মানুষ আল্লাহ তায়ালার এক অসাধারণ সৃষ্টি। মানুষ শুধু দেহধারী প্রাণী নয়, তার একটি আত্মাও আছে। দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে সে এক ভারসাম্যপূর্ণ সৃষ্টি। মানুষের ইহকাল যেমন রয়েছে তেমনি পরকালও রয়েছে। মানুষের ইহকালটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে সে যে কাজ করবে তারই পরিণতি সে পরকালে ভোগ করবে। এই কর্মফলকেই বলা হয় হাশর। কাজেই মানুষের প্রতিটি কর্ম হবে দুই জীবনকে ধারণায় রেখে। সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ ‘কুন’ (হয়ে যাও) শব্দ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, শুধু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজ হাতে। মানুষকে আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে তাঁর নিজের রুহ প্রবিষ্ট করেছেন, ফলে মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যা আল্লাহর পবিত্র রুহ নিজের সত্তায় ধারণ করে। এর অর্থ সে আল্লাহর গুণাবলী তথা সিফতগুলো ধারণ করছে। অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টিকে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন মানুষকে সেবা করার জন্য। সুতরাং মানুষ অন্যান্য সৃষ্টির মতো নয়। আরো অনেকগুলো কারণ বলা যাবে তবে মৌলিক এই ক’টি কারণই মানুষের অনন্যতা অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট। মানুষকে আল্লাহ দৃষ্টি দিয়েছেন যেন সে যেকোনো কিছু চোখে দেখে যাচাই করে গ্রহণ বা বর্জন করে। তাকে কান দিয়েছেন শ্রবণ করে সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য। অনন্য ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্ক দিয়েছেন চিন্তা করার জন্য, তাকে বিবেক দিয়েছেন ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বোঝার জন্য। হৃদয় দিয়েছেন উপলব্ধি করার জন্য। সে উপলব্ধি করবে কোনো বিষয়ের মাহাত্ম্য, গুরুত্ব, ব্যাপ্তি, উচ্চতা ইত্যাদি। কাজেই মানুষ পশুর মতো জীবন যাপন করতে পারে না। একটা পশু খায়, ঘুমায়, বংশ বৃদ্ধি করে, পরিণত বয়সে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু মানুষের এই জীবনের উদ্দেশ্য রয়েছে, অর্থ রয়েছে। মানুষের জীবনকে সার্থক করতে হলে সেই উদ্দেশ্য অবশ্যই জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে।
তাকে ভাবতে হবে তার নিজেকে নিয়ে। সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় তার গন্তব্য, কী তার কর্তব্য? তাকে ভাবতে হবে তার পরিবারকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে। সমাজ তার দেহের ন্যায়। দেহে যেমন কোনো রোগবালাই বাসা বাঁধলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করে তেমনি সমাজের মধ্যেও যদি কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, অন্যায়, অশান্তি, অস্থিরতা দেখা দেয় সেটা সমাধান করার ক্ষেত্রেও প্রতিটি মানুষের কর্তব্য রয়েছে, কেননা ওগুলো তার জীবনের স্বাভাবিক গতিকেও বিঘ্নিত করবে। কাজেই তাকে সমাজ নিয়েও ভাবতে হবে। তাকে ভাবতে হবে দেশ নিয়ে, কেননা এই দেশের আলো-বাতাসে সে বেড়ে উঠেছে, এখানে সে পড়াশুনা শিখেছে, বড় হয়েছে, এখানে সে জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে আছে। দেশের প্রতি তার কর্তব্য রয়েছে। তাকে ভাবতে হবে পৃথিবীকে নিয়ে, কারণ আল্লাহ বলেছেন, এই পৃথিবীতে (ফিল আরদ) সে আল্লাহর খলিফা, প্রতিনিধি। কাজেই তাকে ভাবতে হবে পৃথিবীর পরিস্থিতি নিয়ে, পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে। পৃথিবীর মানুষ শান্তিতে আছে, না অশান্তির মধ্যে আছে। কেন সে ভাববে? কারণ আল্লাহ বলেছেন সমগ্র মানুষ এক জাতিভুক্তই ছিল (সুরা ইউনুস: ১৯), তারা এক পিতা মাতার সন্তান (সুরা হুজরাত: ১৩)। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোও একই সত্যকে তুলে ধরে। কাজেই সৃষ্টিগতভাবে তারা ভাইবোন। তাই প্রতিটি মানুষকে মানবজাতিকে নিয়ে ভাবতে হবে।
