প্রাগৈতিহাসিক তথা প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা মানব জীবনের বেঁচে থাকা, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন- তথা মানব সম্পদ সৃষ্টির অন্যতম অনুষঙ্গ। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত আত্মপরিচয় লাভ করে, তার আশপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে মানব উন্নয়নে যথার্থ অবদান রাখতে পারে। তাই মানবজাতির সামগ্রিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে সে শিক্ষাকে অবশ্যই সুশিক্ষা হতে হবে। যে শিক্ষা মানুষকে আলোর সন্ধান দেয় না, যে শিক্ষা মানব উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, মানুষকে পশ্চাদপদ করে রাখে, স্রষ্টার দানকৃত জ্ঞানের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, সে শিক্ষা কখনোই সুশিক্ষা নয়। ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে মানুষ মানবতার কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হয় না, বরং তা অকল্যাণের আধারে পরিণত হয়। মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা তেমনই। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা চালু রয়েছে। প্রতিদিন কোটি কোটি মোসলেম পরিবারের ছেলে-মেয়ে সেখানে শিক্ষালাভ করছে। কিন্তু সেটা কোন শিক্ষা? তারা এমন শিক্ষা লাভ করছে যে শিক্ষা মানুষের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যে শিক্ষা একুশ শতকের মানবজাতির অন্যতম হাতিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় আবিষ্কার রেডিও-টেলিভিশনের জায়েজ-নাজায়েজ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যে শিক্ষা মানুষের হিতাহিত বোধ লুপ্ত করে দেয়, মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে অন্ধত্বকে প্রতিষ্ঠা করে, যে শিক্ষায় মানুষের মন-মগজকে আবদ্ধ রাখা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে, আর তার বাইরের পৃথিবী থেকে যায় অজানা। এমন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষুদ্র কুটিরে বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আবদ্ধ করে রেখে বর্তমান মোসলেম জাতি কস্মিনকালেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে না। তার মানে এই নয় যে, মোসলেম জাতি শিক্ষার্জন বন্ধ করে অশিক্ষার তিমিরে প্রবেশ করবে। আমার কথা হলো তারা যে শিক্ষা অর্জন করবে তা যেন সুশিক্ষা হয়, অশিক্ষা না হয়। আর তার জন্যই সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবর্তন সাধন করে বিরাট আকারের এই মাদ্রাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা। কারণ, মোসলেম জাতিকে আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। শিক্ষা-দীক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আবিষ্কার ও যথাযথ ব্যবহার তথা জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারা আজ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদেরই রচিত করা স্তম্ভের উপর আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। সেই স্বর্ণযুগকে আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে। আমি আবারও বলছি- এই জাতিকে অশিক্ষা নয়, প্রকৃত শিক্ষার চর্চা করতে হবে। হয় প্রচলিত মাদ্রাসার চার দেয়ালের বন্ধন ছাড়তে হবে, নয় তো সে মাদ্রাসাকেই পরিণত করতে হবে আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্রভূমিতে। আমি নিশ্চিত যে, আমার এই কথায় আপত্তির কোনো অন্ত থাকবে না। কারণ বর্তমান মোসলেম জাতির কাছে না যুক্তির মূল্য আছে, না জ্ঞানের। এই জাতির জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি গচ্ছিত রাখা হয়েছে ধর্মব্যবসায়ীদের মস্তকে। আর ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-পুরুতরা জ্ঞানের অহংকারে এতটাই স্ফীত যে যুক্তের দাম তারা দিতে জানে না। আমার কথায় সবচেয়ে বেশি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে এই শ্রেণিটি। কিন্তু তারপূর্বে অন্তত একবার নিচে তুলে ধরা যুক্তিগুলো নিরপেক্ষ মনে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি।
১। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র:
ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক শক্তিবলে মোসলেম নামধারী এই জাতিটির প্রায় সম্পূর্ণ ভৌগোলিক অংশ দখল করার পর সর্বপ্রথম যে বৃহৎ পদক্ষেপ নিল তাহলো শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা। উদ্দেশ্য- পদানত এই জাতিকে এমন একটা ইসলাম শিক্ষা দেয়া যাতে তাদের চরিত্র প্রকৃতপক্ষেই একটা পরাধীন দাস জাতির চরিত্রে পরিণত হয়, তারা কোনদিন তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চিন্তাও না করে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং কীভাবে সফল হয়েছিল তা বোঝাতে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশকেই আলোচনায় আনা যাক। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই উপমহাদেশে আগত খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদরা সর্বপ্রথম বহু গবেষণা করে তাদের মনমত Syllabus I Curriculum তৈরি করে। এরপর এই উপমহাদেশের ভাইসরয় বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংকস ১৭৮০ সনে তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ঐ সিলেবাস ও কারিকুলাম চালু করলো। এই শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম ও মোসলেম জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসরূপ নিুলিখিত বিকৃতিগুলো চালু করা হলো-
(ক) প্রাচ্যবিদদের তৈরি করা সিলেবাস ও কারিকুলামে ইসলামের আত্মা তওহীদের অর্থ বিকৃত করা হলো। লা এলাহা এল্লাল্লাহ-র অর্থ প্রকৃত ‘আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নেই’কে বদলিয়ে করা হলো- আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই, যেটাকে আরবিতে ভাষান্তর করলে হয়- লা মা’বুদ এল্লাল্লাহ।
(খ) ব্রিটিশ শাসকরা এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে প্রধানতঃ বিতর্কিত বিষয়গুলির প্রাধান্য দিল, যেগুলো অতি আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল এমামদের এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে, কোর’আনের আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে।
(গ) খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদদের তৈরি ঐ ইসলামে কোর’আনের গুরুত্ব একেবারে কমিয়ে দিয়ে সেখানে হাদিসের প্রবল প্রাধান্য দেয়া হলো। কারণ হাসিদের মাধ্যমে বেশি বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়। কিন্তু কোর’আনে সেটার সুযোগ খুবই কম।
(ঘ) তারা তাদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তাদের তৈরি করা বিকৃত ইসলামে যে শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু কোরল তাতে অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থ-বিজ্ঞান, জীব-বিদ্যা ইত্যাদির কোন কিছুই রাখা হলো না। খ্রিস্টানরা এটা এই উদ্দেশ্যে কোরল যে, তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষিত এই মানুষগুলো যেন ওখান থেকে বেরিয়ে যেয়ে তাদের শেখানো বিকৃত ইসলামটাকে বিক্রি করে পয়সা উপার্জন করা ছাড়া আর কোন পথে উপার্জন করতে না পারে।
এ শিক্ষাব্যবস্থায় অর্ধশতাব্দীর পর্যবেক্ষণের পর তারা যখন দেখলো যে- এ থেকে তাদের আশানুরূপ ফল আসছে না, তখন মোসলেম বলে পরিচিত এই জাতিটাকে নিজেদের তৈরি বিকৃত ইসলামের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য পঙ্গু, অথর্ব করে নিজেদের শাসন দীর্ঘদিনের জন্য পাকাপোখ্ত করার এই জঘন্য পরিকল্পনা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ খ্রিস্টান শাসকরা তাদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদটিও নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন ডঃ স্প্রিংগার। তারপর একাধিক্রমে ২৬ জন খ্রিস্টান ৭৬ বৎসর (১৮৫০-১৯২৭) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে আসীন থেকে এই মুসলিম জাতিকে ইসলাম শিক্ষা দিলেন। দীর্ঘ ১৪৬ বছর ইসলাম শিক্ষা দেবার পর ব্রিটিশরা যখন নিশ্চিত হলো যে, তাদের তৈরি করা বিকৃত ইসলামটা তারা এ জাতির হাড়-মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং আর তারা কখনও এটা থেকে বের হতে পারবে না তখন তারা ১৯২৭ সনে তাদের আলীয়া মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষিত মওলানা শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন আহমেদ (এম.এ.আই.আই.এস) এর কাছে অধ্যক্ষ পদটি ছেড়ে দিল। [দেখুন- আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আ: সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Foundation Bangladesh)। এটা শুধু আমাদের এই উপমহাদেশেই ঘটেছে তা নয়, একই পলিসি ইউরোপীয়ানরা তাদের অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও কার্যকর করে। তাদের সেই ষড়যন্ত্রের ফসল আজকের মাদ্রাসাগুলো। আলীয়া মাদ্রাসার বাইরে কওমী ধাচের যে মাদ্রাসাগুলো আমাদের দেশে চলছে সেগুলোর অবস্থা আরও করুণ। এদের অন্ধত্ব ও পশ্চাদমুখীতা সর্বব্যাপী সমালোচিত। এদের জ্ঞান-বুদ্ধি, মস্তিষ্ক ও বিবেক সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে হাদিস-কোর’আনের পাতা, আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা ও দাড়ি-টুপি, পাঞ্জাবি, পাজামা, ঢিলা-কুলুখের ভেতরে। এর বাইরের পৃথিবী এদের অপরিচিত। এদের দ্বারা মানবজাতির অগ্রগতি, উন্নতি বা কল্যাণ সাধন অসম্ভব। কাজেই তাদের সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
