মিশরীয় চলচ্চিত্রকার ইব্রাহীম ঈসার নির্মিত ‘মওলানা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। আল আজহার ভিত্তিক ওলামাসহ বিভিন্ন শ্রেণির মুসলিম ধর্মগুলো এই চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ করার জন্য জোরদাবি জানিয়েছিলেন। তাদের অভিযোগ এতে ওয়াজকারীদেরকে মুনাফিক ও অর্থ আত্মাসাৎকারী হিসাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে যা জনমনে বিভ্রান্তীর সৃষ্টি করতে পারে।
আন্তা মওলানা ফানসুরনা আলাল কাওমিল কাফেরীন (সুরা বাকারা ২৮৬)- এ আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, আপনিই আমাদের প্রভু (মাওলানা)! আপনি আমাদেরকে কাফেরদের বিরম্নদ্ধে সহযোগিতা করম্নন। পবিত্র কোর’আনে যত স্থানে মাওলানা শব্দটি এসেছে সেটি আল্লাহকে বোঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে আমরা ‘মাওলানা’ বলতে আলস্নাহকে বুঝি না, বুঝি সেই সম্প্রদায়কে যারা আলেম-ওলামা নামে পরিচিত।
যে নামটি আল্লাহ নিজের জন্য প্রতিবার ব্যবহার করেছেন সেই নামটিই এই আলেম সম্প্রদায় নিজেদের খেতাব হিসাবে ব্যবহার করছেন। এই ধৃষ্টতা ও বেয়াদবির কৈফিয়ৎ জানতে চাইলে তারা শব্দের বুৎপত্তি, আভিধানিক অর্থ, প্রতিশব্দ, হাক্বিক্বি এবং মাজাঝি ইত্যাদি নিয়মকানুন বলে বুঝিয়ে দেন যে আল্লাহ যেমন প্রভু বা অভিভাবক তেমনি আলেমরাও ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের প্রভু বা অভিভাবক। সুতরাং তাদেরকে আল্লাহর নামে ডাকা যথার্থ আছে (অবস্থাভেদে মানুষও প্রভু হতে পারে।) অর্থাৎ অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা শাস্ত্রকানা যতই হোন, এই ক্ষেত্রে ঘোর যুক্তিবাদী, দলিলের ধার ধারেন না, একে শেরেকিও মনে করেন না। অথচ শ্রদ্ধাবশত মুরব্বিদের কদমবুসি করাকেও তারা অনেকেই শেরকের কাতারে ফেলে দেন।
‘মওলা’ অর্থের আভিধানিক অর্থ অভিভাবক যদি হয় তাহলে কোর’আনের একটি বঙ্গানুবাদেও তো এই আয়াতে ‘আমাদের অভিভাবক’ এমন অনুবাদ করতে দেখা যায় না? কেবল কৈফিয়ত চাইলেই ব্যাকরণ বই টানাটানি শুরু করা হয়, বলেন আল্লাহর বেলায় হলে এক অর্থ আর মানুষের বেলায় হলে আরেক অর্থ।
এখন যদি আমাদের মতো কোনো অর্বাচীন প্রশ্ন করে বসে যে, আলস্নাহর রসুল যিনি মানবজাতির শিক্ষক তাঁকে কি তাঁর আসহাবগণ কোনোদিন মওলানা (অভিভাবক/প্রভু) বলে ডেকেছিলেন? না। তাঁকে সবাই রসুলালল্লাহ বলেই ডেকেছেন। তাঁর যে আসহাবগণ অর্ধ-পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে সত্যের আলোয় মানুষকে উদ্ভাসিত করেছেন, তাঁদেরকে কি মওলানা (অভিভাবক/প্রভু) বলে ডাকা হয়েছে? কোনো সাহাবী কি নামের আগে মওলানা জাতীয় কোনো টাইটেল ব্যবহার করতেন? না। কিন্তু পরবর্তীতে মিলাদের সুরে সুরে আল্লাহহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়্যাদেনা মাওলানা মোহাম্মদ বলে মহানবীকেও একটি অতিভক্ত গোষ্ঠী মাওলানা বানিয়ে দিয়েছে। এটি হচ্ছে কাদেরীয়া তরিকার প্রসিদ্ধতম দুরম্নদ, যে তরিকার জন্ম হয় রসুলাল্লহ ওফাতের অন্তত পাঁচশো বছর পর।
তাহলে বোঝা গেল এই ঘটনা ইসলামে ছিল না, পরে প্রবেশ করেছে। কেননা ধর্মজীবী কোনো পুরোহিত শ্রেণিই ইসলামে ছিল না। আর যে বিষয়গুলো দীনের মধ্যে পরবর্তীতে প্রবেশ করে সেগুলোকে বেদাত বলে। নয় কি? ইসলামের জ্ঞানীরা তাহলে বেদাতের সাফাই গাইছেন কেন? কারণ এই উপাধিতে তাদের জ্ঞান-গরিমার প্রকাশ ঘটে, তাদের ধর্মব্যবসার সুবিধা হয়।
