রুফায়দাহ পন্নী
পন্নী পরিবারের সাথে উত্তরবঙ্গের সম্পর্ক আজকের নয়, চারশত বছরের। আমাদের পরিবার হাজার বছর ধরে এ দেশের উন্নতি, সমৃদ্ধির পেছনে, শাসনে শিক্ষায় সংস্কৃতিতে অবদান রেখে এসেছে। আমরা এখন এই বাংলার মাটিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ অন্যায়-অবিচার ও ষড়যন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করছি। আমার বাবা এমামুযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। সুলতানী যুগে এই পন্নী পরিবার বাংলা বিহার উড়িষ্যা সহ ভারতের বিরাট এলাকার স্বাধীন সুলতান ছিল। পন্নী সুলতানগণ কররানি হিসাবে ইতিহাসের পাতায় উল্লেখিত হয়েছেন। সুলতান দাউদ খান পন্নী মোঘল সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে বঙ্গভ‚মির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন রাজমহলের যুদ্ধে। সম্রাট আকবরের সময় যখন আমার পূর্বপুরুষ সাঈদ খান পন্নীকে আটিয়া পরগনার জায়গীরদার হিসাবে নিয়োগ করা হয় তখন বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রের তীর পর্যন্ত ওদিকে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা পর্যন্ত এই বিরাট এলাকা পন্নী পরিবারের শাসনের অধীন ছিল। ব্রিটিশদের সময়ে আমার সম্মানিত পূর্বপুরুষ, জমিদার খোদা নেওয়াজ খান পন্নীর সময় পুরো পরগনার জমিদারি নবাবের ষড়যন্ত্রে নাটোরের রানী ভবানীর অধীন হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর পরে আবার সেটাকে পুনরুদ্ধারও করা হয়। তাঁর ছেলে আলেপ খান পন্নীর সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। যাহোক, আমাদের পারিবারিক ইতিহাস বলতে গেলে বহু সময় লেগে যাবে। উত্তরবঙ্গে এসেছি, তাই এই মাটির সঙ্গে আমার বন্ধন কত গভীর সেটা একটু আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করলাম। এবার আমরা মূল আলোচনায় যাবো।
বিশ্বপরিস্থিতি
আমাদের আজকের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “ধর্মের অপব্যবহার নারী প্রগতির অন্তরায়”। বিষয়ের গভীরে যাওয়ার আগে আমরা একটু চলমান সময়ের দিকে দৃষ্টিপাত করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর সমগ্র পৃথিবীতে চলছে শক্তির শাসন। জোর যার মুল্লুক তার। সত্যের শাসন, ন্যায়ের শাসন কোথাও নেই। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, রক্তপাত, অন্যায়, অশান্তি। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা। সবচেয়ে বেশি করুণ অবস্থা আমাদের এই মুসলিম জাতির। যে কোনো প্রতিক‚ল পরিবেশে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় নারী ও শিশুরা অর্থাৎ যারা দুর্বল। মুসলিম নারীদেরকে ধর্মের ফতোয়ার নামে আজ দুর্বল বানিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানেই যুদ্ধ হচ্ছে সেখানেই তারা ধর্ষিতা হচ্ছেন। বসনিয়াতে খ্রিষ্টানরা, ফিলিস্তিনে, ইহুদিরা, বার্মায় জিংজিয়াং- এ বৌদ্ধরা, যে যেখানে পাচ্ছে সেখানেই মুসলিমদেরকে মারছে। আমাদের একটার পর একটা দেশ দখল করে নিচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া সব ধ্বংস করে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছে। সাড়ে ছয় কোটি উদ্বাস্তু এখন মুসলিম। তারা আজ ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়ায়। গতকালও তারা অনেকেই ছিল ধনকুবের।
ফতোয়ার বেড়াজালে অন্তরীণ নারী
আমাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীই নারী। সেই নারী আজ অবলা। তাদেরকে কে অবলা বানালো? আমরা সবাই জানি, পরহেজগার নারীর যে ছবি আমাদের সামনে শত শত বছর ধরে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে নারীদেরকে পর্দার অন্তরালে বন্দি না হয়ে উপায় নেই। তাদেরকে শেখানো হয়েছে, তারা থাকবে ঘরে। সেখানে থেকে তারা নামাজ-কালাম পড়বে, কোর’আন পড়বে আর স্বামী সন্তানের দেখাশোনা করবে, আসবাবপত্র পাহারা দেবে। এভাবেই অর্ধেক জনগোষ্ঠীর গৃহবন্দী হয়ে গেছে কেবল ধর্মের ফতোয়ার নামে। কিন্তু তারাও মানুষ। তাদেরও পুরুষের সমান অধিকার আছে নিজেদের যোগ্যতাকে, মেধাকে, প্রতিভাকে সমাজের জন্য ব্যবহার করার। ধর্মের ফতোয়া দিয়ে নারীর যে মেধা আছে, যোগ্যতা আছে সেটাকেই ভুলিয়ে দিল। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য সরকারের বহু প্রকল্প গ্রহণ করতে হচ্ছে। আমাদেরকে উপনিবেশ যুগে এভাবে শিক্ষায় জ্ঞানে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে দিয়েছে। মুসলিম নারীদের বানিয়ে ফেলা হয়েছে অবরোধবাসিনী, অন্তঃপুরিকা, অবগুণ্ঠিতা। এই অপ্রাকৃতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই হয়েছে বিদ্রোহ আর জাগরণ যা একটা পর্যায়ে ধর্মের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে অবস্থান নিয়েছে।
ইউরোপীয়দের আহ্বানে নারী হলো বস্তুবাদী
আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে যখন এই মুসলিমরা ইউরোপিয়ানদের দাসে পরিণত হলো তারা একটা পর্যায়ে নারীদের স্বাধীনতার কথা বলে তাদেরকে ঐ গৃহবন্দী অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করল। তারা এই জাতির নারীদের সামনে একটি বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থা উপস্থাপন করল। অন্তঃপুরে বন্দিনী নারীরা জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেল, তারা বুঝল যে দুনিয়াটাই সব। এটাকে ভোগ করাই হলো জীবনের সার্থকতা। ভোগবাদী হতে গিয়ে তাদের সামনে শ্লীলতা, অশ্লীলতা বলে কোনো মানদণ্ড রইল না। কারণ ঐ মানদণ্ডটা আসে ধর্ম থেকে। ধর্মকেই তো বাদ দেওয়া হয়েছে। ধর্মের জীবন দর্শন ছিল এই জীবনটা শেষ নয়, পরের জীবনটাই আসল। এই জীবনের কর্মের জন্য আমাকে পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। এই জীবনে যদি আমি ভালো করি তাহলে আমি জান্নাত যাব। এখানে যদি খারাপ করি তাহলে জাহান্নামে যাব। নরকের বিভিন্ন স্তর আছে, স্বর্গেরও বিভিন্ন স্তর আছে। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতায় জীবন দর্শনের সেইদিক থেকে পুরো অস্বীকার করা হলো। পরকাল বলতে কিছু নেই, এই জীবনটায় শুধু ফুর্তি করো। এখানেই তখন তারা চরম বস্তুবাদী হয়ে গেলো। নারীরাও বস্তুবাদী হয়ে গেল। পশ্চিমারা প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করল, তারা সেগুলো বাজারজাত করার জন্য বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নিল। তারা বিরাট বিরাট করপোরেশন গড়ে তুলল। এখানে তারা নারীকে ব্যবসার অবলম্বন হিসাবে নিলো। নারীকে তারা নানাভাবে উপস্থাপন করতে শুরু করল। পণ্যের মূল্য নির্ভর করে মডেলের উপর। এভাবে নারীকে আবারো পণ্যে পরিণত করা হলো, সভ্যতার নামে, আধুনিকতার নামে।
সভ্যতার সংঘাত
ধর্ম আর ধর্মহীনতা এই দুটো সভ্যতা পৃথিবীতে বিরাজ করছে। এখন পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ ইউরোপিয়ানদের হাতে যারা গত পাঁচশ বছর ধরে ধর্মকে জীবন থেকে বিতাড়িত করার জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই দুটো বিপরীতমুখী সভ্যতার মধ্যে এখন চ‚ড়ান্ত সংঘাত চলছে। যারা ধর্মহীনতার বিস্তার ঘটাতে চায় তাদের হাতে আছে গণমাধ্যম। তারা প্রচার করছে, ধর্ম একটি কুসংস্কার, ধর্ম প্রাচীনপন্থা, মানবতাবিরোধী দর্শন। ধর্ম মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, মিথ্যা ভয় দেখিয়ে মানুষের সৃজনশীলতা, বাকস্বাধীনতা, সুকুমারবৃত্তিকে বিনষ্ট করে। তারা ধর্মের মহামানবদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে প্রচার করে যাচ্ছে, মানুষকে ধর্মবিমুখ করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যারা ধর্মবিশ্বাসী তারা এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছে। এভাবে নারী-পুরুষ সবাই এই সভ্যতার দ্ব›েদ্ব, ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনে জড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ এখন ধর্মহীনতার ধারকদের হাতে। তারা টার্গেট করেছে ইসলামকে, কারণ ইসলামে পরিপূর্ণ জীবনবিধান আছে যা দিয়ে বিশ্বব্যবস্থা থেকে শুরু করে মানুষের আত্মার সংকটগুলোরও সমাধান রয়েছে। অর্থাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা গড়ে তোলার শক্তি আছে এবং নিকট অতীতে যেটির বাস্তবায়নও হয়েছে।
শত সহস্র ইসলামের মধ্যে কোনটি ইসলাম?
