হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
বর্তমানে মুসলিম নামক এই জনসংখ্যাটির ব্যক্তিগত জীবনের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে ‘ইলাহ’ (হুকুমদাতা) হলেন আল্লাহ, আর জাতীয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের ‘ইলাহ’ হলো পাশ্চাত্য ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’। সমস্ত পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো এই মুসলিম দাবিদার জাতিটিও আজ পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র গোলামে পরিণত হয়েছে। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে গ্রহণ করে এই জাতি আজ জাতীয় জীবন থেকে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই সমস্ত জাতির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে আল্লাহ এবং তাঁর মালায়েকের অভিশাপের ঝড়। এই জাতি পৃথিবীর যেখানেই আছে সেখানেই অত্যাচারিত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে।
তবে আশার কথা হলো এই কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তিও সন্নিকটে। কারণ অধঃপতিত মুসলিম নামধারী এই জাতি অচিরেই জেগে উঠবে ইনশা’আল্লাহ। তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া আকিদা ফিরে পাবে। শত্রুর অন্তরে ত্রাস সৃষ্টিকারী এবং নিজেদের মধ্যে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ চরিত্র তারা আবারো ফিরে পাবে। এর কয়েকটি যৌক্তিক এবং অকাট্ট কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ: রসুলাল্লাহর উপাধি ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’
আল্লাহ তাঁর রসুলকে কোর’আনে রহমাতাল্লিল আলামিন বলেছেন। ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’ শব্দের অর্থ হলো (পৃথিবীর) জাতি সমূহের উপর (আল্লাহর) রহমত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আজ পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখুন। কোথায় সে রহমত? পৃথিবীর সর্বত্র অশান্তি, হাহাকার, অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, বুক ভাঙা দুঃখ। মানুষের ইতিহাসে বোধহয় একত্রে একই সঙ্গে দুনিয়ার এত অশ্রু, এত অশান্তি কখনো ঘটেনি। ইতিহাসে ত্রিশ বছরের মধ্যে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে ষোল কোটি মানুষ এবং তারপর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ কোটি মানুষ এত কম সময়ের মধ্যে কখনই হতাহত হয় নি। এত অন্যায়ও মানুষের ইতিহাসে আর কখনো হয়েছে কিনা সন্দেহ। তার চেয়েও বড় কথা, মানব জাতি আণবিক যুদ্ধ করে আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা আজকের, বর্তমানের। রসুলাল্লাহর (সা.) পৃথিবীতে আসার চৌদ্দশ’ বছর পর। তাহলে তিনি কেমন করে পৃথিবীর মানুষের জন্য রহমত? এর জবাব হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাঁকে (সা.) যে জীবনব্যবস্থা, দীন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সেই দীন মানব জাতির উপর সমষ্টিগতভাবে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করলে যে শান্তি, সুবিচার, নিরাপত্তা মানুষের জীবনে নেমে আসবে সেটা হলো আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া। কারণ তিনি ঐ জীবনব্যবস্থা না দিলে মানুষ কখনই তা নিজেরা তৈরি করে নিতে পারতো না। সেই জীবনব্যবস্থা, দীন, সংবিধান তিনি যার মাধ্যমে মানুষকে দিলেন তাকে তিনি উপাধি