মাহবুব আলী:
আল্লাহ সৃষ্টি করলেন এই মহাবিশ্ব। কী বিশাল তাঁর এই সৃষ্টি! কী অসীম তার ব্যাপ্তি! সমস্ত সৃষ্টি জগত তিনি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করেন নিজ হাতে। একমাত্র ব্যতিক্রম এই পৃথিবী এবং মানবজাতি। তিনি পৃথিবীর মানুষসহ এখানের সমস্ত উপাদান, জীববৈচিত্র সমস্তকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ ও শান্তিরক্ষার দায়িত্ব দিলেন তাঁর নিজ হাতে সৃষ্ট খলিফা আদমের উপর। উদ্দেশ্য, পরীক্ষা করে দেখা তার সৃষ্ট খলিফা তার দেয়া আমানত, তাঁর ফুঁকে দেয়া রূহ, তার কাদেরিয়াহ অর্থাৎ ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কী করে (সুরা আহযাব ৭২, সুরা হেজর ২৯)। আর পরীক্ষার জন্য যেহেতু বিরুদ্ধ শক্তি দরকার, সেহেতু তিনি প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করালেন ইবলিসকে।
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির আগেই ইবলিস এই নতুন সৃষ্টির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, ‘এই নতুন সৃষ্টি তাঁর হুকুম মানবে না’ (সুরা আরাফ ১৭)। তারা পৃথিবীতে গিয়ে অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি-কাটাকাটি, যুদ্ধ, রক্তপাত এক কথায় ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ অশান্তি করবে। আল্লাহ বললেন তারা যাতে তা না করে তার জন্য তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে হাদী অর্থাৎ নবী রসুলদের মাধ্যমে হেদায়াহ ও সহজ সরল দীন পাঠাবেন। তারা তা মেনে চললে ইবলিসের দাবী করা সেই অশান্তিতে পড়বে না, শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে। ইবলিসও আল্লাহর কাছ থেকে কিছু ক্ষমতা নিয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বলল যে, সে দেখিয়ে দিবে তার কথাই সত্য, অর্থাৎ তার দাবি মোতাবেক মানুষ অশান্তি করবেই।
সংক্ষেপে এরপরের ঘটনা এই রূপ: আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং তাকে জান্নাতে বসবাস করার অনুমতি দিলেন। সেখানে প্রথমবারের মতো আদমকে দিয়ে ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করাতে সক্ষম হয়। আল্লাহ শাস্তি স্বরূপ তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে পৃথিবীতে পাঠান। সেখানে আদম (আ:) বংশবিস্তার করতে লাগলেন এবং আল্লাহর পাঠানো হুকুম অনুযায়ী জীবন ধারণ করতে থাকেন। ক্রমে আদম সন্তানগণ বৃদ্ধি পেয়ে দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা মোতাবেক প্রত্যেক জনপদে নবী রসুল পাঠিয়ে তাদের জন্য জীবনবিধান দেওয়া অব্যাহত রাখলেন। এদিকে ইবলিসও বসে ছিল না। সে মানুষকে দিয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করাতে থাকলো। মানবজাতি ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ভৌগোলিক পরিবেশ, তাপমাত্রা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে তাদের গায়ের রং, ভাষা ইত্যাদির পার্থক্য এসে গেল। তারা পরস্পর বিভিন্ন