যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করাই তার এবাদত। আল্লাহ সূর্য সৃষ্টি করেছেন আলো ও তাপ দেওয়ার জন্য। কোটি কোটি বছর সূর্য আলো ও তাপ বিতরণের কাজ করছে, এটাই সূর্যের এবাদত। মানুষের এবাদত যদি আমরা জানতে চাই, তাহলে সবার আগে জানতে হচ্ছে মানুষকে আল্লাহ কী কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন? ওই কাজই হবে মানুষের এবাদত।
আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো যখন তোমার রব মালায়েকদের ডেকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করব।’ (সুরা বাকারা: ৩০)। আল্লাহর মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা হিসেবে। খলিফা আরবি শব্দ, যার অর্থ প্রতিনিধি (Representative) । অর্থাৎ মানুষের কাজ হলো আল্লাহর খেলাফত করা, আলস্নাহর প্রতিনিধিত্ব করা। আলস্নাহর কাজ হচ্ছে সৃষ্টিজগতকে শাস্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা। সেই কাজটিই আলস্নাহ মানুষকে দিয়েছেন পৃথিবীতে। মানুষ হুকুম দিয়ে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়াতে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত রাখবে, এটাই মানুষের প্রধান কাজ, এবাদত।
দুঃখজনক বিষয়, বর্তমানে এবাদত বলতে আমরা তা বুঝি না। আমরা এবাদত বলতে বুঝি, দুনিয়ায় কী চলছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, দুনিয়াবিমুখ হয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে আল্লাহর উপাসনা, প্রার্থনা করা। এটা ইবাদত নয়, স্বার্থপরতা। সারা দুনিয়ার মানুষকে অসহায়ভাবে ফেলে রেখে, তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে কিছু না বলে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা, এটা যদি স্বার্থপরতা না হয় তাহলে স্বার্থপরতা আর কাকে বলে? ধরম্নন, আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিৎকার ভেসে এল। আপনি কী করবেন? দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে, নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রাথনা চালিয়ে যাবেন। যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি ভাবেন- বিপন্ন ব্যক্তি অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামায-রোযা, প্রার্থনা সবই হচ্ছে প-শ্রম।
পবিত্র কুরআনে আলস্নাহ বলেন, ‘আমিই আলস্নাহ, আমি ব্যতীত কোনো ইলাহ (হুকুমদাতা) নেই, অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাহ কায়েম কর (সুরা ত্বা-হা: ১৩)। যে ব্যক্তি মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করবে না, খেলাফতের কাজ করবে না, অন্য মানুষের দুঃখ-দুদর্শা ঘোচাতে সম্পদ ব্যয় করবে না, তার তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা, রোযা হবে না খেয়ে থাকা (হাদিস)। আল্লাহর এই স্বার্থপরতা চান না। আলস্নাহ চান মো’মেনরা প্রকৃত এবাদত করম্নক অর্থাৎ নিজেদের সম¯ত্ম স্বার্থ ত্যাগ করে সমাজে শানিাক প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করুক।
যখনই একদল মানুষ পৃথিবীতে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আরম্ভ করবেন অর্থাৎ আল্লাহর প্রকৃত এবাদত করতে চাইবেন, তখনই তাদের কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস দরকার পড়বে, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, শৃঙ্খলিত হতে হবে, নেতার প্রতি প্রশ্নহীন দ্বিধাহীন শর্তহীন আনুগত্যশীল হতে হবে, অন্যায় ও অসত্যকে পরিহার করতে হবে এবং জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম চালাতে হবে। ওই মানুষগুলোর বুকভরা সাহস লাগবে, লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ় মনোবল লাগবে, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব লাগবে, ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা লাগবে।
মূলত এই গুণগুলো সৃষ্টির প্রশিক্ষনই (Training) হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি। এগুলো খুবই গুরুত্বপুর্ণ আমল যা মো’মেনদেরকে আলস্নাহর এবাদত করতে সহায়তা করবে। এই আমলগুলো ছাড়া মো’মেন ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের মধ্যে থাকতেই পারবে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুক্ষে দাঁড়ানোর সাহসই পাবে না, কাজেই এবাদতও করতে পারবে না। কিন্তু তারপরও মনে রাখতে হবে, এগুলোই মো’মেনের জীবনের উদ্দেশ্য নয়, এগুলোর উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে খেলাফত, অর্থাৎ আল্লাহর এবাদত করা।
আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবিরা প্রকৃত এবাদত তথা খেলাফতের কাজ করতে গিয়ে আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। অথচ এখন মানুষকে এবাদতে নামে ভিন্ন শিক্ষা দেওয়া হয়। এখন মনে করা হয় এবাদত হলো পরকালীন বিষয়। অথচ আল্লাহর বলেছেন, তিনি মো’মেনদেরকে দুনিয়াতে কর্তৃত্ব দান করবেন (সুরা নুর:৫৫)। ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির মধ্য থেকে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার জন্য। (ইমরান: ১০)আজ এই দায়ত্ব কেউ পালন করছেন না। যে যত বড় ধার্মিক সে তত বেশি নির্বিরোধী, সে তত বেশি দুনিয়াবিমুখ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ইচ্ছা ও সাহস কোনোটাই তাদের থাকে না। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে তারা এবাদত মনে করেন না, এবাদত বলতে কেবল নামাজ-রোযাই বোঝেন।