মোহাম্মদ আসাদ আলী
সওম (রোজা) শব্দের অর্থ বিরত থাকা অর্থাৎ আত্মসংযম (Self Control)। রমজান মাসে মো’মেন সারাদিন সওম রাখবে অর্থাৎ পানাহার ও জৈবিক চাহিদাপূরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে, আত্মাকে করবে শক্তিশালী। সে অপচয় করবে না, মিথ্যা বলবে না, পশুর মতো উদরপূর্তি করবে না। সে হবে নিয়ন্ত্রিত, ত্যাগী, নিজের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী এবং আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে সজাগ। নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে তার মনকে, আত্মাকে শক্তিশালী করবে। প্রশ্ন হতে পারে, মো’মেনের কেন মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দরকার? এর উত্তর আল্লাহ দিয়েছেন- যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (বাকারা ১৮৩)
তাকওয়া হলো সাবধানে, সতর্কতার সাথে, দেখে শুনে জীবনের পথ চলা। আল্লাহর হুকুম যেটা সেটা মানা, আর যেটা নিষেধ সেটা পরিহার করা। এটা করতে হলে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন তিনি হলেন মোত্তাকী। আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেনের মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে এই তাকওয়া। যিনি প্রতিটি কাজে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করেন এবং সত্য, ন্যায়, হক ও বৈধপথ অবলম্বন করেন তিনি হলেন মোত্তাকী। যিনি যত বেশি ন্যায়সঙ্গত ও বৈধপন্থা অবলম্বন করবেন তিনি তত বড় মোত্তাকী। সুতরাং সওমের উদ্দেশ্য হলো মো’মেনকে মোত্তাকী করবে। তাকওয়া অর্জনে তাকে সহায়তা করবে। জীবনের চলার পথকে সুন্দর ও মার্জিত করবে। আর তার চূড়ান্ত ফলাফল হবে এই যে, মো’মেনের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে যাবে। সেই লক্ষ্য কি আমরা জানি?
নবী করিম (সা.) এর জীবনের লক্ষ্য ছিল- আল্লাহর দেয়া জীবনবিধান মোতাবেক মানবজাতিকে পরিচালিত করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য এ দীনের নাম হলো ইসলাম, শান্তি। আল্লাহ বলেছেন, তিনি সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) ও সত্যদীনসহ স্বীয় রসুল প্রেরণ করেছেন যেন রসুল (সা.) একে সকল দীনের উপর বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন (সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। সেই সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্ব উপায়ে প্রচেষ্টা চালানো তাই প্রত্যেক মো’মেনের জন্যও অবশ্য কর্তব্য, ফরদ। এটাই একজন মো’মেনের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কিন্তু এই দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মো’মেনের অবশ্যই কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণ লাগবে। সেই চারিত্রিক, মানসিক, আত্মিক গুণ, বৈশিষ্ট্য (Attributes) এটা যে সে অর্জন করবে কোত্থেকে? সেটার জন্য আল্লাহ তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেটা হলো সালাহ, সওম, হজ্ব, যাকাত এগুলো। এগুলোর মাধ্যমে তার চরিত্রে কিছু গুণ অর্জিত হবে। তারপর সে আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি দূর করতে পারবে, যেটা উম্মতে মোহাম্মদীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
যেমন একটি গাড়ির উদ্দেশ্য হচ্ছে তা মানুষকে বহন করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাবে। এই গাড়ির প্রতিটি যন্ত্রাংশের (Parts) আবার ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। চাকার উদ্দেশ্য, পিস্টনের উদ্দেশ্য, সিটের উদ্দেশ্য, স্টিয়ারিং-এর উদ্দেশ্য, ইঞ্জিনের উদ্দেশ্য আলাদা আলাদা হলেও তাদের সবার সম্মিলিত উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়িটির এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলন (Movement)। গাড়িটি যদি অচল হয়, তাহলে এর যন্ত্রাংশগুলো আলাদা আলাদাভাবে যতই ভালো থাকুক লাভ নেই। তেমনি ইসলামের একটি সামগ্রিক উদ্দেশ্য আছে তা হলো – সমাজে শান্তি রাখা। মানব সমাজে যদি শান্তিই না থাকে তখন ইসলামের সব আমলই অর্থহীন। গাড়ির যেমন প্রতিটি যন্ত্রাংশের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য থাকে তেমনি দীনুল হকের (ইসলাম) অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিষয়ের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সবগুলো মিলিয়ে মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। যেমন সালাতের উদ্দেশ্য ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ইত্যাদি মো’মেনের চরিত্রে সৃষ্টি, যাকাতের উদ্দেশ্য সমাজে অর্থের সুষম বণ্টন, হজ্বের উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহর জাতীয় বাৎসরিক সম্মেলন। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বছরে একবার তাদের জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করবে এবং কেন্দ্রীয় নেতার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমাধান করবে। একইভাবে সওমও মো’মেনের চরিত্রে একটি নির্দিষ্ট শিক্ষা দিয়ে থাকে। পরবর্তী লেখায় সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশা’আল্লাহ।