গোত্রে জাতিতে রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল। এতদিন পর্যন্ত আল্লাহ বিচ্ছিন্ন সকল জনগোষ্টির জন্য নবী রসুল পাঠানো অব্যাহত রাখলেন। নবী রসুলদের আনীত দীন দিয়ে তাঁরা বিদায় নিলে কিছু দিন পরেই তাদের অনুসারীরা শয়তানের প্ররোচনায় ঐ দীন আবার বিকৃত করে ফেলেছে, তখন আল্লাহ আবার আরেকজন নবী রসুল অবতার প্রেরণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ যখন জ্ঞানে বিজ্ঞানে, যোগাযোগে পরস্পর কাছাকাছি চলে এলো, তখন আল্লাহ পুরো মানবজাতিকে আবার এক বিধানের অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করতে চাইলেন। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল মানবজাতিকে নিয়ে আল্লাহর চূড়ান্ত অভিপ্রায়।
পূর্ববর্তী দীনসমূহ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে আল্লাহ তাঁর কেতাবগুলিতে শাস্তির দিক দিয়ে মদ্যপান, ব্যভিচার, জেনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখেছেন, কিন্তু শেষ কেতাবে দেখা যাবে ঐক্য নষ্ট করার শাস্তি সর্বোচ্চ। এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। ঐক্য নষ্ট করা মোনাফেকী এবং কুফর এবং তা করলে সরাসরি দীন থেকে বহিষ্কার (আব্দালাহ বিন আমর (রা.) থেকে মুসলিম, মেশকাত)। আল্লাহ রসুল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই উম্মতের ঐক্য ও সংহতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায় তাদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করে, তলোয়ার দ্বারা তোমরা তাকে শায়েস্তা করো, সে যেই হোক না কেন (হাদিস, আরফাজা (রা.) থেকে মুসলিম)।
পক্ষান্তরে সহিহ হাদিসে বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে কোনো লোক নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে ব্যভিচার করে ফেলেছেন। পরে শুধু অনুতপ্ত হয়েই তারা ক্ষান্ত হন নি, তারা আল্লাহর দেয়া শাস্তি গ্রহণ করে পবিত্র হতে চেয়েছে, তারা আল্লাহর রসুলের (সা.) কাছে এসে তাদের ব্যভিচারের কথা প্রকাশ করে দিয়ে শাস্তি চেয়েছেন। ঐসব ঘটনায় বিশ্বনবী (সা.) কী করেছেন তা লক্ষ্য করার বিষয়। কোনো সামান্যতম রাগ করেন নি বরং সমস্ত ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। ভাবটা এই রকম যে তুমি অপরাধ করে ফেলেছ তো ফেলেছই সেটা আবার প্রকাশ করতে এসেছ কেন? তুমি না বললে তো কেউ জানবেই না যে তুমি কী করেছ। কাজেই ও গোপন ঘটনা গোপনই রাখো। শাস্তি পেতে কৃতসংকল্প সেই লোককে যখন তিনি কিছুতেই বিরত করতে পারেন নি তখন তিনি তাকে উকিলের মতো জেরা করেছেন, এই উদ্দেশ্যে যে যদি ঐ লোকের বর্ণনায় কোনো খুঁত বের করতে পারেন তবে হয় শাস্তি দেবেন না বা লঘু শাস্তি দেবেন (হাদিস আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বোখারী, মুসলীম, মেশকাত)।
