জাতির ঐক্য এতটাই প্রয়োজনীয় (Vital) বিষয় যে একটি জাতি, একটি সংগঠন যতই শক্তিশালী হোক যতই উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র-শস্ত্র থাকুক, যতই ধন-সম্পদের অধিকারী হোক, যদি তাদের মধ্যে ঐক্য না থাকে তবে তারা কখনই জয়ী হতে পারবে না। অতি দুর্বল শত্রুর কাছেও তারা পরাজিত হবে। তাই আল্লা্হর কোর’আনে বহুবার এই ঐক্য অটুট রাখার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এই ঐক্য যাতে না ভাঙ্গে সে জন্য তার রসুল (দ.) সদা শংকিত ও জাগ্রত থেকেছেন এবং এমন কোন কাজ যখন কাউকে করতে দেখেছেন, যাতে ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে তখন রেগে গেছেন। একদিন দুপুরে আব্দুলস্নাহ বিন আমর (রা.) রসুলাল্লাহর গৃহে যেয়ে দেখেন তার মুখ মোবারক ক্রোধে লাল হয়ে আছে। কারণ তিনি দু’জন আসহাবকে কোর’আনের একটি আয়াত নিয়ে মতবিরোধ করতে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি (দ.) বললেন, “কোর’আনের আয়াতের অর্থ নিয়ে যে কোন রকম মতভেদ কুফর। নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ তাদের কিতাবগুলির (আয়াতের) অর্থ নিয়ে মত বিরোধের জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর তিনি আরও বললেন (কোর’আনের) যে অংশ (পরিষ্কার) বোঝা যায় এবং ঐক্যমত আছে তা বল, যে গুলো বোঝা মুশকিল সেগুলোর অর্থ আলস্নাহর কাছে ছেড়ে দাও (মতবিরোধ করোনা) (হাদিস-আব্দুল্লাহর বিন আমর (রা.) থেকে- মুসলিম, মেশকাত)।” বিশ্বনবী (দ.) রেগে লাল হয়েছিলেন কেন? কারণ যদিও তিনি পরিষ্কার বলেই দিলেন অর্থাৎ আয়াতের অর্থ নিয়ে মতবিরোধ হয়ে জাতির ঐক্য নষ্ট ও পরিণামে যে জন্য জাতির সৃষ্টি সেই সংগ্রামে শত্রুর কাছে পরাজয় ও পৃথিবীতে এই দীনকে প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা। তবুও ইতিহাস এই যে, যে কাজকে রসুলালস্নাহ (দ.) কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন সেই কাজকে মহা সওয়াবের কাজ মনে করে করা হয়েছে এবং হচ্ছে অতি উৎসাহের সাথে এবং ফলে বিভিন্ন মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টি হয়ে জাতির ঐক্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং জাতির শত্রুর কাছে শুধু পরাজিতই হয় নি তাদের ক্রীতদাসেও পরিণত হয়েছে।
বিদায় হজে বিশ্বনবীর (দ.) ভাষণ মনযোগ দিয়ে পড়লে যে বিষয়টা সবচেয়ে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে সেটা তার জাতির ঐক্য সম্বন্ধে তার ভয় ও চিন্তা। স্বভাবতই কারণ জীবনের সবকিছু কোরবান করে অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করে সারা জীবনের সাধনায় একটি জাতি সৃষ্টি করলে এবং সেই জাতির উপর তার আরদ্ধ কাজের ভার ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় একটা মানুষের মনে ঐ ভয়, ঐ শঙ্কাই সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ঐক্য ভেঙ্গে গেলেই সবশেষ, জাতি আর তার আরদ্ধ কাজ করতে পারবে না, শত্রুর কাছে পরাজিত হবে। তাই তাকে বিদায় হজের ভাষণে বলতে শুনি, “হে মানুষ সকল! আজকের এই দিন (১০ই জিলহজ), এই মাস (জিলহজ) এই স্থান (মক্কা ও আরাফাত) যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অন্যের প্রাণ, সম্পদ ও ইজ্জত তেমনি পবিত্র (হারাম)। শুধু তাই নয় এই দিন, এই মাস ও এই স্থানের পবিত্রতা একত্র করলে যতখানি পবিত্রতা হয়, তোমাদের একের জন্য অন্যের জান-মাল-ইজ্জত ততখানি পবিত্র (হারাম)। খবরদার! খবরদার! আমার (ওফাতের) পর তোমরা একে অন্যকে হত্যা করে কুফরী করো না।” শেষ নবী (দ.) এই সাবধান বাণী একবার নয় পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করলেন এবং শেষে আসমানের দিকে মুখ তুলে বললেন, “হে আলস্নাহ! তুমি সাক্ষী থাক- আমি আমার দায়িত্ব পৌঁছে দিলাম। হে আলস্নাহ তুমি সাক্ষী থাক- আমি আমার দায়িত্ব পৌঁছে দিলাম।” এখানে লক্ষ্য