এই মুহূর্তে আমরা বিশ্বের পরিস্থিতি কী দেখতে পাচ্ছি? পৃথিবীময় আজ অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, জাতিতে জাতিতে চলছে সংঘাত। গত এক শতাব্দীতে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে তের কোটি বনি আদম নিহত হয়েছে। আহত, বিকলাঙ্গ হয়েছে আরো বহুগুণ। বহু শহর নগর বন্দর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। কমপক্ষে পনের হাজার এটম বোমা তৈরি করে রাখা হয়েছে। এর একেকটি হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে ব্যবহৃত বোমার চেয়ে বহুগুণ প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সম্পন্ন। পারমাণবিক বোমার বাইরে যে অসংখ্য বোমা মানুষ আবিষ্কার করেছে সেগুলোর বিধ্বংসী ক্ষমতাও বলতে গেলে অকল্পনীয়। এগুলো তৈরি করা হয়েছে কি উদ্দেশ্যে? নিশ্চয়ই বন্য পশু কিংবা ভিনগ্রহের কোনো কাল্পনিক প্রাণীকে মোকাবেলা করার জন্য নয়। বরং মানুষকে হত্যা করার জন্যই মানুষের এত আয়োজন। এই পৃথিবী নামক গ্রহটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া এবং এখানে বসবাসরত সমস্ত প্রাণের অস্তিত্ব বিনষ্ট করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিংবা কোনো অপরিণামদর্শী শাসকের ইঙ্গিতে যেকোনো মুহূর্তে এই বোমা তার ধ্বংসলীলা ঘটাতে পারে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে চলছে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, শাসকের উপর শাসিতের জুলুম, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা। এই মুহূর্তে কোটি কোটি লোক গৃহহারা। এই হলো পৃথিবীর অবস্থা। আর প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে অশান্তি, দাঙ্গা, গুম, খুন, রাহাজানি, সুদ ধাই ধাই করে বেড়ে চলছে। বিশ্বের এই পরিস্থিতিতে মানুষ আজ দিশেহারা। মানুষের এই পরিণতি কেন। কারণ মানুষ একদিকে যেমন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত), অন্যদিকে সে নিজের কর্মদোষে সর্বনিকৃষ্ট জীবেও পর্যবসিত হতে পারে। আল্লাহ কোর’আনে একাধারে মানুষকে সৃষ্টির সেরা (খায়রুল বারিয়াহ) এবং সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট (শাররুল বারিয়াহ) বলে আখ্যায়িত করেছেন (সুরা বাইয়েনাহ: ৬-৭)।
মানুষের জন্য এই সুন্দর পৃথিবী আল্লাহ তায়ালা বাসযোগ্য করে বানিয়েছেন। যে যুগে মানুষ জ্ঞানে বিজ্ঞানে চূড়ান্ত অগ্রগতি করেছে সেই যুগে পৃথিবীটা মানুষের বাসযোগ্য নেই কেন? কেন আজকে এই পৃথিবীর বাতাস দূষিত, পানি দূষিত, মাটি দূষিত, কেন আজকে এই মানুষগুলো একজন আরেকজনের রক্ত শোষণ করার জন্য উন্মত্ত, কেন তারা একজন আরেকজনকে ধ্বংস করার জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছে? কোথায় তারা পথ হারিয়েছে? কোথায় তারা ভুল করেছে? চিন্তাশীল মানুষ আজ দিশেহারা। সরকারগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করে একেকটা নির্বাচনে যাচ্ছে, কিন্তু চরম অসৎ মানুষেরা নেতৃত্বে উঠে আসছে যারা প্রতিহিংসার রাজনীতি আর লুটতরাজ চালিয়ে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। অপরাধ দমনের জন্য কঠিন কঠিন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে, নতুন নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। জাতিসংঘ তৈরি হয়েছে, বড় বড় আন্তর্জাতিক সমিতি-সংঘ হচ্ছে যুদ্ধ রক্তপাত বন্ধ করার জন্য। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগের থেকে বর্তমানে মানুষের জীবনে অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, বঞ্চনা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেকোনো সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই সুন্দর পৃথিবী, একই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে সেই জাতিটিও যাদেরকে আল্লাহ রব্বুল আলামিন শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের উপর দায়িত্ব ছিল যাবতীয় অন্যায়, অশান্তি, যুদ্ধ, রক্তপাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা। সে দায়িত্ব তারা বহু শতাব্দী আগেই পরিত্যাগ করেছে এবং পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছে। এখন যদি মানবজাতির সম্মিলিত কর্মফলের দরুন পারমাণবিক যুদ্ধে পৃথিবী তথা মানবজাতি ধ্বংসের মুখে উপনীত হয় তাহলে সেই উম্মাহর উপায় কী হবে? তাদের দুনিয়ার সাথে আখেরাতও ধ্বংস হয়ে যাবে। এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আল্লাহ, প্রথম মানব আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ রসুল (সা.) পর্যন্ত যত নবী রসুল পাঠিয়েছেন সবাইকে মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি মূল মন্ত্র দান করেছেন। সেটা হলো – তাঁর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম না মানা অর্থাৎ স্রষ্টার নিঃশর্ত আনুগত্য করা, একমাত্র তারই এবাদত করা। অতীতের নবীগণ কোনো কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা গোত্রের জন্য এসেছেন, এমন কি একটি পরিবারের জন্যও একজন নবী এসেছেন। কিন্তু সর্বশেষ যিনি এসেছেন তিনি সমস্ত মানবজাতির জন্য আল্লাহর রসুল। তাঁর উপরে যে দীনটি আল্লাহ দিলেন তা পৃথিবীর সর্বত্র বসবাসকারী জনসম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য কারণ এটা প্রাকৃতিক নিয়মের উপর ভিত্তি করে রচিত অর্থাৎ দীনুল ফিতরাহ বা প্রাকৃতিক দীন। এই দীন দেওয়ার পর তিনি রসুলকে দায়িত্ব দিলেন সমস্ত পৃথিবীতে একে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। উদ্দেশ্য সমস্ত মানবজাতির জীবন থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা। শেষ নবী (সা.) এই মহান লক্ষ্যকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে একটি জাতি তৈরি করলেন যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী। আল্লাহ এই জাতিকে মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন (সুরা ইমরান: ১১০)। এই আয়াতের শেষাংশে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের শর্ত হিসাবে বলা হয়েছে- তারা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে আর অসৎ কাজ থেকে নিবৃত্ত করবে। কিন্তু তারা আল্লাহ-প্রদত্ত দায়িত্ব ত্যাগ করলে নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের বাধাদানের এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটা আখেরী নবী মোহাম্মদ (সা.) একটি উম্মাহ গঠন করে দেখিয়ে দিয়েছেন, তাদেরকে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে গেছেন এবং মানবজাতির সামনে একটি নমুনা বা আদর্শ স্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন কীভাবে সমাজ থেকে মিথ্যা, অন্যায়, অশান্তি দূর করে সেখানে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। তিনি তাঁর হাতে গড়া উম্মাহকে সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক সংগ্রাম, জেহাদের মাধ্যমে তাঁর জীবদ্দশায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে আল্লাহর দেওয়া জীবনপ্রণালী প্রতিষ্ঠা করলেন।
