নিজাম উদ্দিন
অসীম এই মহাবিশ্ব আল্লাহ কেন সৃষ্টি করলেন? এবং অসীম সৃষ্টির বুকে পৃথিবী নামক গ্রহে কেনই বা মানুষ নামের প্রাণি সৃষ্টি করলেন? প্রথমেই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলাম। লেখাটির উদ্দেশ্যই হলো এই প্রশ্নটির উত্তর বের করা। কারণ ছোট্ট এই প্রশ্নটির ভেতরেই লুকায়িত রয়েছে অনেক কিছুর জবাব।
মানুষ সৃষ্টি করে আল্লাহ ঘোষণা দিলেন যে, মানুষ হলো তাঁর অগণিত সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত)। কিন্তু আমরা অধিকাংশই জানি না যে, কেন মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। সূর্যের উদ্দেশ্য হলো- পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখা, উত্তাপ ছড়ানো। গাছের উদ্দেশ্য হলো- ফল দেওয়া, অক্সিজেন সরবরাহ করা ইত্যাদি। একটি ঘড়ির উদ্দেশ্য হলো সঠিক সময় নির্ণয় করা। কাজেই আমরা যে মানুষ, আমাদের পৃথিবীতে আসার নিশ্চয়ই একটি উদ্দেশ্য আছে। অনেকেই মনে করেন আমরা পৃথিবীতে এসেছি অন্যান্য প্রাণির মতো বেঁচে থাকার জন্যই। তবে যেহেতু আখেরাতকে বিশ্বাস করি, আল্লাহকে বিশ্বাস করি, সুতরাং নামাজ-রোজা, জিকির-আসগর, ধ্যান-জ্ঞান ইত্যাদি করে কোনো রকমে জীবনটা পার করে দিলেই জীবনের উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যাবে। তারা সবাই মনে করছে উপার্জন, সংসারের ভরণপোষণ করে আর মসজিদে, মন্দিরে, সীনাগগে, প্যাগোডায় প্রার্থনা করে তাদের জীবন পার করে দেওয়াই হচ্ছে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য। এটা করেই তারা জান্নাত বা স্বর্গে যেতে চান। কিন্তু তাদের এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়।
কোর’আনের সুরা বাকারার ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমার প্রতিপালক মালায়েকদেরকে বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।’ তারা বললো, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, গুণকীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।’ তিনি বললেন, নিশ্চয়ই ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’ সুতরাং আল্লাহ বললেন যে, তিনি মানুষকে তাঁর খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মানুষের প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে সে আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি, ইংরেজিতে যাকে বলে জবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব.
আমাদের দেশে, বিভিন্ন দেশের এম্বেসি আছে সেখানে যার যার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি বা রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত থাকেন। আমাদের এই দেশে যখন ব্রিটিশ রাজত্ব ছিল তখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের পক্ষ থেকে এখানে যিনি দায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ ভাইসরয় তিনি ছিলেন ব্রিটিশ রাজা বা রাণীর খলিফা বা প্রতিনিধি। অর্থাৎ, সরকারের যে কাজ, সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োজিত প্রতিনিধিরও সেই কাজ। ঠিক একইভাবে আল্লাহর যে কাজ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষেরও সেই একই কাজ। মানুষ যখন পৃথিবীতে আল্লাহর ঐ কাজ সম্পাদন করবে তখনই কেবল তারা আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে সাব্যস্ত হবে। সুতরাং এখন জানা দরকার যে, স্রষ্টার কাজ কী?
আল্লাহ হলেন তাঁর অসীম এই সৃষ্টিজগতের শাসনকর্তা। তিনি তাঁর নিজের তৈরি শৃঙ্খলা, নিয়ম-নীতি মোতাবেক এই মহাসৃষ্টিকে শাসন করছেন। তিনি চাইলেন পৃথিবীতে নিজে শাসন করবেন না, এজন্য মানুষকে তাঁর পক্ষ থেকে খলিফা বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করলেন। অর্থাৎ মানুষের কাজ হলো সে আল্লাহর হয়ে পৃথিবীতে শাসন করবে। কেমন করে করবে? আল্লাহ যেমন নিজের তৈরি আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি মোতাবেক মহাবিশ্ব শাসন করছেন, তেমনি পৃথিবীর শাসনের জন্য তিনি নিজে শাসন করলে যে আইন-কানুন, নিয়মনীতি দিয়ে শাসন করতেন সেই আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি তাঁর খলিফাকে দিয়ে বললেনÑ এইগুলি অনুযায়ী তোমরা আমার মত করে তোমাদের শাসনকার্য্য পরিচালনা করবে। এটাই হলো তোমাদের ইবাদত যে জন্য তোমাদের আমি সৃষ্টি করেছি।