২। শিক্ষার উদ্দেশ্যই যখন অনুপস্থিত: মানুষ শিক্ষা লাভ করে কেন? সে শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে মানবজাতির উন্নয়ন সাধনের জন্য, তাই নয় কি? একজন মানুষ সর্বপ্রথম তার স্রষ্টা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে। স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক নির্ণয় করবে। মানুষ হিসেবে স্রষ্টা তাকে কী কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তার ধারণা লাভ করবে। সে এই প্রশ্নের উত্তর বের করবে যে, ‘আমি কে? আমি কোথা থেকে আসলাম? আমাকে কে সৃষ্টি করেছেন? কেন সৃষ্টি করেছেন এবং এখন আমার কাজ কী?’ এ প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর লাভ করাই হলো একটি শিশুর প্রাথমিক জ্ঞান। এই জ্ঞানকে পুঁজি করে সে তার পরবর্তী জীবনের কর্মপদ্ধতি নির্দিষ্ট করবে। সে জানবে যে, “আমি মানুষ, আমাকে স্রষ্টা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। স্রষ্টার ন্যায়সঙ্গত বিধান দিয়ে এই পৃথিবীকে পরিচালনা করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই হলো আমার লক্ষ্য। যতদিন পৃথিবীতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে, পৃথিবীতে অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন অব্যাহত থাকবে ততদিন আমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে। আমার লক্ষ্য অবাস্তবায়িত থাকবে।” এই শিক্ষা যখন একজন মানুষ তার শিক্ষাজীবনে লাভ করবে তখন তার দ্বারা কি কোনো অন্যায় কাজ করা সম্ভব? সে কি কখনো অন্ধত্বকে পুঁজি করে বিশ্ব অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? সে কি কস্মিনকালেও ধর্মীয় উন্মাদনা বা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে পারে? মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর খাড়া করতে পারে? পারে না। কিন্তু আজকের মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা কী দেখতে পাই? মানুষে মানুষে যত রকমের বিভেদের প্রাচীর দাঁড় করানো সম্ভব তার কোনোটাই এই ধর্মব্যবসায়ী মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটি বাদ রাখে নি। এমনকি তারা নিজেরা নিজেরাও একতাবদ্ধ নয়। হানাফি, হাম্বলি, মালেকি, শাফেয়ি, আহমদী, মোহাম্মদী, আহলে হাদিস, শিয়া, সুন্নি, কওমী ইত্যাদি শত শত ফেরকা-মজহাবের প্রাচীর দাঁড়িয়ে রয়েছে এদের নিজেদের মধ্যেই। এক ফেরকার সাথে আরেক ফেরকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ, রক্তারক্তি চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্মব্যাপী। আর এই বিভেদের মন্ত্র তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লাভ করছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসার মাধ্যমে। পশ্চিমারা ঠিক এটাই চেয়েছিল।
৩। ধর্মব্যবসা নামক গুরুতর অন্যায়ের প্রশ্রয়: মাদ্রাসাগুলো থেকে শিক্ষালাভ করে যারা বের হন তারাই সমাজে পরিচিত হন মাওলানা, মোহাদ্দিস, মোফাসসির, আলেম-ওলামা, হাফেজ, কামেল, পীর, বুজুর্গ, মুফতি ইত্যাদি হিসেবে। সমাজে এদের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। ধর্মীয় ফতোয়া দেওয়া, কোর’আন পড়া, মৃতের জানাজা-দাফন-কাফন সম্পন্ন করা, মিলাদ পড়া, জিকির করা, চল্লিশার দাওয়াত খাওয়া, নামাজে ইমামতি করা, মাহফিলে ওয়াজ করা, দান সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজ মূলত করে এরাই। আর এভাবেই সংসার চলে অধিকাংশ মাওলানা-আলেম সাহেবদের। এ সকল ধর্মীয় কাজের মধ্যে ব্যাপৃত থাকায় তারা কোনো কায়িক শ্রম বা অন্য কোনোভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না বা করেন না। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তারা স্বাবলম্বী নন। কার্যত তাদের জীবন-সংসার চলে পরজীবী বেশে। এদের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছেন যারা ওয়াজ-নসিহত করে রাতারাতি লাখপতিও বনে যান। মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটির এই পরজীবী চরিত্রের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এখন দেখা যাক, এদের এই কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কি না।
