যখন যে জাতির মধ্যে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় সে জাতি সর্বদিকে অন্য জাতির চেয়ে এগিয়ে যায়। মুসলিম জাতিটি আল্লাহর রসুল বিদায় নেওয়া ৬০/৭০ বছর পরই তার উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে তারা সকল গতিশীলতা হারিয়ে স্থবির একটি জাতিতে পরিণত হয়। অপরদিকে ইউরোপের জাতিগুলি জেগে ওঠে। মুসলিমরা তাদের স্বর্ণযুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছে, ইউরোপীয় জাতিগুলি সেই ভিত্তির উপর গড়ে তোলে বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতার ইমারত। এক সময় ছিল যখন জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা করতে আরবী, ফারসি অর্থাৎ মুসলিমদের ভাষা শেখা ছিল বাধ্যতামূলক। মুসলিম শাসনামলে আমাদের উপমহাদেশে দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফারসি। ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশ দখল করে নেয় তখন তারা ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করে। তখন বাস্তবতার নিরীখে নতুন সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের মধু আহরণ করতে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকেও ইংরেজি ভাষার প্রতি মনোযোগী হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু সময়ের এ দাবিকে উপেক্ষা করে মুসলিম জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ইংরেজি শিক্ষা থেকে পিছিয়ে ছিল। শুধু তাই নয় ইংরেজি সংক্রান্ত যাবতীয় সবকিছুই তারা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে মুসলিমরা বহির্বিশ্ব ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে সাংঘাতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। এসলামের প্রকৃত শিক্ষা না থাকায় তাদের মধ্যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে আরবি, ফারসি ছাড়া অন্য কোন ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নেই এবং শেখাটা এসলামের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় কাজ।
এমনই একটি যুগে ১৮৭১ সালের ২৫ এপ্রিল উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পন্নী বংশীয় জমিদার পরিবারে জন্ম নেন ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁন মিয়া, যিনি পরবর্তী যুগে স্থির, অবিচলিত ও সাহসী বীর পুরুষ, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক, দানবীর এবং প্রজাহিতৈষী জমিদার হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। তার পিতা জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী, যিনি ছিলেন মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর প্রপিতামহ অর্থাৎ দাদার বাবা। আর মাতার নাম ছিল খোদেজা খাতুন। ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ছিলেন মাননীয় এমামুযযামানের দাদা হায়দার আলী খান পন্নীর ভাই। তার পারিবারিক নাম ছিল চাঁন মিয়া। সবাই তাকে আঁটিয়ার চাঁন বলে ডাকত। এই উপমহাদেশে তিনি মুসলিম রেনেসাঁর নায়ক হিসেবে খ্যাত। জমিদার পরিবারের সদস্য হওয়ায় পারিবারিক রীতিমাফিক তিনি বাড়িতে শিক্ষকদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি তার জীবন ও সম্পদ পুরোটাই জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেন এবং উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দয়ালু, দানশীল ও সমাজসংস্কারক জমিদার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
তিনি জমিদার তথা ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সভাপতি, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি এবং নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ বিরোধী আযাদী আন্দোলন করে কারাবরণ করেন ১৯২১ সালে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ়তার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁর তৈলচিত্রের নিচে লেখা রয়েছে-One who defied the British.
তিনি উপলব্ধি কোরেছিলেন যে, ‘ইংরেজি ভাষা ইংরেজরা জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা তাদের এমন একটি ষড়যন্ত্র যার দ্বারা তারা আমাদেরকে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আরও বেশি করে আবদ্ধ করতে চায়। এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও সত্য যে তাদের ভাষা না জানলে ও ইংরেজি শিক্ষার জ্ঞান না থাকলে ধূর্ত ইংরেজ শাসকদের হঠকারিতা আমরা মুসলিম জাতি বুঝতে পারবো না।’ চাঁন মিয়া জাতির বৃহত্তর এই কল্যাণের কথা চিন্তা করে টাঙ্গাইলের করটিয়ায় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে উচ্চ ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয়ে উন্নীত করে ‘হাফেজ মাহমুদ আলী ইনস্টিটিউশন’ নামকরণ করেন ১৯০১ সালে। ইংরেজ মি. স্মিথকে নিযুক্ত করেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর উদ্যোগে করটিয়ায় ১৯০৬ সালে সারা বাংলার মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ যিনি সম্পর্কে তার ভগ্নিপতি ছিলেন। এই ধারাক্রমে ১৯১০ সালে করটিয়ায় ইতিহাস খ্যাত মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।