এখন দেখা যাক, যদি আমরা আল্লাহর খেলাফত করি তাহলে আমাদের অর্থাৎ মানবজাতির কী লাভ। আমরা কেন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব বা খেলাফতের কাজ করব? আল্লাহ যখন খলিফা বা মানুষ সৃষ্টি করেন তখন ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, সে মানুষকে দিয়ে পৃথিবীতে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করাবে অর্থাৎ অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, যুদ্ধ ইত্যাদি করাবে। আর আল্লাহ বললেন, আমি মানুষকে হেদায়াহ বা সঠিক পথনির্দেশ পাঠাবো যে পথে চললে সে শান্তিতে থাকবে, ন্যায় ও সুবিচারের মধ্যে থাকবে। এই জন্য আল্লাহর প্রেরিত জীবনব্যবস্থার নাম হচ্ছে ইসলাম, ইসলাম অর্থ শান্তি। যারা আল্লাহর পাঠানো সহজ সরল পথে, সেরাতুল মোস্তাকীমে থাকবে তাদেরকে দিয়ে ইবলিস পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করাতে পারবে না। কাজেই আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফার কাজই হলো ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর হুকুম প্রতিষ্ঠা করে সর্ব প্রকার অন্যায়, অবিচার, রক্তা-রক্তির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে সমস্ত দুনিয়ায় সুখ-শান্তি বজায় রাখা।
আমাদের কাছে মহান আল্লাহর অভিপ্রায়ও সেটাই। আল্লাহ চান তাঁর এই প্রিয় সৃষ্টি আদম যাদেরকে আল্লাহ নিজ হাতে বানিয়েছেন, যাদের মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন সেই মানবজাতি যেন সুখে থাকে, শান্তিতে থাকে। মানুষের এই সুখে থাকা, শান্তিতে থাকাই হলো আল্লাহর অভিপ্রায়। এখন সুখ শান্তিতে থাকার জন্য মানুষকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেটা হলো তাদেরকে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক তাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালিত করতে হবে। তবেই মানবজাতি শান্তিতে থাকবে। এটাই হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের মূল কাজ, মূল দায়িত্ব। একজন ডাক্তারের যেমন কাজ হলো চিকিৎসা করা, একজন শিক্ষকের কাজ হলো ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো তেমনি একজন খলিফার কাজ হলো পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর হুকুম কার্যকরী করা।
অথচ আজ যদি আমরা দুনিয়ার পরিস্থিতির দিকে তাকাই, কী দেখবো? আমরা নামাজ, যাকাত, হজ্ব ও রোযা পালন করে মনে করছি আমরা খুব ইবাদত করছি। এগুলো মানুষের মূল ইবাদত নয়। তাহলে এগুলো কী? এগুলো হচ্ছেÑ আল্লাহর দেয়া জীবন-ব্যবস্থায় মানুষের জীবনের সর্বপ্রকার অঙ্গনের, ভাগের সমাধান ও ব্যবস্থা দেওয়া আছে; আল্লাহ বলেছেনÑ তোমাদের জন্য দীন আমি সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ করে দিয়েছি (সুরা মায়েদা-৩)। তাঁর দীনকে স্থায়ী ও স্থিতিশীল রাখার জন্য ও কখনও এটার ওপর কোন আক্রমণ আসলে তাকে প্রতিহত করার জন্য যে ঐক্য, শৃংখলা, আনুগত্যপূর্ণ ও অন্যায়বিরোধী চরিত্রের মানুষের প্রয়োজন সেই চরিত্রের মানুষ সৃষ্টির জন্য সালাতের বা নামাজের ব্যবস্থা রেখেছেন। অর্থ ও সম্পদের যাতে অসম বণ্টন না হয়, অবিচার না হয় সেজন্য যাকাতের ব্যবস্থা রেখেছেন। সমস্ত পৃথিবীতে দীনের কোথায় কী অবস্থা, কী সমস্যা, কোথায় কী করা প্রয়োজন এবং হাশরের দিনে আল্লাহর কাছে জীবনের কাজের হিসাব দেবার মহড়া বা জবযবধৎংধষ এর জন্য বাৎসরিক হজ্বের ব্যবস্থা রেখেছেন। মানুষের আত্মার পরিচ্ছন্নতা উন্নতির জন্য ব্যবস্থা রেখেছেন সাওমের।
প্রকৃত ইবাদত হচ্ছে আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা মোতাবেক তাঁর পক্ষ হয়ে শাসন করা। সেই ইবাদত থেকে এই জনসংখ্যা আজ শুধু লক্ষ কোটি মাইল দূরে নয়, একেবারে বিপরীতমুখী। দাজ্জাল তথা ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতার সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে আমরা আল্লাহর অবাধ্যতা করছি। এবং দাজ্জালের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা জীবনে প্রয়োগ করে দাজ্জালকে উপাসক হিসাবে মানছি।
এখন হেযবুত তওহীদ মানুষকে প্রকৃত ইসলামের দিকে, আল্লাহর তওহীদভিত্তিক সত্যদীনের দিকে আহ্বান করছে। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য ডাকছে। আসুন আমরা আল্লাহর হুকুমের উপর ঐক্যবদ্ধ হই, সার্বিক জীবনে আল্লাহর হুকুম তথা আল্লাহর উলুহিয়াত প্রতিষ্ঠা করি। তবেই আমরা প্রকৃত মুমিন-মুসলিম হতে পারব এবং আখেরাতে জান্নাতে যেতে পারব।