একটা সমাজে যখন অন্যায় বিস্তারলাভ করে, মিথ্যা বিজয়ী হয়, মানুষে মানুষে অনৈক্য আর হানাহানি চলতে থাকে, অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়, ক্ষমতাবানদের কথাই সঠিক বলে গণ্য হয়, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি আর প্রতারণা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়, ধর্ষণ, ব্যভিচার নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে যায়, ধর্ম যখন ব্যবসার হাতিয়ারে পরিণত হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে ঐ সমাজকে আর সংস্কার করা যাবে না বরং ঐ সমাজ ধ্বংস করে নতুন সমাজ নির্মাণ করতে হবে। নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্যই যুগে যুগে নবী-রসুল এসেছেন। সকল নবী-রসুলের সমাজ পরিবর্তনের মূলসূত্র একই, সেটা হলো- “তোমরা বলো, আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই।” এই কথা বলার সাথে সাথে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ, পূর্বের ধর্মের পুরোহিতগণ (আলেমগণ) সেই নবীর চরম বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে। নবীদের উপর, তাদের সঙ্গী-সাথী বা সাহাবাদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যাচার হয়েছে, দীনের উপর টিকে থাকাটাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পুরাতন, পচা, মিথ্যাচ্ছন্ন ঐ সমাজ ধ্বংস করে নতুন এক সমাজ, নতুন এক সভ্যতা বিনির্মাণের জন্য এমন একদল মানুষের প্রয়োজন হয়েছে যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের জীবন, সম্পদ, সম্মান, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন সর্বস্ব কোরবান দিতে প্রস্তুত। অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তনের জন্য, দীন কায়েমের জন্য ত্যাগ, কোরবানি অপরিহার্য। এই কোরবানি মানে ১০ জিলহজে কেবল গরু জবাই করা কোরবানি নয় বরং ইব্রাহিম (আ.) এর মতো নিজের সন্তানকেও আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করা লাগতে পারে, ইসমাইল (আ.) এর মতো নিজের গর্দান ছুরির নিচে সোপর্দ করা লাগতে পারে। এ কারণেই মুসলিম উম্মার শিক্ষা দেবার জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র হজ অনুষ্ঠানে ইব্রাহিম (আ.) এর সেই কোরবানির ঘটনাকে স্মরণ করে পশু জবাই দেওয়াকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন সামর্থ্যবান হাজিদের জন্য।
রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর আসহাবগণ কেবল পশু জবাই করার মধ্যেই কোরবানিকে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং তাঁরা তাঁদের জীবন ও সম্পদ পূর্ণরূপে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে দিয়ে হেদায়াহ ও সত্যদীন কায়েম করেছেন, নতুন এক সমাজ বিনির্মাণ করেছেন, যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
মোহাম্মদ (সা.) এর কোরবানি
অতীতে যত নবী-রসুল (আ.) এসেছেন তাঁরা সবাই এসেছেন একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল, নির্দিষ্ট গোত্র ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্ধারিত অঞ্চল বা সমাজের বাইরে দীনের দাওয়াত দেওয়াও তাঁদের অনেকের জন্য নিষেধ ছিল। কিন্তু শেষ নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এবং শেষ দীন ইসলাম এসেছে সমগ্র মানবজাতির জন্য, সমগ্র পৃথিবীর জন্য। কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী-রসুল আসবেন না, আর কোনো দীন আসবে না। কাজেই মহানবী (সা.) এর দায়িত্ব নিঃসন্দেহে বিরাট। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি আমার আপন রসুলকে প্রেরণ করেছি হেদায়াহ ও সত্যদীন সহকারে, যেন তিনি এটাকে (ঐ হেদায়াহ ও সত্যদীনকে) অন্যান্য সমস্ত দীনের (জীবনব্যবস্থার) উপর প্রতিষ্ঠিত করেন, কায়েম করেন’। (সুরা তওবা- ৩৩; সুরা ফাতাহ- ২৮; সুরা সফ- ৯)। অর্থাৎ আল্লাহ শেষ নবীর উপর দায়িত্ব দিয়েছেন এই শেষ দীনকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার। বোঝাই যাচ্ছে, এত বড় কাজ করতে কী অপরিসীম ত্যাগ, অপরিসীম কোরবানি লাগবে। মহানবী (সা.) যেদিন নবুয়্যত পেয়েছেন সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে তাঁর অপরিসীম কোরবানি, অসম্ভব ত্যাগ স্বীকার করা। নব্যুয়ত পাবার সাথে সাথে তিনি যখন আম্মা খাদিজার মাধ্যমে ওরাকা বিন নওফেলকে জানালেন তখন ওরাকা বিন নওফেল বলেছিলেন, খুব দ্রুতই আপনার আপনজনেরা আপনাকে ত্যাগ করবে, আপনার উপর অত্যাচার নেমে আসবে, আপনার নিজ জন্মস্থান থেকে আপনাকে বিতাড়িত করা হবে। কিছুদিনের মধ্যে সেটাই শুরু হলো। আম্মা খাদিজা (রা.) ছিলেন মক্কার সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী। কোনো কোনো ঐতিহাস বলেছেন, মক্কার বড় বড় ব্যবসায়ীদের মালামাল একসাথে করলেও আম্মা খাদিজার ব্যবসায়ের সমান হতো না। রসুলাল্লাহর সাথে বিয়ে হবার পর থেকে সেই ব্যবসা দেখাশুনা করতেন রসুলাল্লাহ (সা.) নিজে। তাঁর হাতের বরকতে ব্যবসা আরও বড় হতে থাকে। কিন্তু নব্যুয়তের পর এই ব্যবসাতে তিনি আর তেমন সময় দিতে পারতেন না, ফলে ব্যবসা সংকুচিত হতে থাকে। প্রথম দিকে যারা দীন গ্রহণ করেছেন তাদের বেশিরভাগ ছিল দাস-দাসী, অত্যন্ত দরিদ্র, সমাজের নিগৃহীত শ্রেণির মানুষ। তাদের বিপদ-আপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রসুলাল্লাহ (সা.) ও কয়েকজন বিত্তশালী সাহাবাগণ। দীন প্রচারের কাজে যে অর্থ ব্যয় হতো তারও সিংহ ভাগ বহন করতেন রসুলাল্লাহ (সা.)। এভাবে তিনি একদিকে ধনী থেকে দরিদ্র হতে লাগলেন অপর দিকে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল। এক পর্যায়ে শুরু হলো নানামুখী অত্যাচার-নির্যাতন।
রসুলাল্লাহ (সা.) একদিকে ছিলেন উচ্চ বংশীয়, ক্বাবার মোতোয়াল্লী পরিবারের সন্তান, অন্যদিকে সফল ও ধনী ব্যবসায়ী। সততা, ন্যায়-নিষ্ঠতা, আমানতদারিতার জন্য তিনি ছিলেন সকলের নিকট সম্মানিত। বয়োজ্যেষ্ঠরাও তাঁকে সম্মান করত। তাঁর মুখের উপর কথা বলে এমন হিম্মত ঐ সমাজের কারো ছিল না। কিন্তু যখনই কলেমার দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন তখনই শুরু হয়ে গেল চরম বিরোধিতা। যারা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার হিম্মত রাখত না তারাও শুরু করল উপহাস করা। সালাহরত অবস্থায় তাঁর মাথার উপর উটের নাড়ি-ভুড়ি চাপিয়ে দেওয়া হলো, তাঁকে নানা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হলো। কিন্তু তিনি সত্যের উপর রইলেন পর্বতের মতো অনড়, অটল। কোনোভাবেই যখন তাঁকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না তখন কুরাইশ নেতারা তাঁকে প্রস্তাব দিল- আরবের রাজত্ব, অর্থ-বিত্ত ও সুন্দরী নারী সব দেওয়া হবে যদি তিনি এই কলেমার বালাগ বন্ধ করে দেন। রসুলাল্লাহ (সা.) তাদের এই প্রস্তাবের জবাবে সেদিন বলেছিলেন, “আমার এক হাতে যদি চন্দ্র ও আরেক হাতে সূর্যও এনে দাও তবু মোহাম্মদ এই পথ (কলেমার পথ, সত্যের পথ) ছাড়বে না, হয় আল্লাহর বিজয় হবে না হলে এই রাস্তায় মোহাম্মদ শহীদ হয়ে যাবে।”
নব্যুয়তের সপ্তম বছরে যখন রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর আসহাবদের সাথে তাঁর গোত্র বনু হাশিমের লোকদেরকে শিয়াব’এ আবু তালিব-এ বন্দী করে রাখা হয় তখন তাঁদের দিন কেটেছে অনাহারে-অর্ধাহারে। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়তে হয়েছে তাঁদের। এমনও হয়েছে যে, কেবল গাছের লতা-পাতা খেয়ে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। পুষ্টিহীনতায় মায়েদের বুকে দুগ্ধ হয়নি, শিশুরা মারা গেছে বাবা-মায়ের চোখের সামনে। এই অবস্থা চলেছে তিন বছর। এই শিয়াব’এ আবু তালিবের বন্দী দশা থেকে মুক্তি পাবার পর আম্মা খাদিজা (রা.) পুষ্টিহীনতার কারণে ইন্তেকাল করেছেন। একই বছরে রসুলাল্লাহর (সা.) চাচা আবু তালিবকেও হারান। এরপর তায়েফে যান দীনের দাওয়াত নিয়ে, কিন্তু সেখানে শুধু প্রত্যাখ্যাতই হননি বরং চরমভাবে তাঁকে অত্যাচার করা হয়। পাথরের আঘাতে আঘাতে তাঁকে রক্তাক্ত করা হয়, বার বার তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন আবার জ্ঞান ফিরে হেঁটেছেন। এভাবে মক্কার ১৩ টি বছর কেটেছে অত্যাচার-নির্যাতন, অভাব-দারিদ্র নিয়ে। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও দীনের খেদমত থেকে তিনি পিছপা হননি, শিরক ও কুফরের সামনে মাথা নত করেননি। এরপর যখন তিনি মদীনায় আসলেন তখন তাঁকে মদীনার সমাজের প্রধান হিসাবে সকলে গ্রহণ করে নিল। মদীনাকে তিনি তৈরি করলেন এক আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে। কিছুদিনের মধ্যে শুরু হলো চতুর্দিকে অভিযান, যুদ্ধ, কেতাল। যুদ্ধ মানেই জীবনের ঝুঁকি, যুদ্ধ মানেই জীবন ও সম্পদের অসম্ভব কোরবানি। মাদানী জীবনের ১০ টা বছর রসুলাল্লাহকে (সা.) নিরন্তর কেবল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে, কেননা তাঁর লক্ষ্য ছিল সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া হেদায়াহ ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা। সামান্য ১০ বছরের এই সময়ে তিনি ছোট-বড় দিয়ে ১০৭টি অভিযান পরিচালনা করেন, ২৭ টি যুদ্ধাভিযানে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। উহুদ যুদ্ধে তিনি চরমভাবে আহত হয়েছেন, মাথার মধ্যে হেলমেট ঢুকে গিয়েছে, কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করেছে মোশরেকরা। কিছু নিবেদিতপ্রাণ সাহাবাদের অসম্ভব কোরবানির বিনিময়ে কাফের-মোশরেকরা রসুলাল্লাহ (সা.) কাছে পৌঁছুতে পারেনি। আহযাবের যুদ্ধে পরিখা খননে নিজে অংশগ্রহণ করেছেন, প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়েও কাজ করেছেন পেটে পাথর বেঁধে। তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই ৩২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করে রেখে গেছেন। এত সংগ্রাম, এত যুদ্ধ জয়, এত ভূখণ্ড জয় করার পরও তাঁর ইন্তেকালের সময় সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না, কেবল ছিল ৯ টি তরবারিসহ কয়েকটা যুদ্ধাস্ত্র আর চাটাইয়ের পাটি, খেজুরের খোসা ভর্তী বালিশ। এ থেকেই বোঝা যায় তাঁর জীবনে তিনি কেমন কোরবানি করেছেন। তিনি নিজের জীবনটাকে কোরবানি করার জন্য এমনভাবে আকাক্সক্ষা করেছেন যে, তিনি বলেন, আমার উপর যদি নব্যুয়তের মহান দায়িত্ব না থাকত তাহলে আমি আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করতে করতে শহীদ হয়ে যেতাম, আবার আল্লাহ আমাকে জীবিত করে দিতেন আমি আবার শহীদ হতাম- এভাবে চারবার শহীদ হবার আকাক্সক্ষা পোষণ করেছেন। এই কোরবানি, এই ত্যাগের মাধ্যমেই তিনি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। জীবন-সম্পদের এই অপরিসীম কোরবানির পাশাপাশি তিনি পশু কোরবানিও করেছেন। আনাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘একদা রসুলাল্লাহ (সা.) দুটি ধুসর বর্ণের শিংওয়ালা দুম্বা কোরবানি করছিলেন। তিনি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে তা নিজ হাতেই জবাই করেছিলেন। হজরত আনাস বলেন, আমি মহানবীকে (সা.) এর পাঁজরের ওপর পা রাখতে দেখেছি এবং জবাই করার সময়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলতে শুনেছি (সহিহ মুসলিম)।
আমাদের জন্য শিক্ষা
আমরা কোরবানির অর্থ বুঝি কেবল বছরের একটা নির্দিষ্ট দিনে পশু জবাই দেওয়া। সেই পশু জবাই করা কোরবানিটাও রসুলাল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ অনুসারে পালন করি না। তিনি নিজ হাতে পশু কোরবানি করতেন কিন্তু আমরা মোল্লা ভাড়া করে পশু কোরবানি করি। আমাদের সমাজে কোরবানি হয়ে গেছে এক প্রকার শো-আপ, কে কত বড় কোরবানি দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে, আর কোরবানির গোস্ত ফ্রিজে রেখে সারা বছর সেটা ভক্ষণ চলে। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) এর জীবনী থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে তিনি নিজের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় অকাতরে বিলিয়ে গেছেন, কীভাবে তিনি দীনের কাজ করে গেছেন। এখন আমরা যদি সত্যকার অর্থে তাঁর অনুসরণ করতে চাই তাহলে আমাদেরকেও আল্লাহর দীন কায়েমে নিজেদের জীবন ও সম্পদ এভাবেই উৎসর্গ করতে হবে, কোরবানি করতে হবে। এই কোরবানির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব, মোর্কারাবুন হতে পারব ইনশাল্লাহ।