কিন্তু ঐক্য নষ্ট করার মতো কোন কাজ ঘটলে তিনি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন। আল্লাহ যাকে ইবলিসের উপরে গালেব করেছেন, সেই জিতেন্দ্রীয় মহামানব যখন রেগে লাল হয়ে যান তখন বুঝতে হবে সেই ব্যাপারটি অনেক সাংঘাতিক। সাংঘাতিক এই জন্য যে এখানে আল্লাহ ও রসুলের জয় পরাজয়ের প্রশ্ন। ব্যক্তির অপরাধ ব্যক্তিকে কলুষিত করে, সেটা তার জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু ঐক্য নষ্ট হলে ক্ষতি হয় পুরো জাতির। জাতির মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি মানেই আল্লাহর অভিপ্রায়ের পথে অন্তরায়, রসুলের সারা জীবনের উদ্দেশ্যের অন্তরায়। আগে সমস্ত মানবজাতির জন্য নাজেলকৃত পূর্বের সকল বিধানকে রদ করে তাঁর সর্বশেষ রসুলের মাধ্যমে একটি বিশ্বজনীন জীবনব্যবস্থা পাঠালেন। অন্য সকল নবী রসুলদের থেকে এই শেষ রসুলের পার্থক্য হলো- এবারে তিনি আর কোন নির্দিষ্ট জনপদের জন্য প্রেরিত নন, তাঁর কর্মক্ষেত্র সারা দুনিয়া। দ্বিতীয়ত, এবারে তাঁর আনীত দীন পৃথিবীর বাকি আয়ুষ্কাল অর্থাৎ কেয়ামত পর্যন্ত প্রযোজ্য। আল্লাহর প্রেরিত পূর্বের কেতাবগুলির সংরক্ষণভার এর আগে আল্লাহ নিজ হাতে গ্রহণ করেন নি। আর এবারের শেষ সংস্করণ আল্লাহর কেতাবের রক্ষাভার নিলেন স্বয়ং তিনি নিজে।
যেহেতু শেষ রসুলের দায়িত্ব সারা দুনিয়ায় দীন কায়েম করা, এবং এই কাজ একার দ্বারা সম্ভব নয়, সেহেতু তাঁকে এমন একটি জাতি তৈরি করতে হয়েছে যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী, যারা তাঁর অবর্তমানেও তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাবে। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রতিটি স্থানে শান্তি অর্থাৎ ইসলাম কায়েম না হবে ততদিন তাঁর উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ হবে না। আল্লাহ তাঁকে যে উপাধি দিয়েছেন, রহমাতাল্লেল আলামিন-সমস্ত দুনিয়ার উপর রহমতস্বরূপ তাও পূর্ণ হবে না। তাঁর চলে যাওয়ার পর তাঁর সৃষ্ট উম্মতে মোহাম্মদি কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেলেন ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত এবং পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের উপর এই দীনের বাস্তবায়ন করে গেলেন। যেহেতু বাকি দুনিয়ায় এখনো দীন কায়েম হয় নি এবং যতটুকুতে বাস্তবায়িত হয়েছিল তাও আজ ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জাল দখল করে সারা দুনিয়ায় তার হুকুম কায়েম করে রেখেছে, তাই আল্লাহর অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে গেলে আজ সারা দুনিয়াকে দাজ্জালের কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু আল্লাহর অভিপ্রায় হয়েছে এবং আল্লাহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন সেহেতু তা হবেই হবে। প্রশ্ন হলো কিভাবে? আল্লাহর রসুলের চলে যাবার পর তাঁর হাতে গড়া জাতি ৬০/৭০ বছর সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পর তা ছেড়ে দেয়। তাঁর গড়া উম্মতে মোহাম্মদী পৃথিবীতে আর বর্তমানে নেই। তাহলে এই কাজ এখন করবে কে?