প্রকৃতপক্ষে ধর্ম কোনো পণ্য নয়, ধর্মীয় কাজ কোনো পেশা নয়। মানুষ ধর্মীয় কাজ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়, এর বিনিময়ও গ্রহণ করবে কেবল আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর সকল নবী-রসুল এই কথা ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় আল্লাহর কাছে।’ (আল কোর’আন- হুদ: ২৯, হুদ: ৫১, শুয়ারা: ১৪৫, শুয়ারা: ১৮০, ইউসুফ: ১০৪) সুতরাং তাঁদের উম্মতের জন্যও একই বিধান। কিন্তু তা না করে যখন কেউ কিছু ধর্মীয় জ্ঞান আয়ত্ব করে সেটাকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করে তখন আর সেটা ধর্মের কাজ হয় না, সেটা ব্যবসা হয়। পবিত্র কোর’আনে এবং হাদিসে ধর্মব্যবসার সবগুলি ধরণ সম্পর্কেই নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ধর্মকে বিক্রি করে পার্থিব সুযোগ সুবিধা, সম্পদ হাসিলের কোন সুযোগ আল্লাহ রাখেন নি। তিনি একে কেবল হারামই করেন নি, তিনি বলেছেন, যারা এটা করে তারা পথভ্রষ্ট, তারা আগুন ছাড়া কিছুই খায় না। তিনি আখেরাতে তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুরা আল বাকারা ১৭৪)। এছাড়াও আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, তোমরা তাদের অনুরসণ করো যারা বিনিময় গ্রহণ করে না এবং সঠিক পথে আছে (সুরা ইয়াসীন ২১)। সে হিসেবে মোসলেম বিশ্বে বিশাল-বিস্তৃত ডানা মেলে বসে থাকা মাদ্রাসাশিক্ষিত ধর্মজীবী পুরোহিত শ্রেণির অবস্থান কোথায় দাঁড়াল? বস্তুত এই ধর্মজীবীরা শুধু নিজেরাই জাহান্নামের দিকে যাচ্ছে না, সাথে আমাদেরকেও নিয়ে যাচ্ছে। আর সে পথ সুগম করছে মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসায় প্রদত্ত বিকৃত শিক্ষা। একটি সহজ সরল শিশু পবিত্র হৃদয়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করছে। কিন্তু এরপর সেখান থেকে শিক্ষালাভ করে ধর্মব্যবসায়ী আগুনখোর, অপবিত্র ও পরজীবী হয়ে বের হয়ে আসছে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? আমাদের বিবেক কী বলে?
৪। জঙ্গিবাদের প্রজননক্ষেত্র: ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা থেকেই জঙ্গিবাদের জন্ম। জঙ্গিদেরকে শেখানো হয় অমুক নাস্তিক, অমুক কাফের, অমুককে মারলে জান্নাত নিশ্চিত। এসব বলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সুবিধা আদায় করে ধর্মব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অধিকাংশ জঙ্গিবাদী গ্র“পের নেতারাই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষালাভ করে জঙ্গি হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো প্রথমে তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বানিয়েছে, আর এ ধর্ম নিয়ে ব্যবসাই হচ্ছে ধর্মভিত্তিক অপ-রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের সূতিকাগার। ধর্মব্যবসায়ীরা যেটাকে ইসলাম বলে পালন করছে, মসজিদে-খানকায়, ওয়াজ মাহফিলে প্রচার করছে, মাদ্রাসার মাধ্যমে ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে সেটা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা যারা লাভ করবে তারা কোনদিন জঙ্গি হবে না, তারা আইন অমান্যকারী হবে না, বিশৃঙ্খল হবে না, তারা হবে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। কাজেই জঙ্গিবাদের বিলুপ্তি সাধনের পূর্বশর্ত হলো ধর্মব্যবসার বিলুপ্তি সাধন। আর ধর্মব্যবসার বিলুপ্তি সাধনের পূর্বশর্ত হলো প্রচলিত মাদ্রাসাব্যবস্থায় বিকৃত শিক্ষা প্রদান বন্ধ করে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা প্রদান করা। পৃথিবীতে মোসলেমদের পরাজিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত যে অবয়ব সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে অন্যতম কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মোসলেমের অজ্ঞতা ও ধর্মীয় নেতাদের কথিত জ্ঞানের অহংকার। এ দুটোই সৃষ্টি হয়েছে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার অভাবে। শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী এই জাতি মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করছে, লক্ষ লক্ষ আলেম তৈরি হচ্ছে, কোর’আনের হাফেজ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তারা কি জাতিকে অন্যায়-অবিচারের গ্লানি থেকে মুক্ত করতে পেরেছে? তারা কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতির পরাজয় ঠেকাতে পেরেছে? পারে নি, কারণ মাদ্রাসা পড়ে বহু আলেম-বুজুর্গ, হাফেজ তৈরি হলেও উম্মতে মোহাম্মদী তৈরি হচ্ছে না, মো’মেন তৈরি হচ্ছে না। তাই জাতির বিজয়ও আসছে না। জাতি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে টিকতে পারছে না। তাই আজ সময় এসেছে। মোসলেম জাতিকে পৃথিবীব্যাপী ইসলাম শিক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা আছে সেটার যথার্থতা নিয়ে ভাবতে হবে। আমি বলছি না, মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে হবে। মাদ্রাসা বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে- এমন নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। কিন্তু পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ থেকে তো আমরা বের হতেই পারি। সে চেষ্টাতেই এখন আমাদের মশগুল হওয়া উচিত।