পদ্মা মেঘনা যমুনার অববাহিকায় হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাস নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। মানব সভ্যতার বিকাশ থেকে এই অঞ্চলের মানুষের বসে বসে সূচনা শুরু হয়। বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে সমাজের মানুষ আজকের এই আধুনিক সভ্যতা নির্মাণ করেছে। আর এ নির্মাণের পেছনে ছিল শত শত মানুষের কর্ম পরিকল্পনা আর কঠোর পরিশ্রম। এসবই হয়েছে বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীর হাত ধরে। অনার্যদের আগমনের পূর্বে আর্য শাসকগোষ্ঠীর থেকে শুরু করে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলকে শাসন করে চলেছে। কিন্তু এর মাঝে প্রায় এক হাজার বছর মুসলমানদের অধীনে ছিল এই অঞ্চল। সেই সময়ে এ অঞ্চলের মানুষের অবস্থা অর্থাৎ বসবাসের উপযোগিতা কেমন ছিল সেই উঠে এসেছে ওয়াকিল আহমেদের লেখা “বাংলায় বিদেশি পর্যটক” নামক গবেষণা গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে বাংলায় বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ করা বিভিন্ন পরিব্রাজক, পর্যটকদের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তারা বাংলা ভ্রমণ করে বাংলার অবস্থাটা কী রকম দেখেছেন সেই বিষয়গুলো এখানে লেখক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
পর্যটকদের আগমন এর ব্যাপারে সবার মধ্যে একই রকম উদ্দেশ্য ছিল না। কেউ এসেছেন ধর্ম প্রচার করতে, আবার কেউ এসেছেন ব্যবসা করতে, কেউ এসেছেন দেশ ভ্রমণের আনন্দ জন্য, আবার কেউ এসেছেন রাজপ্রতিনিধি হিসেবে। এসকল পর্যটকদের মধ্যে ধর্মপ্রচারকদের সংখ্যা অনেক বেশি। নবম শতকের দিকে আরো মুসলিমগণ চট্টগ্রামের বাণিজ্য পরিচালনা ও ধর্ম প্রচারের সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিল। এর মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে মুসলিম বিজয়ের সূচনা শুরু হয়। বাংলার পণ্যের স্বল্পমূল্যে অধিকাংশ পর্যটক বিস্মিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ইবনে বতুতা ছিলেন অন্যতম। ইবনে বতুতা এই অঞ্চলকে দোজখ-ই পুর নিয়ামত (ধন-সম্পদে পূর্ণ নরক) বলেছেন। কারণ তিনি এ অঞ্চলের শস্য ভাণ্ডারের সহজলভ্যতা দেখেছিলেন যা আর পৃথিবীর কোথাও দেখেননি। ইবনে বতুতা এ দেশে বসবাসকারী একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, মাত্র ৮ দিরহামে তিনি তার পরিবারের সারা বছরের খাদ্য খরচ করতে পারতেন। কিন্তু এ অঞ্চলের আবহাওয়া জলবায়ু তার মোটেও পছন্দ হয়নি। এজন্যই তিনি এ অঞ্চলকে নেয়ামতপূর্ণ নরক বলেছিলেন।
ইবনে বতুতার প্রায় দেড়শত বছর পর ইতালির পর্যটক ভারথেমা এদেশের সুলভ পণ্যের অভিন্ন রূপের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ও I never saw a country which provisions were so cheap. এছাড়াও ইতালির আরেক পর্যটক সিজার ফ্রেডারিক মেঘনা নদীর মুখে সন্দ্বীপের খাদ্যপণ্যের সস্তা দামের কথা উল্লেখ করেছেন। পর্যটক ভারথেমা ‘বংঘেল্প’ শহরের মুসলমান ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে ধনী বলে উল্লেখ করেছেন।
তারও প্রায় ১০০ বছর আগে চৈনিক পর্যটক ফেইসিন ১৪১৫ সালে পাণ্ডুয়ার মুসলমান ব্যবসায়ীর ১০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার কারবার ছিলে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পর্যটক সেবাস্টিন মানরিক ১৬৪০ সালে স্থানীয় মুসলিম বণিকদের ব্যাপারে লিখেছেন, বণিকেরা টাকা গণনা করা শ্রমসাধ্য বলে ওজন করে নিত। ইবনে বতুতার মতে, ১৩৪৬ সালের দিকে ১ মুদ্রায় ৯ মণ চাল পাওয়া যেত। আর বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন, শায়েস্তা খানের আমলে ১ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। বিভিন্ন পর্যটক বর্ণনায় গরুর মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মুসলিম শাসন আমলের সময় একটি দুগ্ধবতী গাভীর দাম ছিল গড়পরতা দুই টাকা। গরুর এরকম মূল্য বজায় ছিল প্রায় ৪০০ বছর।