দিলেন ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’। কিন্তু যতদিন না সমগ্র মানব জাতি নিজেদের তৈরি জীবনব্যবস্থা সমূহ পরিত্যাগ করে মোহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ করবে ততদিন তারা সেই অশান্তি, অন্যায় (ফাসাদ) ও যুদ্ধ, রক্তপাতের (সাফাকুদ্দিমা) মধ্যে ডুবে থাকবে, আজকের মতো এবং ততদিন বিশ্বনবীর (সা.) ঐ উপাধি অর্থবহ হবে না, অর্থপূর্ণ হবে না এবং আজও হয় নি। তাঁর উম্মাহ ব্যর্থ হয়েছে তার (সা.) উপাধিকে পরিপূর্ণ অর্থবহ করতে। তবে ইনশা’আল্লাহ সেটা হবে, সময় সামনে। স্রষ্টার দেওয়া উপাধি ব্যর্থ হতে পারে না, অসম্ভব। সুতরাং আজ হোক আর কাল হোক সমস্ত মানবজাতি তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নেবে। এবং তাঁর মাধ্যমে পাঠানো দীনুল হক কে তাদের সমষ্টিগত জীবনে কার্যকর করবে।
দ্বিতীয় কারণ: আসছে নবুয়াতের আদলে খেলাফত
আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “আল্লাহ যতদিন চান ততদিন তোমাদের মাঝে নবুওয়াত থাকবে (অর্থাৎ তিনি নিজেই), তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত। যতদিন আল্লাহ চান ততদিন তা থাকবে তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে মুলকান (রাজতন্ত্র), যতদিন আল্লাহ চান ততদিন তা থাকবে অতঃপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে জাবারিয়াত (শক্তি প্রয়োগ, জোর-জবরদস্তিমূলক শাসন)। এরপর আবারো আসবে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত।” (দালায়েলুম নবুয়াত, বায়হাকী, মুসনাদ-আহমদ বিন হাম্বল, মেশকাত)
রসুলাল্লাহর এই ভবিষ্যদ্বাণীটি এখন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রথম তিনটি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। বর্তমানে চলছে জাবারিয়াত অর্থাৎ পাশ্চাত্য ইহুদি-খ্রিষ্টান তথা দাজ্জালের জোর-জবরদস্তিমূলক শাসন (গরমযঃ রং ৎরমযঃ)। এর পরেই সামনে আসছে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত। আল্লাহর রসুলের এই কথা থেকেই বোঝা যায় যে, আখেরী যুগে, অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে এই জাতি আবারো জাগবে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন এসে যায় যে, কাদের দ্বারা জাগবে? কারা এই ঘুমন্ত জাতির কালঘুম ভাঙ্গাবে?
আল্লাহর রসুল বলেছেন, “আমার উম্মাহর মাঝে সকল সময়ই একদল লোক থাকবে যারা, সর্বাবস্থায় আল্লাহর আদেশ নিষেধ বলবৎ করবে।” এই ফেরকা সম্পর্কেই আল্লাহর রসুল বলেছেন তেহাত্তর ফেরকার মাঝে একমাত্র জান্নাতি ফেরকা। এই জান্নাতি ফেরকাকেই এখন মাঠে নামতে হবে। জাতির কালঘুম ভাঙ্গানোর জন্য তাদের চেতনায় যতবড় আঘাত করার দরকার তাই করতে হবে। এই জান্নাতি ফেরকার কোন মানুষকে যদি বাকি বাহাত্তর ফেরকার কেউ প্রশ্ন করে যে, আপনি শিয়া না সুন্নি, না আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত, না আহলে হাদিস, হানাফি না শাফেয়ী, মালেকী না হাম্বলী না অন্য কিছু? তবে তার জবাব হবে ভাই, আমি ওসবের কোনটাই নই। আমি তো শুধু প্রাণপণে চেষ্টা করছি মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মাদী হতে।
