাইবেলে বর্ণিত আছে। ঈসা (আ:) তাঁর আসহাবদেরকে বোলেছেন, “বিশ্বাস করো আমি তাঁকে দেখেছি এবং তাঁকে সম্মান জানিয়েছি। এভাবে সকল নবী তাঁকে দেখেছেন। তাঁর রূহকে দর্শনের মাধ্যমে নবীগণ নব্যুয়তপ্রাপ্ত হোয়েছেন। আমি যখন তাঁকে দেখলাম আত্মা প্রশান্ত হোয়ে গেল। আমি বোললাম, O Muhammad;, God be with you, and may he make me worthy to untie your shoelatchet; for obtaining this I shall be a great prophet and holy one of God. হে মোহাম্মদ! আল্লাহ আপনার সহায় হোন। আমাকে তিনি আপনার জুতার ফিতা বাঁধার যোগ্যতা দান কোরুন। কারণ আমি যদি এই মর্যাদা লাভ কোরি তাহলে আমি একজন বড় নবী হবো এবং আল্লাহর একজন পবিত্র মানুষ হোয়ে যাবো। (The Gospel of Barnabas, Chapter 44)”. এই ছিল একজন নবীর নিকটে অপর একজন নবীর সম্মান, মর্যাদা। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, নবী-রসুল-অবতারগণ একে অপরকে কতখানি সম্মান কোরতেন, ভালোবাসতেন। অথচ তাদেরই অনুসারী দাবি করে আমরা জেহাদ-ক্রুসেডের নামে একে অপরের সাথে বংশ পরম্পরায় শত্র“তা কোরে যাচ্ছি, উপাসনালয় ভাঙছি, মূর্তি ভাঙছি, দাঙ্গা কোরছি, রক্তপাত কোরছি। কী নিষ্ঠুর পরিহাস।
খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হোয়ে থাকে কোর’আনে বহু আয়াত আছে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে। এটা একটা বিভ্রান্তি। বস্তুত কোর’আনে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে কোনো আয়াত নেই। কোর’আনে বলা আছে- তুমি অবশ্যই মুমিনদের জন্য মানুষের মধ্যে শত্র“তায় অধিক কঠোর পাবে ইহুদি ও মুশরিকদেরকে। আর মুমিনদের জন্য বন্ধুত্বে তাদেরকে নিকটে পাবে যারা বলে, ‘আমরা নাসারা (খ্রিস্টান)’ (মায়েদা, ৮২)।
নাজ্জাশী ছিলেন খ্রিস্টান শাসক। তিনি রসুলাল্লাহকে সত্য প্রচারে সহযোগিতা কোরেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ কোরেছেন বোলে কোনো সহিহ হাদিস বা ইতিহাস পাওয়া যায় না। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ না কোরলেও রসুলাল্লাহ তাঁকে একজন মোসলেমের সম্মানে সম্মানিত কোরেছেন। তাঁকে মোসলেমদের ভাই হিসেবে উল্লেখ কোরেছেন।
নাজ্জাশী ইন্তেকাল কোরেছিলেন তাবুক যুদ্ধের পর নবম হিজরীতে। আল্লাহর রসুল নাজ্জাশীর এন্তেকালের তারিখেই তার মৃত্যু সংবাদ সাহাবাদের জানান এবং জামায়াতবদ্ধ হোয়ে গায়েবানা জানাযার ব্যবস্থা করেন। তিনি সাহাবাদেরকে বলেন- ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জানাযা পড় যিনি তোমাদের দেশ ব্যতীত অন্য দেশে মৃত্যুবরণ কোরেছেন।’ নাজ্জাশী যে মোসলেম ছিলেন না তার সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল পাওয়া যায় এখানেই। রসুলাল্লাহ যখন জানাযায় দাঁড়ালেন তখন কয়েকজন মোনাফেক মন্তব্য করে যে, রসুলাল্লাহ একজন কাফেরের জানাযা পড়াচ্ছেন। এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ সুরা আল ইমরানের ১৯৯ নং আয়াত নাজেল কোরলেন, যেখানে বলা হোয়েছে- ‘আর আহলে কিতাবদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও রোয়েছে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং যা কিছু তোমার উপর অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু তাদের উপর অবতীর্ণ হোয়েছে সেগুলোর উপর, আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত থাকে এবং আল্লাহর আয়াতসমূহকে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে সওদা করে না, তারাই হলো সে লোক যাদের জন্য পারিশ্রমিক রোয়েছে তাদের পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ যথাশীঘ্র হিসাব চুকিয়ে দেন।’ নাজ্জাশী যে মোসলেম ছিলেন না, আহলে কিতাব অর্থাৎ খ্রিস্টান ছিলেন এবং আহলে কিতাবরাও দীন প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্য করে মোসলেমদের সমান মর্যাদার অধিকারী হোতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই আয়াতটিই। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোচ্ছে নাজ্জাশী ধর্মব্যবসায়ী ছিলেন না, ধর্মকে তিনি স্বার্থ হাসিলের মাধ্যমে পরিণত করেন নি। প্রায় সকল মোফাসসের ও হাদিস বিশারদগণ স্বীকার কোরেছেন যে, এই আয়াতটি নাজ্জাশীর মৃত্যু ও মোনাফেকের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত নাজেল হোয়েছিল।
এই ঘটনার দ্বারা আল্লাহর শেষ রসুল তাঁর জাতির জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন যে, তোমরা একে অপরের শত্র“ নও, আলাদা নও, তোমরা যাঁদের অনুসারী তাঁরা একই স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রেরিত, সুতরাং অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তির প্রাচীর তুলে রাখার কোন বৈধতা নেই, যুক্তিও নেই। এই ছিলো মোসলেমদের সাথে খ্রিস্টানদের সম্পর্ক। প্রশ্ন হোতে পারে, তাই যদি হবে তাহলে পরবর্তীতে তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোরলেন কেন?
পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের সাথে মোসলেমদের যে যুদ্ধের ইতিহাস পাওয়া যায় তার পেছনে বহু কারণ নিহিত রোয়েছে। প্রধান কারণ ছিলো রাজনৈতিক। রসুলাল্লাহ যখন মদীনার রাষ্ট্রপ্রধান, তখন মক্কাবাসী মোশরেকরা পৃথিবী থেকে সত্যদীনকে মুছে ফেলার অভিপ্রায় নিয়ে অনেকবার তাঁকে আক্রমণ কোরেছে। সে আক্রমণে যারা যারা সাহায্য কোরেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি পরবর্তীতে অভিযান পরিচালনা কোরেছেন। সেটা ছিলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেটা কোনো আন্তঃধর্মীয় যুদ্ধ ছিলো না। পবিত্র জেরুসালেম শহর মোসলেম বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা:) ঘুরে ঘুরে শহরের দর্শনীয় বস্তুগুলি দেখার সময় যখন খ্রিস্টানদের একটি অতি প্রসিদ্ধ গির্জা দেখছিলেন তখন সালাতের সময় হওয়ায় তিনি গির্জার বাইরে যেতে চাইলেন। জেরুজালেম তখন সবেমাত্র মোসলেমদের অধিকারে এসেছে, তখনও কোন মসজিদ তৈরিই হয় নি, কাজেই সালাহ খোলা ময়দানেই কায়েম করা হতো। জেরুজালেমের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ বিশপ সোফ্রোনিয়াস ওমরকে (রা:) অনুরোধ কোরলেন ঐ গির্জার মধ্যেই তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামাজ পড়তে। ভদ্রভাবে ঐ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান কোরে ওমর (রা:) গির্জার বাইরে যেয়ে সালাহ কায়েম করলেন। কারণ কি বোললেন তা লক্ষ্য কোরুন। বললেন- আমি যদি ঐ গির্জার মধ্যে নামাজ পড়তাম তবে ভবিষ্যতে মোসলেমরা সম্ভবতঃ একে মসজিদে পরিণত কোরে ফেলতো। একদিকে ইসলামকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠিত কোরতে সর্বস্ব পণ কোরে দেশ থেকে বেরিয়ে সুদূর জেরুজালেমে যেয়ে সেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে খ্রিস্টানদের গির্জা যেন কোন অজুহাতে মোসলেমরা মসজিদে পরিণত না করে সে জন্য অমন সাবধানতা। উম্মতে মোহাম্মদী যতো যুদ্ধ কোরেছিলো সেগুলির উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহর বিধান জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা (আজ যেমন জাতীয়ভাবে ব্রিটিশের আইন-বিধান মেনে নেওয়া হোয়েছে)। কিন্তু তারা ব্যক্তিগতভাবে একটি মানুষকেও তার ধর্ম ত্যাগ কোরে এই দীন গ্রহণে বাধ্য করেন নি। শুধু তাই নয়, যেখানেই তারা আল্লাহর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কোরেছেন সেখানেই অন্য ধর্মের চার্চ, সিনাগগ, মন্দির ও প্যাগোডা রক্ষার দায়িত্ব তো নিয়েছেনই তার উপর ঐ সব ধর্মের লোকজনের যার যার ধর্ম পালনে কেউ যেন কোন অসুবিধা পর্যন্ত না কোরতে পারে সে দায়িত্বও তারা নিয়েছেন। একটি উদাহরণ দিই। আমর ইবনুল আস (রা:) এর মিসর বিজয়ের পর আলেকজান্দ্রিয়ায় কে একজন একদিন রাত্রে যিশু খ্রিস্টের প্রস্তর নির্মিত প্রতিমূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলেছে। খ্রিস্টানরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তারা ধরে নিলো যে, এটা একজন মোসলেমেরই কাজ। আমর (রা:) সব শুনে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তিনি প্রতিমূর্তিটি স¤পূর্ণ নতুন কোরে তৈরি কোরে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রিস্টান নেতাদের প্রতিশোধ নেবার বাসনা ছিলো অন্যরূপ। তারা বললো, “আমরা চাই আপনাদের নবী মোহাম্মদের (দ:) প্রতিমূর্তি তৈরি করে ঠিক অমনিভাবে তাঁর নাক ভেঙে দেব।”
