মাসুম বিল্লাহ:
পাশ্চাত্যের জড়বাদী সভ্যতার প্রভাবাধীন সমস্ত পৃথিবীতে এখন বোধ হয় অর্থনীতি মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দু’-চার শতাব্দ আগে পর্যন্ত প্রাচ্যের বৌদ্ধ, জৈন, সনাতনধর্মী ভারতীয় ইত্যাদির কাছে অর্থনীতির এত গুরুত্ব ছিল না, পার্থিব জীবনের আত্মার চরিত্রের উৎকর্ষের সম্মান ছিল বেশি। একটি কোটিপতির চেয়ে একজন জ্ঞানী, শিক্ষিত, চরিত্রবান কিন্তু গরিব লোককে সমাজ অনেক বেশি সম্মান করত। আর স্রষ্টার পাঠানো দীনের সর্বশেষ সংস্করণ ইসলাম হলো ভারসাম্যযুক্ত। যে জন্য এই মুসলিম জাতিটিকে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন ভারসাম্যযুক্ত জাতি হিসাবে (সুরা বাকারা ১৪৩)। অর্থাৎ এর উভয় জীবনই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ইসলাম একটা ভারসাম্যযুক্ত দীন কাজেই সমষ্টিগত জীবন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা স্রষ্টা এতে দিয়ে দিয়েছেন। ইসলামের অর্থনীতি পুঁজিবাদের অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। একটাতে জড়ো করা আরেকটাতে ব্যয় করা। আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন, খরচ কর, ব্যয় কর, সম্পদ জমা কোরো না, পুঞ্জিভূত করো না। আর সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদ অর্থনীতি ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ করে জাতির সমস্ত সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে জমা করে। এটাও ইসলামের বিপরীত। কারণ, ইসলাম ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণ স্বীকার করে এবং রাষ্ট্রের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না। পুঁজিবাদের ও সমাজতন্ত্রের যেমন আলাদা নিজস্ব অর্থনীতি আছে তেমনি ইসলামের নিজস্ব অর্থনীতি আছে। এককথায় বললে বলতে হয় ইসলামের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে সম্পদকে যতো দ্রুত সম্ভব চালিত করা, কোথাও যেন সেটা স্থবির-অনড় না হতে পারে। এই জন্যই কোর’আনে এই অর্থনীতির বিধাতা, বিধানদাতা বহুবার তাগিদ দিয়েছেন খরচ কর, ব্যয় কর, কিন্তু বোধহয় একবারও বলেন নি যে, সঞ্চয় কর। যাকাত দেয়া, খারাজ, খুমস ও ওশর দেয়া এবং তার উপর সাদকা দান ইত্যাদি খরচের কথা এতবার তিনি বলেছেন যে, বোধহয় শুধুমাত্র তওহীদ অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহকে প্রভু, ইলাহ বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করা এবং জিহাদ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে এতবার বলেন নি। কারণ, একটা জাতির এবং পরবর্তীতে সমগ্র পৃথিবীতে অর্থাৎ যে কোন পরিধিতে সম্পদ যথাযথ এবং বণ্টনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সঞ্চয় নয় ব্যয়। একমাত্র ইসলামি অর্থনীতিই যে মানবজাতিকে একটা শোষণমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, স্বচ্ছল সমাজ উপহার দিতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে প্রকৃত ইসলামের যুগ। তখন অর্থনীতিক দিক দিয়ে মানুষ এতটাই সচ্ছল হয়ে গিয়েছিল যে, মানুষ টাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর খেলাফতের সময়ের একটি ঘটনা। উমর (রা.) গরিব দুঃখীদের খবর নেওয়ার জন্য ছদ্মবেশে রাতের অন্ধকারে মদিনার মহল্লায় টহল দিয়ে ফিরতেন। তিনি একদিন ঘুরতে ঘুরতে মদিনার এক প্রান্তে একটি গরিব বুড়িকে আবিষ্কার করলেন এবং তাকে সাহায্য করার জন্য মনস্থির করলেন। পরদিন বুড়ির কাছে গিয়ে শোনেন কে একজন আগেই বুড়ির অভাব মিটিয়ে দিয়েছেন। উমর (রা.) এর কৌতূহল হলো, তাঁর এই প্রতিদ্বন্দ্বী কে?পরের দিন উমর (রা.) আগেই গিয়ে লুকিয়ে রইলেন, তিনি দেখবেন কে সেই ব্যক্তি যিনি মানুষের সেবায় উমরকে পরাজিত করে। একটু পরেই একটি মানুষ আসল। মানুষটি বুড়ির কাছে গিয়ে বুড়ির অভাব মোচন করল। উমর (রা.) ভালো করে চেয়ে দেখলেনÑও আল্লাহ! এ যে আবু বকর (রা.)। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা হলো – উভয়ের ঠোঁটে øিগ্ধ মধুর হাসি। উমর (রা.) বললেন ,“আল্লাহর দরবারে শোকর যে স্বয়ং খলিফা ছাড়া আর কারো কাছে পরাজিত হই নি।” শুধু উমর (রা.) বা আবু বকর (রা.) নয় ঐ সমাজের প্রতিটি মানুষই এরকম দানের জন্য, খরচের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তাদের এই চরিত্রই সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এক বালতি পানি যদি কোন উঁচুনিচু জায়গায় ঢেলে দেওয়া যায় তাহলে য
েমন তা ঐ জায়গার সমতলতা খুঁজে নেয় তেমনি সম্পদের এই গতিশীলতার কারণে সমাজের চাহিদামতো তার সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। যার ফলশ্র“তিতে সমাজে আর্থনীতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত হয়। আমাদের আজকের পৃথিবীতেও যদি ইসলামের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হয় তবে আমাদের সমাজেও কোন অলস সম্পদ থাকবে না, সম্পদের গতিশীলতা এমন সুফল বয়ে আনবে যে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে দারিদ্র্য একেবারে দূরীভূত হয়ে যাবে।