মধ্যযুগের বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো মোটামুটি ভাবে একটা অপরিবর্তনীয় পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতো, কারণ তখন আজকের মত এরকম সিন্ডিকেট ছিল না। চিনি বস্ত্র মুরগি প্রভৃতি দ্রব্যের মূল্য অনেক কম ছিল। এদেশের পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত পণ্য তখন রপ্তানি করা হতো এর মধ্যে চাউল, চিনি, মরিচ, নীল, তেল, বস্ত্র, মাদুর, রেশম ও বিবিধ প্রসাধনদ্রব্য। অবশ্য তখন আমদানি করা হতো অনেক পণ্য। যেমন রূপা, মূল্যবান পাথর, টিন, দস্তা ইত্যাদি।
এসব রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে বস্ত্রশিল্প সারা দুনিয়ার বাংলা ও বাঙালির খ্যাতি ছড়িয়ে রেখেছিল। মসৃণতা ও সূক্ষ্মতার গুণে এদেশীয় মসলিন বস্ত্র বিশ্ববাসীর বিস্ময়ে পরিণত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পণ্য হিসেবে মসলিন বস্ত্র একচেটিয়া পণ্যের মর্যাদা লাভ করে। বাংলার মোগল যুগ ছিল মসলিন বস্ত্ররের স্বর্ণযুগ। পর্যটক প্লিনি তিনি তার ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থে কয়েক প্রকার মসলিনের কথা উল্লেখ। দ্বিতীয় শতকে টলেমি থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকের মার্কোপোলো প্রমুখ ভ্রমণকারী এদেশীয় সূক্ষ্ম বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এসব পর্যটকদের মধ্যে আরবদেশীয় পর্যটক সোলেমান মসলিন বস্ত্রের কথা সুন্দরভাবে উল্লেখ করেছেন। আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলায় মসলিন বস্ত্র উৎপাদিত হতো। এ সময়ে ওলন্দাজ পর্যটক স্টাভোরিন পূর্ববাংলার মলমল ও তানজেব বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। পর্যটক টেলরের ১৮৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর The Sketch of the Topography and Statistics of Dhaka গ্রন্থে মসলিনের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তার মতে, ঢাকার মসলিন মানুষের হাতের তৈরী নয়, তা পরীদের হাতের তৈরি কাজ। বিদেশি এসব পর্যটকদের বর্ণনা থেকে বুঝাই যাচ্ছে এ দেশে মসলিন বস্ত্ররের কদর কতটা ছিল।
বস্ত্র শিল্পের ন্যায় এদেশে নৌশিল্পেরও একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছিল। নদী নালা খাল বিল হাওরে ভরা বাংলাদেশের নৌকাকেন্দ্রিক জীবনের পরিচয় এতে নিহিত রয়েছে। যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধাভিযান এবং প্রমোদবিহারে নৌকার প্রচলন ছিল। এ দেশে যেসব পর্যটকরা ভ্রমণে এসেছিলেন তাদের অনেকেই নৌকা ব্যবহার করেছিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা পদ্মা যমুনা মেঘনা নদী ভ্রমণ করেছিলেন এবং এদেশের মাঝি-মাল্লাদের জীবনাচার প্রত্যক্ষ করেছেন। চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ও ফেইসিন উভয়ে চীন দেশ থেকে জাহাজযোগে সমুদ্রপথে এ দেশে এসেছিলেন। পর্যটক বারবোসা ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পাটনা থেকে পদ্মা নদী হয়ে বেঙ্গল শহরে এসেছিলেন। রালফ ফিচ আগ্রা থেকে ১৮০ খানা বাণিজ্য পণ্য নিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছিল তখন তিনি এদেশীয় কিছু লুণ্ঠন বৃত্তিজীবী মাঝি-মাল্লাদের (জলদস্যু) কথা উল্লেখ করেছিলেন। পর্যটক মনুচি মীর জুমলার এবং পর্যটক টাভার্নিয়ার শায়েস্তা খানের নৌবহরের কথা বলেছেন। পর্যটক টাভার্নিয়ারের মতে, ঢাকার অধিবাসীরা নদীতীরের গ্যালী বা ছোট যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণে নিযুক্ত ছিল। পর্যটক সেবাস্টিন মানরিক ‘জেলিয়া’ নৌকার ক্ষিপ্রগামিতার কথা প্রশংসা করেছেন। এই জেলিয়ার বাণিজ্য ও যুদ্ধ উভয় উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হতো। নদ-নদী অববাহিকার এই দেশে নৌকার ব্যবহার ও এর প্রযুক্তিবিদ্যা তৎকালীন সময়ে ছিল অনেক উন্নত মানের। বিভিন্ন পর্যটকদের বর্ণনায় সেই বিষয়টি এখানে উঠে এসেছে।
এ দেশের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দিক তথা পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, আচার-রীতি, সংস্কার, ধর্ম প্রভৃতি ইত্যাদি বিষয়টি এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যা পৃথিবীর অন্য কোথাও ছিল না। সব মিলিয়ে বলা যায় বাংলার মুসলিম শাসনামলে মানুষের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে ধর্ম পালনের যে স্বাধীনতা ছিল এবং খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক পণ্যের যে ক্রয়-বিক্রয় হত তা সত্যিই অসাধারণ ছিল।