ইসলাম কী আসলেও আমাদের পোশাকের নামে বাড়াবাড়ি করা শেখায়? ইসলাম কি সঙ্গীতকে অস্বীকার করেছে? পুরুষের পাশাপাশি সামাজিক সকল কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে? আমাদের সামর্থ্য, প্রতিভা, সাহসিকতা ও জ্ঞানকে অস্বীকার করেছে? আসুন এবার আমরা যাই ধর্মের দিকে। আপনারা ধর্মের যে চিত্রটা দেখতে পাচ্ছেন, এটা ধর্মের আসল চেহারা নয়। কীভাবে আসল চেহারা হবে? এই মুসলিমদের মধ্যে এখন লক্ষাধিক ভাগ। কোন ভাগটি সঠিক?
পীরতন্ত্র
একটি ভাগ হচ্ছে পীরপন্থীদের। একেক পীরের একেক তরিকা। ১৪শ বছর আগে এ জাতির তরিকা ছিল একটি। এক আল্লাহ, এক রসুল, এক কেতাব, একটা উম্মাহ, একটা লক্ষ, একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেই ধর্মের চেহারা আজ কি হলো? একেক পীরের একেক তরিকা। হাজার হাজার পীর, লক্ষ লক্ষ পীর, পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় পীর। পীরেরা বলছেন আমার হাতে বায়াত নাও, তুমি জান্নাত যাবে। মেয়েরা সোনা, বাড়ি ঘর বিক্রি করে পীরের কাছে দিয়ে যাচ্ছে। হাশরের দিন তারা জান্নাত চলে যাবে পীরের সাহায্যে। কোন পীরের হাতে তাহলে বায়াত নিলে নিশ্চিতরূপে জান্নাতে যাওয়া যাবে এটা কেউ বলতে পারছেন না।
কথিত রাজনৈতিক ইসলাম
ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে বহু গণতান্ত্রিক ধারার দল রাজনীতি করছে। তাদের একেক দলের একেক কর্মসূচি, একেক মনোগ্রাম, একেক ব্যানারে। কেউ সরকারি দলে যাচ্ছেন, কেউ বিরোধী দলে যাচ্ছেন, কেউ জ্বালাও পোড়াও করছেন, কেউ তার বিরোধিতা করছেন। এখন তারা বলছেন আমাদের দলে যোগ দাও। নারীদের উদ্বুদ্ধ করছেন যে আমার ব্যালটে ভোট দাও, আমার ব্যালটে ভোট দিলে তুমি জান্নাত যাবে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে এটা কোন ব্যালটে ভোট দিলে জান্নাত যাবে?