করুন নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটিকে, অর্থাৎ জাতির ঐক্যকে নষ্ট বা ক্ষতি করাকে শেষ নবী (দ.) কোন্ শ্রেণীর গোনাহের পর্যায়ে ফেলছেন। একেবারে কুফরের পর্যায়ে। তাই আলস্নাহর রসুল দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, “যে ব্যক্তি এই উম্মতের ঐক্য ও সংহতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায় তাদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করে, তলোয়ার দ্বারা তোমরা তাকে শায়েত্ম করো, সে যেই হোক না কেন (হাদিস, আরফাজা (রা.) থেকে মুসলিম)।”
আলস্নাহ পবিত্র কোর’আনে দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন এবং আলস্নাহর রসুলও বিদায় হজের ভাষণে দীন, জীবনব্যবস্থা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। বাড়াবাড়ি অর্থ হচ্ছে অতি বিশেস্নষণ এবং যতটুকু বলা হয়েছে তার চেয়ে বেশি বেশি করা, আধিক্য (তাশাদ্দুদ) করা। এমন কোন কাজ দেখলে রসুলালস্নাহ রেগে লাল হয়ে যেতেন এবং যারা তা কোরত তাদেরকে কঠিনভাবে তিরস্কার করতেন। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোন বিষয়ে মাসলাহ জানতে চাইলে বিশ্বনবী (দ.) প্রথমে তা বলে দিতেন। কিন্তু কেউ যদি আরও একটু খুঁটিয়ে জানতে চাইতো তাহলেই তিনি রেগে যেতেন। একদিন একজন পথে পড়ে থাকা জিনিসপত্র কি করা হবে এ ব্যাপারে রসুলাল্লাহ (দ.) কাছে মাসলাহ জিজ্ঞাসা করায় তিনি তার জবাব দিয়ে দিলেন। ঐ লোকটি যেই জিজ্ঞাসা করলেন যে যদি হারানো উট পাওয়া যায় তবে তার কি মাসলাহ? অমনি সেই জিতেন্দ্রীয় মহামানব এমন রেগে গেলেন যে তার পবিত্র মুখ লাল টকটকে হয়ে গেলো (হাদিস-যায়েদ এবনে খালেদ জুহানী (রা.) থেকে বোখারি)। কিন্তু তার অত ক্রোধেও অত নিষেধেও কোন কাজ হয় নি। তাঁর জাতিটিও ঠিক পূর্ববর্তী নবীদের (আ.) জাতিগুলির মত দীন নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে অতি মুসলিম হয়ে মাসলা-মাসায়েলের তর্ক তুলে বিভেদ সৃষ্টি করে হতবল, শক্তিহীন হয়ে শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের গোলামে পরিণত হয়েছে।
দীনের যে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক, মতভেদ করাকে তিনি বার বার কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ এতে জাতির ঐক্য বিনষ্ট হয়। জাতির অখন্ডতা ও অবিভাজ্যতা সম্পর্কে আলস্নাহ ও রসুলের এমন স্পষ্ট উদাহরণ ও নীতিমালা সত্ত্বেও বাস্তবে এক মুসলিম জাতি আজ শরিয়াহগতভাবে শিয়া সুন্নি, হানাফী, শাফেয়ী, হাম্বলী, আহলে হাদিস ইত্যাদি ভাগে, আধ্যাতিকভাবে, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, আহলে বাইত ইত্যাদি হাজারো ভাগে, ভৌগোলিকভাবে ৫৫টিরও বেশি রাষ্ট্রে বিভক্ত এবং ইহুদী খ্রিস্টানের নকল করে হাজারো রাজনৈতিক দলে কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ সাম্যবাদী, কেউ রাজতন্ত্রী, কেউ পুঁজিবাদী; গণতন্ত্রীদের মধ্যে কেউ সংসদীয় গণতন্ত্রী, কেউ পুঁজিবাদী গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে কেউ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী, কেউ চীনাপন্থী, মাওবাদী, কেউ মার্কসপন্থী, লেলিনবাদী ইত্যাদি মতাদর্শকে ভিত্তি করে হাজার হাজার দলে বিভক্ত। আল্লাহ বলেন, “সকল মো’মেন ভাই ভাই (সুরা হুজরাত ১০)”। রসুলালস্নাহ (দ.) বলেছেন, “সমগ্র উম্মতে মোহাম্মদী জাতি যেন একটা শরীর, তার একটা অঙ্গে ব্যথা পেলে সারা শরীরেই ব্যথা অনুভূত হয় (আব্দুলস্নাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারি, মুসলিম, আবু দাউদ)।” সেই উম্মতে মোহাম্মাদীর দাবিদার, এক মুসলিম জাতির দাবিদার হাজারো লক্ষ ভাগে বিভক্ত হলো, বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি, যুদ্ধ, রক্তপাত, দাঙ্গা ইত্যাদি করলো এতে জাতির যে সংজ্ঞা রসুল দিলেন অর্থাৎ ‘এক দেহ’ তা থাকলো কিনা?