সে সময় মুষ্টিমেয় কিছু স্কুল থাকলেও সেখানে বেতন এত বেশি ছিল যে, স্থানীয় মুসলিমদের পক্ষে সে বেতন দিয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। তাদের কথা চিন্তা করে চাঁন মিয়া গরিব মুসলিম ছাত্রদের বিনামূল্যে পড়াশুনার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তীতে আরো সমাজ সংস্কার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাত ও সমাজসংস্কারের মাধ্যমে তিনি তার মানবসেবার কাজকে সম্প্রসারিত করেন। চাঁন মিয়ার এই সংস্কারমূলক কাজের ফলে মুসলিম জাতি আরেকবার ভাগ্য বদলের সুযোগ পায়। তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের অধিষ্ঠিত করে, এর আগে ব্রিটিশদের চাকর বাকর হওয়া ছাড়া আর কোন চাকুরিতেই মুসলিমদের কোন অংশগ্রহণ দেখা যেত না।
১৯২৬ সালে তিনি দেশের প্রথম মুসলিম কলেজ হিসাবে সা’দাত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটি তার দাদা দেওয়ান সা’দৎ আলী খান পন্নী ওরফে হায়দরজান এর নামে নামকরণ করা হয়। সা’দাত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও প্রথম প্রধান নির্বাহী অধ্যক্ষ ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষক। গরিব মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষাদানের লক্ষ্যে চাঁন মিয়া সাহেবের অনুরোধে তিনি করটিয়ার সা’দাত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কলেজটিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ হিসেবে ঘোষণা করে। কলেজটি বহু আগে থেকেই প্রাচ্যের আলিগড় হিসাবে খ্যাতিলাভ করে। একই বছর অর্থাৎ ১৯২৬ সালে স্ত্রীর নামে রোকেয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পত্র-পত্রিকা, বই পুস্তক প্রকাশনায় অর্থ দান করেছেন। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার ব্যয় নির্বাহের অভিপ্রায়ে তিনি তাঁর সমস্ত স¤পত্তি, বসতবাড়ি ১৯২৬ সালের ৯ এপ্রিল এক ওয়াকফ দলিলের সৃষ্টি করেন; যার নম্বর ৩৩৪৯। চাঁদ মিয়া ১৯২১ সালে আলীপুর (কলিকাতা) জেলে থাকাকালীন ব্যারিস্টার আবদুস রসুল প্রতিষ্ঠিত ও মুজিবুর রহমান স¤পাদিত ‘দি মুসলমান’ পত্রিকার জন্য আর্থিক সাহায্যদান। জনহিতকর কাজের ব্রতে তাঁর বার্ষিক লক্ষ টাকা আয়ের জমিদার ওয়াকফ করেছেন। এই ওয়াকফ থেকে বৃত্তি পেয়ে বহু জনে বিদেশে গমন করেন, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে দেশবরেণ্য হন, যেমন নিখিল ভারতের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট বেগম ফজিলাতুন্নেসা যিনি ইডেন কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে করটিয়ায় ন্যাশনাল স্কুল স্থাপন করে শত শত চরকা বসান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অনেক ব্যারিস্টার, হাকিম, চাকুরিজীবী যোগ দিয়েছেন কিন্তু চাঁদ মিয়ার মতো চারলক্ষ টাকা আয়ের ভূম্যাধিকারী নিজেরও স¤পদের মায়া বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনে যোগ দেওয়া সত্যিই অনন্য ঘটনা।
ব্রিটিশ যুগে ভূমির নিরঙ্কুশ মালিক হিসাবে জমিদারদের ইচ্ছেমত খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে কৃষকদের বিদ্রোহ চরমে ওঠে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এর প্রেক্ষিতে সরকার ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করে যা প্রজাদের দাবিদাওয়া অনেকাংশে মেনে নিয়ে আইনটি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রজা ও মধ্যস্বত্বাধিকারীর অধিকার ও দায়দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করে। জমিদারদের স্বার্থ রক্ষায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের জমিদাররা একটি সংগঠনের জন্য পাঁচশত টাকা চাঁদা চাঁদ মিয়ার কাছে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান কোরেছিলেন, কারণ এই সংগঠন প্রজাদের কল্যাণে প্রবর্তিত প্রজা স্বত্ব আইনের বিরোধিতা করতো। মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলতেন এ দেশের জমিদাররা সবাই চাঁদ মিয়ার মতো হলে আমি জমিদারি উচ্ছেদ আইন সমর্থন করতাম না। উল্লেখ্য, দানের ক্ষেত্রে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী অদ্বিতীয় ছিলেন। এজন্যই তাকে ‘দানবীর’, ‘দ্বিতীয় মহসিন’ উপাধিতে ডাকা হতো। ১৯৩৬ সালে ২৫ এপ্রিল শনিবার তিনি ৬৭ বছর বয়সে করটিয়ায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।