বাকি পৃথিবীতে এই সত্যদীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তিনি দিয়ে গেলেন তাঁর হাতেগড়া উম্মাহর উপর। তারা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবী ইসলামের তথা সুনিবিড় শান্তির ছায়াতলে নিয়ে আসেন। সেখানে এমন শান্তি, শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় যে একজন সুন্দরী যুবতী সারা গায়ে স্বর্ণালঙ্কার পরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে শত শত মাইল পথ অতিক্রম করতে পারত, তার মনে কোনো প্রকার ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হতো না। এমন স্বচ্ছলতা এসেছিল যে, মানুষ উটের পিঠে খাদ্য আর ধন-সম্পদ বোঝাই করে শহরে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো কিন্তু তা গ্রহণ করার মতো কাউকে খুঁজে পেত না। মানুষের নৈতিক চরিত্র এতটাই উন্নত হয়েছিল যে অপরাধী নিজেই বিচারকের কাছে এসে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য সাজা প্রার্থনা করত। কিছুদিন আগেও যে আরবরা ছিল জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত, পৃথিবীর সকল জাতির দ্বারা অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, তারাই এমন একটি সুসভ্য, আদর্শ জাতিতে পরিণত হলো যে সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তারা মানবজাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হলো। রসুলাল্লাহর বিদায় নেওয়ার ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত জাতির সামনে তাদের লক্ষ্য, আকিদা সুস্পষ্ট ছিল। তারা একদেহ একপ্রাণ হয়ে মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করে গেছেন। তারপর ঘটল এক মহা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। জাতি তার আকিদা ভুলে গেল। যে জেহাদ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেই জেহাদ রূপান্তরিত হলো রাজ্যজয়ের যুদ্ধে। ইসলামের খলিফারা সুলতান হয়ে গেলেন, তারা অপরাপর রাজা-বাদশাহদের মতোই পাশবিক ভোগ বিলাসে নিমজ্জিত হলেন।
অন্যদিকে জাতির মধ্যে জন্ম নিল আল্লামা, মোহাদ্দেস, মোফাসসের, মুফতি এবং ভারসাম্যহীন সুফী-সাধক শ্রেণি যারা সহজ সরল সেরাতুল মুস্তাকীম, দীনুল হকের শরিয়তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল আবিষ্কার করে বহু মতের সৃষ্টি করলেন আর ভারসাম্যহীন সুফিরা জাতির সংগ্রামী চরিত্রকে উল্টিয়ে ঘরমুখী, অন্তর্মুখী করে স্থবির, নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ করে দিল। ফলে একদা অর্ধ-বিশ্বজয়ী দুর্বার গতিশীল জাতিটি হাজারো ফেরকা, মাজহাব, দল-উপদল, আধ্যাত্মিক তরিকায় বিভক্ত, স্থবির কিছু উপাসনা ও অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো। অতি বিশ্লেষণকারী পণ্ডিত এবং বিকৃত সুফী এই উভয় শ্রেণির কাজের ফলে ইসলামের উদ্দেশ্যই পাল্টে গেল। সংগ্রাম করে সারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার বদলে ধর্মের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো আত্মার উন্নয়ন এবং জীবনের ব্যক্তিগত অঙ্গনের ছোট খাটো বিষয়ের মাসলা মাসায়েল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করা।
জাতি ভুলে গেল যে সারা পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পরিত্যাগ করলে আল্লাহও তাদের পরিত্যাগ করবেন এবং তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়ে অন্য জাতির গোলাম বানিয়ে দেবেন বলে তাঁর কোর’আনে সাবধানবাণী উল্লেখ করেছেন (সুরা তওবা: ৩৯)। নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর শাস্তি এসে গেল। প্রথমে মঙ্গোলরা এসে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল করে নিল, লক্ষ লক্ষ মুসলমানের মাথা দিয়ে পিরামিড তৈরি করল। এরপর ইউরোপ থেকে এলো ইংরেজ, ডাচ, পর্তুগীজ ইত্যাদি জাতিগুলো। মরক্কো থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত প্রায় সমগ্র মুসলিম দুনিয়া তাদের পায়ের নিচে চলে গেল। সেই থেকে মুসলিম জাতি এখনও সেই দাসত্বের বোঝা বয়ে চলেছে।