এ কথা শুনে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন আমর (রা:)। প্রাণপ্রিয় নবীজির প্রতি এত বড় ধৃষ্টতা ও বেয়াদবি দেখে তাঁর ডান হাত তলোয়ার বাটের উপর মুষ্টিবদ্ধ হয়। ভীষণ ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজেকে সংবরণ কোরে নিয়ে বোললেন, “আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি তাতে রাজি আছি।” পরদিন খ্রিস্টানরা ও মোসলেমরা বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হোল। আমর (রা:) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বোললেন, “এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের ধর্মের হোয়েছে, তাতে আমার শাসন দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাক কেটে দিন।” এই কথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষèধার তরবারি হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিস্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মোসলেম সৈন্য এলো। চিৎকার করে বললো, “থামুন! আমি ঐ মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি। অতএব আমার নাক কাটুন।” বিজিতদের উপরে বিজয়ীদের এই উদারতায় ও ন্যায়বিচারে মুগ্ধ হোয়ে সেদিন শত শত খ্রিস্টান ইসলাম কবুল কোরেছিলেন।
সুতরাং উম্মতে মোহাম্মদীর যুদ্ধগুলি ছিলো রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কোন সম্প্রদায় বিশেষের বিরুদ্ধে নয়। খ্রিস্টান শাসকরা যুদ্ধগুলোর মধ্যে ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার কোরেছেন। মুসা (আ:) যুদ্ধ কোরেছেন ফেরাউনের বিরুদ্ধে, কৃষ্ণ (আ:) যুদ্ধ কোরেছেন আপন মামা কংসের বিরুদ্ধে, যুধিষ্ঠির (আ:) যুদ্ধ কোরেছেন আপন চাচার বিরুদ্ধে, আখেরী নবীও যুদ্ধ কোরেছেন আপন চাচার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ বহু নবীকেই যুদ্ধ কোরতে হোয়েছে। কারণ একটাই- অসত্যের বিরুদ্ধে প্রথমে ঘৃণা, তারপর প্রতিবাদ, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ কোরতে হোয়েছে। এটাই সনাতন রীতি। রসুলাল্লাহ ও তাঁর প্রকৃত অনুসারীরা মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবী অধিকার কোরেছিলেন। বস্তুত অন্যায়-অবিচার, অশান্তি নির্মূল কোরে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো এর উদ্দেশ্য, কোনো জাতি বা ধর্মকে আঘাত করা নয়।
বর্তমানে প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন স্রষ্টা কেবল আমাদের সাথেই আছেন। আমরা স্রষ্টার প্রিয় জাতি, অন্যরা অবাধ্য, তারা নরকে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি তাতে স্রষ্টা আমাদের কারও প্রতিই খুশি নন। মানুষে মানুষে বিভেদের অভেদ্য প্রাচীর তৈরি কোরে এবং মানবতাকে উপেক্ষা কোরে নিত্য অশান্তির সৃষ্টি কোরে আমরা নিজেদের হাতেই আল্লাহর অভিশাপ ক্রয় কোরে নিয়েছি। এখন প্রতিনিয়ত তার ফল ভোগ কোরছি। কিন্তু স্রষ্টার অপার মহিমা যে, তিনি এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মাধ্যমে এ অভিশাপ থেকে বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছেন। তাই আসুন আমরা ভাই ভাই হোয়ে যাই। সকল প্রকার অনৈক্যকে পেছনে ফেলে নবী-রসুল-অবতারদের প্রকৃত শিক্ষা মোতাবেক ঐক্যবদ্ধ হোই। নিজ নিজ ধর্মের সত্য ও শাশ্বত বিধানের আশ্রয় গ্রহণ কোরে স্রষ্টাহীন, বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের সৃষ্ট অশান্তির অনল থেকে নিজেদের মুক্ত কোরি।