জঙ্গিবাদী ইসলাম
আরেকটা হলো জঙ্গিবাদী দল। তারা আবার নারীদেরকেও উদ্বুদ্ধ করছে। কিছুদিন আগে একটা ঘরে যখন আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ করা হলো সেখানে তিন মাসের একটা বাচ্চাকে টুকরা টুকরা করে দেওয়া হলো। ছয় বছরের একটা মেয়েকে টুকরা টুকরা করে দেওয়া হলো। নারীরাও ধ্বংস হয়ে গেলো, পুরুষটাও ধ্বংস হয়ে গেলো। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, “তারা বলবে তারা শহীদ হয়েছে।” আমার কথা হচ্ছে- তুমি শহীদ হও কারো আপত্তি করার কিছু নেই কিন্তু ছয় মাসের বাচ্চাতো জীবনের সিদ্ধান্তই এখনো নিতে পারে নি। সে কেন মরল তার জবাব হাশরের দিন তোমাকে দিতে হবে। তোমার রাস্তা যে সঠিক রাস্তা তাকে তো বুঝতে দাও নি। তুমি যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারো নাও, কিন্তু তোমার বাচ্চাকে তো এভাবে উড়িয়ে দিতে পারো না। এটা কোন যুক্তিতে, কোন ধর্মে আছে? রসুলের ইসলামে তো আমরা এরকম দেখি না।
আমাদের ঈমান লুট হয়েছে
আজকে কেউ বোমা মেরে জান্নাত যাচ্ছে, কেউ পীরের আস্তানায় টাকা দিয়ে জান্নাত যাচ্ছে, কেউ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করে জান্নাত যাচ্ছে। কিন্তু ইসলাম তো এতটা না। সোজা কথা হলো, মানুষের ইমানকে হাইজ্যাক করা হয়েছে, ভুল খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটাই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ভুল। একটি পথেও মানুষ আল্লাহকে পায় নাই, রসুলকেও পায় নাই, জান্নাতও পায় নাই। মধ্যখানে আল্লাহ রসুলের বদনাম হয়েছে, কেতাবের বদনাম হয়েছে, ধর্মের বদনাম হয়েছে। ইসলামভীতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে একদল বংশগত মুসলমান নাস্তিক্যবাদের দিকে পা বাড়িয়েছে।
ধর্ম এখন এক নম্বর ইস্যু
এই সভ্যতার সংঘাত মানবজাতিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এখন বিশ্বরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে, সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ম নাম্বার ওয়ান ইস্যু। ধর্মকে অস্বীকার করতে পারছে না শাসকরা। অবজ্ঞাও করতে পারছেন না। এখন তাদের মাথা খারাপ অবস্থা। মিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ খরচ করছেন মারণাস্ত্র তৈরি করছেন। অ্যারেস্ট করছেন ফাঁসি দিচ্ছেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমাদের পাশের দেশ ভারতে ধর্মের নামে রাজনীতি হচ্ছে। যে ইউরোপ ধর্মকে বাদ দিয়েছে সেই ইউরোপ এখন রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছে। ফ্রান্স ধর্মকে ঘৃণা করে তারা এখন ধর্ম নিয়ে পলিটিক্স করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে ধর্ম নিয়ে। আমাদের বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত ধর্ম নাম্বার ওয়ান ইস্যু, কোনো শাসকই ধর্মবিশ্বাসকে আমলে না নিয়ে পারছেন না। জনগণের ভোট পাবার জন্য রাষ্ট্র ইসলাম ঘোষণা করেছে, হজ্ব ওমরা পালন করছে, বেশি বেশি মসজিদ মাদ্রাসা বসাচ্ছে। এসব থেকে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির সৃষ্টি হচ্ছে যারা মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে জীবিকা নির্বাহ করছে, যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু মানুষ ধর্মের প্রকৃত চেহারা দেখতে পাচ্ছে না- না নারী, না পুরুষ।
ইসলামপূর্ব আরবে নারী