তবে আমি কোনটি বেদা’ত, কোনটি জায়েজ, কোনটি না-জায়েজ এমন সিদ্ধান্ত দিতে বসি নি। এসব সিদ্ধান্ত দিতে গেলে নাকি দাড়ি থাকতে হয়, টুপি পরতে হয়, মাদ্রাসায় পড়া লাগে। আর এই সব প্রচলিত মানদ- দিয়ে মাপলে আমি ইসলাম নিয়ে কথা বলারও যোগ্যতা রাখি না। তাই ফতোয়া দেব না, ফতোয়াবাজি তারাই করুন যারা নিজেদেরকে আমাদের ‘প্রভু’ বলে দাবি করেন। আমি কেবল কিছু অসঙ্গতি মানুষের আদালতে পেশ করব। রায় দিবে মানুষ।
কোন কাজের কৈফিয়ৎ থাকে না বা ব্যাখ্যা থাকে না? সবকিছুরই কোনো না কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। সেটা সঠিক ব্যাখ্যাও হতে পারে আবার অপব্যাখ্যাও হতে পারে। কোনো ব্যাখ্যার নেপথ্যে যখন স্বার্থ বা উদ্দেশ্য জড়িয়ে যায় তখন সেই ব্যাখ্যা আর নিরপেক্ষ ও পরম সত্যে পূর্ণ থাকে না, তাতে ভেজাল মিশে যায়। এটাই অপব্যাখ্যা। আল্লাহর বলেছেন, তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করে না, যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা (আহসানা তাফসিরা) আমি তোমাকে দান করি না (ফুরক্বান ২৫/৩৩)।
আল্লাহর দেওয়া ব্যাখ্যাই হচ্ছে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়ের মানদ। তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা গ্রহণ না করার পেছনে স্বার্থই একমাত্র বাধা। ধর্মব্যবসায়ী ওলামারা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। তারা চান ধর্ম কেবল তাদের কাছেই গচ্ছিত ও কুক্ষিগত থাকুক। কেউ ধর্মের পথে চলতে গেলে যেন তাদেরকে অবশ্যই টোল দিয়ে যেতে হয়। ঠিক যেভাবে একজন ব্যবসায়ী চান তার পুঁজিকে ধরে রাখতে, একজন চাকুরিজীবী চান যেন তার চাকুরিতে কোনো আঁচড়ও না লাগে, তেমনি একজন ধর্মজীবীও চান তার হাত থেকে যেন কেউ এই নিশ্চিত রোজগারের পথটি কেড়ে নিতে না পারে। সেখানে কোনো আঘাত তারা সহ্য করেন না, অত্যন্ত উত্তেজিত, ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়ে পড়েন। এতে তাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।
সাপ তা বিষধর বা নির্বিষ যা-ই হোক, যখন সে ভীত হয়, তার নিরাপত্তায় আঘাত আসে তখন সে ফনা তুলে ছোবল মারতে উদ্যত হয়। একইভাবে ধর্মের বিনিময় গ্রহণকে হারাম বলা হলে ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মজীবীরা ফতোয়ার ফণা উদ্যত করে ছোবল মারেন। এটা ছিল নবী-রসুলদের সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’। এই উদাহরণ শুনে কেউ আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন না। ধর্মব্যবসায়ীরা যুগে যুগে বহু নবী-রসুলকে তারা হত্যা করে ফেলেছ। ঈসা (আ.) তাঁর যুগের ইহুদি আলেমদেরকে সাপ ও সাপের বংশধর বলে আখ্যায়িত করেছেন। এরাই তাঁকে ক্ররুশে চড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। আর আখেরী নবী বলেছেন, ‘আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নীচে নিকৃষ্টতম জীব’ (আলী রা. থেকে বায়হাকি, মেশকাত)। অর্থাৎ সাপের চেয়েও যদি নিকৃষ্ট কিছু থাকে তো সেটা আখেরি যামানার আলেমসমাজ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ইহুদি আলেমরাও তাদের সমাজে ‘রাব্বাই’ বলে অভিহিত হতেন যার অর্থ আমাদের প্রভু। আমাদের আলোচ্য ‘মওলানা’ শব্দের (মাওলা+আনা) হুবহু প্রতিশব্দ। ধর্মের প্রতিটি বিষয়ের সমাধানের জন্য আজও আমরা তাদের কাছেই দৌঁড়ে যাই। জীবনের অন্যান্য কোনো বিষয় নিয়েই আমরা তাদের কাছে পরামর্শের জন্য যাই না, পরামর্শ প্রদানের যোগ্যও মনে করি না। সেসব ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের সাধারণ জ্ঞানকে ব্যবহার করি। কিন্তু ধর্মীয় প্রসঙ্গে আমরা নিজেদের যাবতীয় বুদ্ধি-জ্ঞান-বিবেক বিসর্জন দিয়ে লেবাসধারী পেশাদার ধার্মিকদের শরণাপন্ন হই। এভাবে তাদেরকে আমরা আমাদের ধর্মজীবনের প্রভু বানিয়ে নিয়েছি। তাদের প্রতি আমাদের এই সমর্পণ যুগের পর যুগ ধরে জারি আছে।
পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোতেও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও তাদের প্রতি শর্তহীন সমর্পণের বিরোধিতা করা হয়েছে। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে ‘সমর্পণ’ হচ্ছে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি একজনের প্রতি আমার সিদ্ধান্তের দায়িত্ব সোপর্দ করব আর আমি কেবল তার আনুগত্য করব। বলা হয়েছে, এ সমর্পণ হতে হবে কেবল পরমাত্মার প্রতি এবং মানুষের মধ্যে যিনি সঠিক পথে আছেন তার প্রতি। যদি আমার সমর্পণ কোনো অপবিত্র স্বার্থপর দুকৃতকারীর প্রতি অর্পিত হয় তখন সে আমাকে দিয়ে অন্যায় করাবে এবং নিজের স্বার্থোদ্ধারে আমার সমর্পণকে যথেচ্ছ ব্যবহার করবে। আর আমিও আমার অপরাধের জন্য দ-িত হব। এর জন্য দায়ী ভুল ব্যক্তি/সম্প্রদায়ের প্রতি আমার সমর্পণ।
আল্লাহর কোর’আনে ঈসা (আ.) এর বিকৃত উম্মাহর ক্ষেত্রে বলেছেন এভাবে যে, “তারা তাদের আলেম ও পীর সাহেবদেরকে (রোহবান-সুফিসাধক) তাদের প্রভুরূপে (রব) গ্রহণ করেছে আলস্নাহর পরিবর্তে এবং মরিয়মের পুত্রকেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মাবুদের এবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোন হুকুমদাতা (এলাহ) নেই, তারা তাঁর শরীক সাব্য¯ত্ম করে, তার থেকে তিনি পবিত্র।” (সুরা তওবা ৩১)।
সুতরাং বোঝা গেল আলেম বা পীর সাহেবদেরকে প্রভু বা মওলা কেবল এই জাতিই বানায় নি, পূর্বের ইহুদি ও খ্রিষ্টানরাও একই কাজ করেছিল। তাদের মতো যেন এই উম্মাহও যেন পথভ্রষ্টতায় পতিত না হয় সেজন্য এই অতীত ইতিহাসগুলো আল্লাহর পুনঃপুনঃ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য উপর্যুক্ত আয়াতে এ কাজকে তিনি শেরক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহর প্রতিটি মানুষকে ভালো-মন্দ বোঝার জ্ঞান দিয়েছেন। মানুষ যদি সেই জ্ঞানকে ব্যবহার না করে তবে সে আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতের খেয়ানত বা অমর্যাদা করল। আল্লাহর এজন্য বার বার প্রশ্ন করেছেন, তোমরা কি তোমাদের সাধারণ জ্ঞানকে (আক্কেল) কাজে লাগাবে না? কোর’আনের সুস্পষ্ট নির্দেশ দেখেও নিজের জ্ঞানকে কাজে না লাগিয়ে ধর্মব্যবসায়ীদের মুখের দিকে চেয়ে থাকাই হচ্ছে তাদেরকে প্রভু হিসাবে মেনে নেওয়া। এটাই আলস্নাহর ঊর্ধ্বে কাউকে স্থান দেওয়া অর্থাৎ শেরক।
আল্লাহর এত বলে দিয়েছেন যে, অধিকাংশ আলেম ওলামা ও পীর-বুজুর্গরা মানুষকে আল্লাহর পথে চালিত করার পরিবর্তে আল্লাহর পথ থেকেই নিবৃত করে। তিনি বলেন, হে ঈমানদারগণ! আলেম ও পীরদের (রোহবান-সুফিবাদী) অনেকে লোকেদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকেদের নিবৃত রাখছে। যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আলস্নাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (সুরা তাওবা: ৩৪)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ধর্মজীবী গোষ্ঠী, যাদের কাছে মানুষ মুক্তির পথ সন্ধান করে তারা নিজেরাই জাহান্নামী। তাদেরকে আলস্নাহ ঘৃণা করেন। এরপরও যদি আপনি নিজের বিবেকের তালা বন্ধ রেখে কোনো মওলানা সাহেবের কাছে যান, তিনি আপনাকে কী বলবেন জানেন? তিনি আপনাকে বুঝিয়ে দিবেন যে, মওলানা শব্দ বিলকুল ঠিক আছে, ইসলামের কাজ করে টাকা নেওয়াও ঠিক আছে।
এখন আপনি কোন মওলার হুকুম মানবেন সে সিদ্ধাšত্ম আপনার।