ব্যক্তিগত তাকওয়া এবং সওয়াব কামাতে এই জাতি এতটাই ব্যস্ত যে, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যে অগণ্য বনী আদম যারা তাদের মতই মুসলিম দাবিদার, তাদের মতই এক আল্লাহর, এক রসুল ও এক কোর’আনে বিশ্বাসী, তারা অন্যান্য জাতিগুলির দ্বারা পশুপাখির মত গুলি খেয়ে মরছে, মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, লাখে লাখে বাস্তুহারা হচ্ছে তাদের প্রতি অন্যান্য মুসলিমরা কোনরূপ সহানুভূতির হাত বাড়ান না, খবরও রাখেন না। এই হতভাগ্য ‘মুসলিম’ জাতিরই একটা অংশ রোহিঙ্গা নামক জনগোষ্ঠীকে বৌদ্ধরা সাগরে নিয়ে ডুবিয়ে মারছে হাজারে হাজারে, আগুনে পুড়িয়ে মারছে নারী ও শিশুদের, যাদের অধিকাংশ নারীই জীবনে একাধিকবার ধর্ষিতা হয়েছেন, যাদের জীবনটাই মৃত্যুর মত ভয়ঙ্কর, সেই রোহিঙ্গাদের খোঁজ নেওয়ার কোন সময় এই অতি মুসলস্নীদের, তাদের এত্মঞ্জার পর ঢিলা কুলুখ নেওয়ার অধিকার থাকলেই হলো, চেক রুমাল কাঁধে চাপিয়ে দিনে পাঁচবার মসজিদে যেতে পারলেই হলো, এভাবেই তারা যিকিরে ফিকিরে জীবন কাটিয়ে দিতে চান। ফিলিস্তিনের আজন নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে না, আফ্রিকায়, সোমালিয়ায় না খেয়ে খেয়ে জীবন্ত কঙ্কাল হয়ে ঘুরে বেড়ানো হাজার হাজার মুসলিমের ক্ষুধা অনুভব করার মত আত্মা তাদের নেই। কারণ তারা আর এক উম্মাহ নেই, একটি দেহের মত তাই এক অঙ্গে আঘাত পেলে সর্বাঙ্গে যন্ত্রণা অনুভব করারও প্রশ্ন ওঠে না।
এ তো গেল বহিঃশত্রুর দ্বারা নিষ্পেষিত হওয়ার বৃত্তাšত্ম, তথাকথিত মুসলিমরা নিজেরাই ভিন্ন মাজহাব ফেরকার অনুসারী মুসলিমদের নির্যাতন ও নিপীড়ন করতে কম পটু নন। বিগত কয়েক শতাব্দিতে শুধু মাত্র শিয়া সুন্নি সংঘর্ষ এবং নিজেদের দুঃখজনক ভৌগোলিক রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ সংঘাত যুদ্ধ করে যে পরিমাণে নিহত ও আহত হয়েছে তা বহিঃশত্রুর হামলার চাইতেও কয়েক গুণ; অথচ রসুলাল্লাহ বলেছেন, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে নিহতদের উভয়পক্ষই জাহান্নামী। শিয়া-সুন্নি, সরকারী-কাওমী, ওয়াহাবি-খারেজী-কাদিয়ানী ইত্যাদিরা ইসলাম থেকে কে কতটুকু দূরে গেছে সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, সোজা কথা এরা মো’মেন নয়, মুসলিম নয়, উম্মতে মোহাম্মদী নয়। তারা প্রত্যেকেই এসব করে জাতির ঐক্য নষ্ট করে রাসুলের কথা মোতাবেক কুফর করেছে, ফলে কার্যত কাফের হয়ে গেছে। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যারা কাফের তাদের নামাজ, রোযা, হজ কোন কিছুই কবুল হবে না এবং তারা জাহান্নামী। সুতরাং ঐক্য নষ্ট করে এই জাতি আল্লাহ ও রসুলের ইসলাম থেকে বর্হিগত হয়ে গেছে বহু আগেই। এখন আবার সকল ভেদাভেদ ভুলে আল্লাহ তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর পথ নাই। আমরা হেযবুত তওহীদ আপনাদের সেই ঐক্যের পথেই আহ্বান করছি।