জান্নাতি ফেরকার অন্যতম কর্তব্য হবে মুসলিম নামধারী জাতিটিকে প্রশ্ন করা যে, সর্বদা আল্লাহর রসুলের সঙ্গে থেকে, তাঁর সাথে প্রতিটি সংগ্রামে সঙ্গী হয়ে সরাসরি তার কাছে থেকে যারা ইসলাম কী, তা শিখেছিলেন তারাই ঠিক ইসলাম শিখেছিলেন, নাকি আজকের মাওলানারা, মৌলবীরা, পীর মাশায়েখরা যে ইসলাম শেখাচ্ছেন সেটা ঠিক? বর্তমানে আমরা ইসলাম মনে করে যে দীনটাকে আঁকড়ে আছি এটার বাইরের চেহারা মোটামুটি আল্লাহর রসুলের মাধ্যমে আসা দীনের মতই মনে হয়। বাইরে থেকে যেগুলো দেখা যায় যেমন যেকের, আসকার, নামাজ, রোজা, হজ্ব, দাড়ি, টুপি, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি নানাবিধ কার্যকলাপ; কিন্তু ভেতরের চরিত্র নবীজীর ইসলামের একেবারে বিপরীত, সরাসরি বিপরীত। এছাড়াও জান্নাতি ফেরকার অন্যতম কাজ হবে এই জাতির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বাহাত্তর ফেরকাকে ডেকে বলা যে, আপনারা যত ফেরকা, মাজহাবে বিভক্ত হয়ে থাকুন আপনারা এক আল্লাহয়, এক নবীতে এবং এক কোর’আনে বিশ্বাসী তো? তাহলে জাতির এই দুঃসময়ে, যখন ঐক্য এত প্রয়োজনীয়, এখন শুধু এর উপর সবাই একত্র হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। মাজহাবের ফেরকার যে অনৈক্য আছে তা যদি বিলুপ্ত করতে না পারেন, তবে ঐক্যের খাতিরে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে দিন। বাইরে আনবেন না। শিয়া শিয়াই থাকুন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রে আপনারা আপনাদের মাজহাব মেনে চলুন কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে, জাতীয় ঐক্যের খাতিরে সুন্নিদের পাশে এসে দাঁড়ান। সুন্নি সুন্নিই থাকুন, ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক ব্যাপারে কিন্তু জাতীয়ভাবে শিয়ার পাশে এসে দাঁড়ান। এমনভাবে হানাফি, শাফেয়ী, হাম্বলী, মালেকী ইত্যাদি যত রকমের দুর্ভাগ্যজনক জাতি ধ্বংসকারী বিভক্তি আছে সব ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এক আল্লাহর, এক নবীতে বিশ্বাসী হিসাবে, এক জাতি হিসাবে এক মঞ্চে এসে দাঁড়ান ও আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানুষের কল্যাণে সংগ্রাম করুন। শিয়া-সুন্নী উভয়কে বলতে চাই, বর্তমানে আপনারা এই যে পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, বাহরাইন, ইয়েমেন, সৌদি আরবসহ প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে দাঙ্গা চালাচ্ছেন, একে অপরকে গুলি করে হত্যা করছেন; আপনাদের মধ্যে কারা জান্নাতে যাবেন বলুন দেখি? আসলে মহানবীর ভাষ্যমতে কেউই জান্নাতি না। কাজেই আর না, এবার দয়া করে থামুন, যথেষ্ট হয়েছে। এক আল্লাহই, এক রসুলে এবং এক কোর’আনে বিশ্বাসী এই জাতি যদি জান্নাতি ফেরকার এই ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে জান্নাতি ফেরকার কিছুই করার নেই। তারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কাছে সাফ থাকবেন। তবে ডাকের মতো ডাক দিতে হবে। যেমন করে নবী রসুলরা চিরকাল ডাক দিয়ে এসেছেন। তাঁদের প্রচণ্ড বিরোধিতা করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে, নিপীড়ন করা হয়েছে। কিন্তু তাদের ডাক বন্ধ করা যায় নি। শত অত্যাচার সহস্র বিরোধিতা তাদের নিবৃত্ত করতে পারে নি। এই ফেরকার নিরাশ হবার কোন কারণ নেই। এই ফেরকা জান্নাতি কেন? রসুলাল্লাহর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী বলেই তো। তাহলে তিনি কত অত্যাচার, কত বিরোধিতা, কত অপমান ও নিগ্রহ সহ্য করেছেন সে উদাহরণ তো তাদের সামনেই আছে। তবে ভয় কিসের? জান্নাতি ফেরকা তো আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না।
লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ
ফেসবুক: https://www.facebook.com/emamht