আজ থেকে ১৪ শ’ বছর আগে সেই আরবের জাহেলিয়াতের যুগে নারীদের অবস্থা কেমন ছিল তা সকলেই জানেন। মেয়ে শিশুদেরকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। নারী মানেই পরিবারের জন্য একটি বোঝা। যারা দেখতে খারাপ ছিল তাদেরকে মেরে ফেলত। আর যারা দেখতে শুনতে একটু ভালো ছিল তাদেরকে এরা নর্তকী হিসাবে ব্যবহার করত। তারা স্বীকারই করত না যে মেয়েদেরও প্রতিভা আছে জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, সমাজে কার্যকরী অবদান রাখার যোগ্যতা আছে। তারা কেবল মনোরঞ্জনের উপাদান, বিনোদনের সামগ্রী নয়। সেখানে সবচেয়ে নির্যাতিত হতো নারীরা। মদ্যপান ছিল প্রকাশ্য আর অবারিত। গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ চলত বংশ পরম্পরায়। মরু অঞ্চল বিধায় কৃষি বলতে তেমন কিছুই ছিল না, খনিজ সম্পদ ছিল না, বনজ সম্পদ ছিল না। ক্ষুধা-দারিদ্র, অজ্ঞতা ছিল জাতীয় বৈশিষ্ট্য।
রসুল ধর্মের শিক্ষা প্রদান করলেন
এই অবস্থা দেখে একজন মানুষ ব্যতিব্যস্ত, হলেন দুঃখিত হলেন। তিনি হলেন রহমাতাল্লিল আলামিন, আখেরী নবী হুজুরে করিম (দ.)। তিনি ভাবতে লাগলে কীভাবে মানুষের মুক্তি সম্ভব। কাষ্ঠখণ্ডের মত একশ্রেণির মানুষ আছে সমাজের মধ্যে তাদের সমাজের অন্যায় অবিচার নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নাই। খাচ্ছে দাচ্ছে যেভাবে পারে দিন পার করছে। এটা পশুর স্বভাব, এটা মানুষের স্বভাব নয়। এত অন্যায় অবিচার দেখেও মানুষের মন যদি বিক্ষুব্ধ না হয়- তাহলে কীসের মানুষ তুমি? ধর্ম তো পরের কথা – তুমি তো মানুষই না। তোমার ভিতরে মানবতার মূল লক্ষণটাই নাই। তিনি ক্ষুব্ধ হলেন, পথ খুঁজতে লাগলেন। তারপর আল্লাহ তাঁকে পথ দেখালেন। আল্লাহ বললেন, মানুষকে তওহীদের উপর- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কথার উপর ঐক্যবদ্ধ করো। এক আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না – এই কথার উপর ধীরে ধীরে ঐ আরবের মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধ হলো।
একজন নারী ধর্ষিতা হলে আপনার পর্দা মূল্যহীন
আপনারা মনে রাখবেন, আমরা কোনো মোল্লার কাছ থেকে, পীর সাহেবদের থেকে ধর্ম শিখব না। এতদিন শিখেছি, শিখে মার খেয়ে গেছি, খাচ্ছি। আমরা নিপীড়িত হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি, আমরা সা¤্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছি। আমাদের মা-বোনেরা ধর্ষিতা হয়ে, আমাদের সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান আমরা বুঝি না- একজন নারী যদি ধর্ষিতা হয় আমাদের ঘরের পর্দাশীল নারীরও কোনো ইজ্জত থাকে না। এটাই যদি না হবে তাহলে কীসের ভাই- কীসের বোন, কীসের জাতি? ক্ষুধার জ্বালায় যদি একজন নারীও ইজ্জত বিক্রি করতে যায় সেখানে আমি ঘরে বসে বসে ওজিফা পড়ব, আমার এই তসবীহ দানার হিসাব আল্লাহ নিবেন না। এটা আল্লাহর এবাদত না, যখন মানবতা ভ‚-লুণ্ঠিত তখন মানবাধিকার সমুন্নত করাই এবাদত। এটা আল্লাহর রসুল সারাজীবনের কঠোর সংগ্রাম ও সাধনার দ্বারা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। একটি নির্যাতিত নারীর চিঠি পেয়ে সিন্ধুবিজয় করেছিলেন কিশোর সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেম। ধর্মের আসল রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।
ইসলাম যে নারী বানিয়েছিল
প্রথমে নারীরা আজকে শিখেন। কোন মৌলানা কোন পীর সাহেব কী বলল আমরা দেখব না- আল্লাহ কী বলছেন সেটা দেখব। এটাই হচ্ছে – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ কী বলেছেন, রসুল কী করছেন আসেন সেটা দেখি। তিনি নারীদেরকে কী করলেন? তিনি জাহেলি যুগের নারীদেরকে শালীন পোশাক পরিয়ে দিলেন। নারীরা সম্মানিতা হলো, শ্রদ্ধার পাত্রী হলো। তাদেরকে আগে শালীনতা শিখালেন। শালীনতা শিখিয়ে তিনি কি নারীদেরকে বলছেন যে তোমরা ঘরের ভিতর থেকে বের হবে না, পরপুরুষ তোমাদের দেখলে তোমরা জাহান্নামে চলে যাবে, তোমাদের ঈমান চলে যাবে? না, এটা তিনি বলেন নি। তিনি তাদেরকে গৃহকোণ থেকে বের করে আনলেন। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। তিনি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার গুণাবলী শিক্ষা দিলেন, তাদেরকে যুদ্ধ করতে শেখালেন, তলোয়ার চালনা, বল্লম চালনা, ঘোড়া ছোটানো শেখালেন। নারী প্রগতির এক বিস্ময়কর অধ্যায় তিনি রচনা করলেন। সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের অবজ্ঞাত অবহেলিত উপেক্ষিত অত্যাচারিত নারীরা বোমার মত বিস্ফোরিত হয়ে গেল। একটা ঝড়ের সৃষ্টি করে দিল। মেয়েরা চলে গেল জেহাদের ময়দানে। যুদ্ধের মাঠে তারা শত্রুপক্ষের বাহিনীর মধ্যে তাণ্ডব ঘটিয়ে দিলেন। পুরুষরা যেখানে কুলিয়ে উঠতে পারেন নি, সেখানে পর্যন্ত মেয়েরা অসম সাহসিকতার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনলেন। এমন কি তারা রসুলকে পর্যন্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। ওহুদের মাঠে রসুল যখন কাফেরদের তীরে জর্জরিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, অনেক সাহাবী যখন শহীদ হয়ে যান তখন উম্মে আম্মারা তলোয়ার হাতে এমনভাবে রসুলের চারপাশে লড়াই চালিয়েছেন যে, রসুল বলেছেন সেদিন যেদিকেই তাকাই শুধু উম্মে আম্মরাকেই দেখেছি। ডানে উম্মে আম্মারা- বামে উম্মে আম্মারা।
খাওলা বিনতে আজওয়ার দুর্ধর্ষ রোমান সৈন্যদেরকে পরাজিত করে আপন ভাইকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছেন। সেই নারীদেরকে রসুল বাজার ব্যবস্থাপনার কাজে লাগিয়ে দিলেন। তলোয়ার নিয়ে মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দেখতো কেউ দ্রব্যে ভেজাল দেয় কিনা। হাসপাতালের সব কাজে মেয়েরা। তারা আহতদেরকে চিকিৎসা করত। সেবা করত, শহীদদের দাফন করতেন। হাসপাতালের প্রধানও ছিলেন একজন মেয়ে। জুম্মার নামাজে মেয়েরা অংশ গ্রহণ করত। রাত্রে বেলার নামাজেও তারা মসজিদে যেত। এভাবে জীবনের প্রত্যেকটা কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ আল্লাহর রসুল নিশ্চিত করলেন। তিনি যখন নিজ বাড়িতে বা মসজিদে বসে আলোচনা করতেন তখন তাঁর ও নারীদের মধ্যে কোনো পর্দা টাঙানো থাকতো না। আমাদেও ইতিহাসে কেউ দেখাতে পারবে না এটা। যদি কেউ এটা দেখাতে পারেন যে রসুল এবং মেয়েদেও মাঝে পর্দা টানানো ছিল তাহলে আমি তার গোলামী করব। তারা সামনা সামনি বসে বসে আলোচনা শুনতেন। প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে নিতেন। এমন এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতেন রসুলাল্লাহর স্ত্রীরাও লজ্জা পেয়ে যেতেন। কিন্তু শিক্ষার জন্য তাদেরকে করতেই হয়েছে। শরিয়ত শিখতে হবে রসুলের কাছ থেকেই।
জাল হাদিসের দৌরাত্ম
সেই ইসলাম আজ এমন হলো কীভাবে? মেয়েরা নামাজে যেতে পারবে না মেয়েরা পর্দার আড়ালে থাকবে। মেয়েরা সেনাবাহিনীতে যাবে না। বর্তমানে অসংখ্য জাল হাদিস চালু আছে। নারীকে পর্দাপ্রথার জালে বন্দী করে রাখার জন্য অতিরঞ্জিত হাদিস, জাল হাদিস বেশি বেশি ওয়াজ মাহফিল করে, তালিম করে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। একটা হাদিসে বলা হয়েছে অন্ধ উম্মে মাকতুমকে দেখে পর্দা করার জন্য। মেয়েরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি তো অন্ধ?’ রসুলাল্লাহ বললেন, ‘তোমরা তো অন্ধ না।’ এটা যদি হাদিস হয় তাহলে রসুল স্বয়ং কী করে মেয়েদের নিয়ে আলোচনা সভা করলেন, তাদেরকে যুদ্ধে নিয়ে গেলেন আর কী করেই বা এক জামাতে নামাজ পড়ালেন। যুদ্ধরত সৈন্যরা তো অন্ধ ছিল না বা মো’মেন নারীরাও অন্ধ ছিলেন না। রসুলের সমগ্র কর্মজীবন এই হাদিসগুলো পক্ষে যায় না। রসুলাল্লাহর স্ত্রী আম্মা আয়েশা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি উটের যুদ্ধে দশ হাজার সৈন্যকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেউ কি তখন বলেছে যে নারী নেতৃত্ব হারাম? নারীদের এই সব কীর্তির কথা ইতিহাসে নেই, সব ইতিহাসে কেবল পুরুষের জয়জয়কার। এ কথাই নজরুল লিখে গেছেন-
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয় নি তো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।
[লেখক: সংগঠক, হেযবুত তওহীদ।]