এই কাজ সোজা নয়। পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত, হাজার হাজার ভাষা, সাদাকালোর ভেদাভেদ, শত শত ভৌগোলিক রাষ্ট্র, হাজারো ধর্মীয় মাজহাব, ফেরকা, তরিকা আর রাজনৈতিক মতবাদের দ্বারা মানবজাতি বিভক্ত হয়ে আছে। এখন তাদেরকে একজাতিতে পরিণত করা, একজন মাত্র নেতা, এমামের হুকুমে পরিচালিত করা আপাতঃদৃষ্টিতে অসম্ভব। যেখানে পৃথিবীর দক্ষিণপ্রান্ত, যাকে মাত্র আজ থেকে পাঁচশত বছর আগেও মানুষ জানতো না সেখানে কি আছে, ধারণা কোরত দেও-দানবের বাস, সেখানেও আজ মানুষের বসবাস। সাইবেরিয়া- যেখানে মানুষের বসবাস করা ছিল অকল্পনীয়, আজ সেখানে মানুষের অবাধ যাতায়াত। অ্যামাজন জঙ্গলের গহীন অরণ্য, যা মানুষের নিকট ছিল চির রহস্যময়, সেখানে আজ শুধু চেনা জানা নয়, রীতিমত মানুষের নখদর্পণে। হিমালয় পর্বতমালা, যাকে সমীহ করে দেব-দেবীদের আস্তানা ভেবে মানুষ তার পাদদেশে পূজা করত, সেখানে আজ উন্নত পর্যটন কেন্দ্র। বহু দেশের অভিযাত্রীরা নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে এসেছেন সেই পর্বত চূড়ায়। ভয়ঙ্কর সাহারা মরুভূমি ছিল মৃত্যুর অপর নাম, সেই সাহারার বুকে আজ মানুষের চাষাবাদ, ঘর বসতি। সুতরাং মানুষ আজ পৃথিবীর সর্বত্র গমন করছে, সর্বত্র বসবাস করছে। এই সমস্ত মানুষকে তাদের চিন্তা চেতনার ভিন্নতা, আচার আচরণ, ভাষার ভিন্নতা, মন-মানসিকতার তফাৎ, গোত্র, বর্ণের ব্যবধান, সমস্তকিছু ঘুচিয়ে একটি মাত্র জাতিতে পরিণত করা, একজন এমামের, নেতার হুকুমের অধীনে নিয়ে আসা সম্ভব দু’টি মাত্র উপায়ে। প্রথমত, হয় এমন একজন মানুষ আসবেন যিনি একটি মাত্র ফুঁ দিয়ে অলৌকিকভাবে এই কাজ করে ফেলবেন, বা তার দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত অলৌকিকভাবে ঐ কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। অথবা তাঁকে ঐ কাজটি মানুষের মাধ্যমেই করতে হবে। অর্থাৎ এমন একদল মানুষ থাকবেন যারা তাদের নেতা যা চান তা যতই কঠিন হোক হুকুমের সাথে সাথে তারা বাস্তবায়ন করে ফেলবেন। তাদের সামনে অসম্ভব বলে কিছু থাকবে না। হিমালয়ের মতো বাধা তাদের সামনে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এছাড়া তৃতীয় কোন উপায় নেই।
এবার দেখা যাক সম্ভাব্যতার বিচারে প্রথম উপায়টির উপযুক্ততা কতটুকু। ফুঁ দিয়ে বিরাট একটি কাজ বাস্তবায়ন করে ফেলাই কাজটি সম্পাদনের উপায় হোত তবে এর প্রথম হকদার হতেন আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল নিজে। কারণ, সমস্ত নবী রসুলদের তিনি নেতা, সমস্ত মানব জাতিকে শাফায়াত করার একমাত্র অধিকারী যিনি, যার সম্মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন আল্লাহ মাকামে মাহমুদায়, এবং দুনিয়াময় দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব শুধুমাত্র তাঁরই উপর। তাঁর পরে যারা এই দায়িত্ব পালন করবে তারা শুধু তাঁর অনুসারী উম্মতে মোহাম্মদী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। সুতরাং মহানবীর চাইতে কে বেশী হকদার ফুঁ এর মাধ্যমে ঐ কাজ সম্পাদন করার? তিনি কি তার দায়িত্ব ফুঁ দিয়ে পালন করতে পেরেছিলেন?
ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাস বলে অবর্ণনীয় নির্যাতন, জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন, উপহাস, ঠাট্টা, বিদ্রুপ সহ্য করে তিনি অটল পর্বতের মতো চালিয়ে গেছেন তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পূরণের সংগ্রাম। প্রাণপ্রিয় সঙ্গী সাথীদের সীমাহীন নির্যাতিত হতে দেখেছেন তিনি, নিহত হতে দেখেছেন, তাদের বুকফাটা আর্তি দেখেও কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তাঁর আত্মা। সর্বশেষ ওহুদের যুদ্ধে নিজের প্রাণের উপর হুমকি এলো, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হলেন তিনি, দু’টো দাঁত শহীদ হলো, তিনি রক্তাক্ত হলেন এবং শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ফুঁ দিয়েই যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হোত তবে কেন তিনি এত নির্যাতন মেনে নিলেন? তিনি কি পারতেন না ফুঁ এর মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান করে দিতে? তাঁকে জাগতিক পদ্ধতিতেই মোকাবেলা করতে হয়েছে সমস্ত প্রতিকূলতার। আল্লাহর সবচাইতে প্রিয়, সবচাইতে সম্মানিত রসুলকে যদি ফুঁ এর পরিবর্তে প্রাকৃতিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তবে আর কে আছেন এত পবিত্র, এত পূণ্যবান, এত সম্মানিত, এত মর্যাদাবান যিনি ফুঁ দিয়ে জীবন সম্পদ কোরবানি না করে, রক্ত-ঘাম না ঝরিয়ে দাজ্জালকে ধ্বংস করে পৃথিবীর কর্তৃত্ব নিয়ে নিবেন? সুতরাং প্রথম সম্ভাবনাটি আমরা বাদ দিতে পারি।
দ্বিতীয় পথ রইল প্রাকৃতিকভাবে সত্যিকার মোকাবেলায় দাজ্জালের কর্তৃত্বকে ধ্বংস করে আল্লাহর রসুলের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। আগেই বলেছি এ কাজ অত সোজা নয়। কিন্তু যতই কঠিন হোক কাউকে না কাউকে দিয়ে আল্লাহ তাঁর অভিপ্রায় পূর্ণ করবেনই, মানবজাতিকে একটি দীনের আওতায় আনবেনই। তাই যিনি একাজ সম্পন্ন করবেন অবশ্যই তার ঠিক ঐ রকম বজ্রশক্তি সম্পন্ন একদল অনুসারী থাকতে হবে যেমন ছিলেন আসহাবে রসুলগণ। তাদেরকে এমন হতে হবে যে তাদের নেতা, এমাম যা বলবেন তা যতই কঠিন হোক তারা সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করে ফেলবেন। তাদের সামনে অসম্ভব বলে কিছু থাকবে না। এমন একটি বজ্রশক্তিসম্পন্ন জাতি ছাড়া পৃথিবীর বুকে ঐ কাজ কিছুতেই সম্ভব নয়। ঐ জাতির কাজ হবে একটাই, আর তা হচ্ছে শুধুমাত্র আদেশ শোনা আর পালন করা। তারা কোন প্রশ্ন করবে না, দ্বিধা করবে না, কালক্ষেপণ করবে না। তাদের গুণ হবে ঐ একটাই। তারা পণ্ডিত হোক অথবা বোকা হোক, মহাশিক্ষিত হোক অথবা একেবারে নিরক্ষর হোক, ঐ একটা গুণ ছাড়া এ দুনিয়া বিজয় সম্ভব নয়। মানবজাতির ইতিহাসে বোধ হয় এ এক মহা অলৌকিক ঘটনা হবে, মো’জেজা হবে যে একজন মানুষ যিনি এক প্রচণ্ড বজ্রশক্তিধর জাতির এমাম, তিনি সমস্ত পৃথিবীতে যা চাইবেন তা হয়ে যাবে, অর্থাৎ কার্যকরী হবে। এই যে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ কাজ হয়ে যাওয়া অর্থ যে এক মুহূর্তের মধ্যে হবে তা নয়, তবে সেই কাজ হবে। সেই কাজ তাঁর বজ্রশক্তিধর জাতি সম্পাদন করে ফেলবে। এদের মাধ্যমেই পূর্ণ হবে আল্লাহর অভিপ্রায়, সমগ্র মানবজাতি শুরুতে যেমন ছিল একটি পরিবারভুক্ত আবার তারা একই পরিবারভুক্ত হয়ে যাবে। সে সময় এনশা’আল্লাহ অতি সন্নিকটে।