হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
শিক্ষা একটা ব্যবস্থা বা সিস্টেম, আর ব্যবস্থা মানেই হলো সামষ্টিক। ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করে, সে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয়, মানুষ থেকেও নেয়। সে নিজেকে জানার জন্য, স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টির রহস্য জানার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করে, জীবিকার প্রয়োজনেও শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রশ্ন হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব কী?
যখন মানুষ একা থাকে তখন তার জন্য বিধি-বিধানের প্রয়োজন তেমন হয় না। কিন্তু যখনই সামষ্টিকভাবে বসবাসের প্রশ্ন আসে তখনই প্রয়োজন হয় বিভিন্ন বিধিবিধানের যেন প্রত্যেকে ন্যায়পূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে। মানুষ যখন সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে লাগলো তখন একটি ভ‚খণ্ডে বিভিন্ন প্রকার সমাজের উন্মেষ ঘটল। সেই সমাজগুলোকে সামগ্রিকভাবে একটি অভিন্ন নীতি দিয়ে পরিচালনা করার জন্য বৃহত্তর সংগঠন গড়ে তোলা হলো, সেটা হচ্ছে আজকের রাষ্ট্রকাঠামো। রাষ্ট্রের একটি লক্ষ্য থাকতেই হবে অর্থাৎ রাষ্ট্র কী অর্জন করবে, কী হাসিল করবে? সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়।
জাতির শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সাধারণত দুটো ভাগ থেকে থাকে। একটি হচ্ছে রাষ্ট্র তার লক্ষ্যের প্রয়োজনে নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে। এর ব্যয় বহন রাষ্ট্রই করে। অপরটি হচ্ছে ব্যক্তি তার নিজ প্রয়োজনে শিক্ষা অর্জন করবে; অবশ্য এটিও সমষ্টিকে সহযোগিতা করার জন্যই রাষ্ট্রের লক্ষ্যের পরিপূরক হিসাবে করবে, রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীতে করবে না। যে শিক্ষায় রাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ নেই সেখানে রাষ্ট্র কোনো বিনিয়োগ করবে না, সেখানে কিছু দান-অনুদান দেবেও না, সেখান থেকে কিছু আয় গ্রহণও করবে না। কেননা রাষ্ট্র যে ব্যয় করে থাকে সে অর্থের মালিক মূলত জনগণ। জ্ঞান কোনো পণ্য নয়, এটি অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের মতো আল্লাহর একটি নেয়ামত বা দান। যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করবেন তিনি মানবতার কল্যাণার্থে সেই জ্ঞানকে ব্যবহার করবেন, জ্ঞানার্থীকে দান করবে। এখানে বৈষয়িক লেনদেন মুখ্য থাকে না।
তবে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনের অনুক‚লে প্রয়োজনীয় বিভাগের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করবে। কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের যদি ব্যাপক ডাক্তারের দরকার হয় ডাক্তার তৈরি করবে, যদি প্রকৌশলীর প্রয়োজন হয় তাহলে প্রকৌশলী তৈরি করবে, যদি জাতির সামনে যুদ্ধের পরিস্থিতি আসে তখন সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতিকে সামরিক শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলবে। এটাই স্বাভাবিক। এখন ধরুন একটি দেশের সীমান্ত শত্রুসেনারা ঘিরে আছে, যে কোনো মুহূর্তে হামলা চালিয়ে পুরো জাতিটাকে বিনাশ করে দিতে পারে, সে সময় ঐ দেশের নাগরিকদেকে সামরিক নিয়ম-কানুন ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে না তুলে অন্য কোনো দেশের ভাষা শিক্ষা দিতে থাকে আর ঘরে ঘরে ভাষাবিদ গড়ে তুলতে থাকে তখন বিষয়টা কেমন হাস্যকর ও আত্মঘাতী হবে? সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এখন সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর টার্গেটে পরিণত হয়েছে। জঙ্গিবাদসহ নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, অনেক মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে তাদেরকে পৈশাচিক নির্যাতন করে, গণহত্যা চালিয়ে, নারীদেরকে ধর্ষণ করে, শিশুদেরকে খুন করে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের দেশটিকে নিয়েও দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র চলমান আছে। জঙ্গিবাদের প্রচার ও প্রসার আমাদের দেশেও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই আসন্ন সংকট মোকাবেলায় আমাদের নাগরিকদেরকে রাষ্ট্র কী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। কোন শিক্ষা দিলে তারা দল-মত, ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা, সাম্রাজ্যবাদসহ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হবে, প্রতিবাদী হবে, দুঃসাহসী হবে সে মোতাবেক শিক্ষানীতি গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের রাষ্ট্রের কী শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা জানার জন্য সর্বাগ্রে জানতে হবে আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্যটি কী, আমাদের জাতীয় লক্ষ্য কী? দুঃখের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের জাতির লক্ষ্যটি ঠিক মতো নির্ধারণ করতে পারি নি, আমাদের জাতির কোটি কোটি সদস্যকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে হাজার হাজার উত্তর আসবে। অধিকাংশ মানুষ এই প্রশ্নটিই বুঝতে পারবেন না, অর্থাৎ জাতির কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে পারে সেটাও তারা জানেন না। যাহোক, রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করে থাকেন তারা অবশ্যই জানবেন যে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কী। পশ্চিমারা সহস্রাব্দের লক্ষ্য (Millennium Goal) নির্ধারণ করেছে বহু আগেই, আমাদের এড়ধষ কী?
একাত্তরে আমাদের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ করা, তাই তরুণ-যুবক সবাইকে যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। সে সময় আমরা একটি লক্ষ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই লক্ষ্য ছিল শোষণ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন দেশ গড়ে তোলা। সেখানে সবার রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু এ লক্ষ্য নিয়ে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো সাজানো হয় নি। সেই কাঠামোগুলো ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক যুগের কাঠামোকে অনুকরণ করে গড়ে তোলা হয়েছে মাত্র। নকল করাটাই যখন জাতির উদ্দেশ্য তখন আর ভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ করে কী হবে? ব্রিটিশদের প্রয়োজন ছিল ভারতীয়দের মধ্য থেকে সরকারি কাজকর্ম করার জন্য আজ্ঞাবাহী কেরাণি শ্রেণি তৈরি করা। তারা সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়েছিল। যে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, সেই শিক্ষা একটি স্বাধীন দেশের জন্য কখনোই উপযোগী হতে পারে না, এ জ্ঞানটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই আজ পুঁথিগত শিক্ষার সাথে বাস্তব জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা শিখি বিজ্ঞান, কাজ করি মার্কেটিং-এ, আরবির মহাপণ্ডিত ক্রীড়া দফতরে চাকরি করেন, কেমিস্ট্রির অনার্স-মাস্টার্স ব্যাংকের হিসাবরক্ষক। বহু বিষয়ের নাম না-ই বললাম যেগুলো আমাদের বাস্তব জীবনে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। এভাবে ব্রিটিশের চাপানো শিক্ষাব্যবস্থার জোয়াল বয়ে চলছি কলুর বলদের মতো।
সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে বাংলাদেশের প্রতি সাড়ে ছয় হাজার জনের বিপরীতে একজন নিবন্ধিত ডাক্তার রয়েছেন যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সুতরাং এখন স্বভাবতই সরকারের করণীয় হলো প্রচুর মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করে হাজার হাজার রেজিস্টার্ড ডাক্তার তৈরি করা, অত্যাধুনিক হাসাপাতালগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতি বসিয়ে সেগুলোর অপারেটর তৈরি করা। শিক্ষানীতি নির্ধারকদের চিন্তাপদ্ধতি এমনটাই হওয়া উচিত। আমাদের এই বাংলা ভাষাভাষী দেশে আরবি/উর্দু/ফার্সি ভাষা শিক্ষার কতটুকু প্রয়োজনীয়তা এখন আছে সেটাও তারা ভেবে দেখতে পারেন। আমাদের মাতৃভাষা আরবি নয়, সরকারি ভাষা আরবি নয়, শিক্ষার মাধ্যমও আরবি নয়। তবু জাতির অর্থ বিনিয়োগ করে সারা দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে লক্ষ লক্ষ ছাত্রকে আরবি ভাষা শেখানো হচ্ছে। সেখানে তারা কতটুকু আরবি ভাষা শিখছেন, শিক্ষার মান কতটুকু অর্থাৎ তারা আরবিতে কোনোরকমভাবে এক পৃষ্ঠাও লিখতে পারছেন কিনা বা আরবি কোনো পত্রিকা পড়ে অর্থ বুঝতে পারছেন কিনা, আরবিকে কথাবার্তা চালাতে পারছেন কিনা সেটাও মূল্যায়ন করা জরুরি। পাশাপাশি তাদের এই আরবি শিক্ষা দেশ ও জাতির কতটুকু কাজে লাগছে সেটাও ভেবে দেখা উচিত। রাষ্ট্রের নানা কাজে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষায় দোভাষীর প্রয়োজন পড়ে থাকে, মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রদের দিয়ে সে প্রয়োজনটুকু পূরণ হয় কিনা তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাতীয় প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগের জন্য আরবি ভাষা শেখানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পৃথক ভাষাশিক্ষা অনুষদ রাখা হয়েছে। মাদ্রাসায় দীর্ঘকাল পড়াশোনা করার পরও কেন এই বিকল্প ভাষাশিক্ষা অনুষদ প্রয়োজন পড়ছে তাও ভেবে দেখা দরকার।
এ কথাগুলো পড়ে অনেকে হয়তো আমাকে মাদ্রাসাবিদ্বেষী, আলেমবিদ্বেষী তকমা দিয়ে দিবেন কিন্তু আমি অনুরোধ করব আমার বক্তব্যের গভীরে প্রবেশ করার জন্য। আমি কারো বিদ্বেষী না, আমি কেবল জাতির কল্যাণে একটি সঠিক ভারসাম্যযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব পেশ করছি। শাসনব্যবস্থা যখন মুসলমানদের নিজেদের কর্মদোষে ব্রিটিশ ইংরেজদের হাতে চলে গেল তখনই কিন্তু আরবি মার খেয়ে গেল। ইংরেজি হয়ে গেল রুটি রুজির ভাষা, অভিজাত ভাষা, শাসকের ভাষা, আদালতের ভাষা। তারপর থেকে শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের নিমিত্তে সওয়াবের মাধ্যম হিসাবে আরবিকে মর্যাদাহীন অবস্থায় কোনোমতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এই যে একটি মহান ভাষা শাসনের আসন থেকে পদচ্যুত হয়ে ব্যক্তিগত ঐচ্ছিক ভাষায় পরিণত হলো, এই পদাবনতি (Demotion) দেখে কোনো মুসলিম ব্যথিত না হয়ে পারে না। আজকে একজন মানুষের নাম আরবিতে রাখা যায় না, একটি আন্দোলনের নাম আরবিতে রাখা নিয়ে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ অপদস্থ আমাদের হতে হয়েছে সেটা আমরা টের পাচ্ছি। এটা হচ্ছে ব্রিটিশদের কাছে মুসলিমদের পরাজয়ের পরিণতি।
এখানে আরেকটি কথা প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে; যারা “কোর’আন আল্লাহর নাজেল করা কেতাব, কাজেই কোর’আন শিক্ষা করলে সওয়াব হবে, ইসলামের কাজ হবে”- এমন চিন্তা থেকে মাদ্রাসাগুলোতে পড়াশুনা করছেন তারা বিষয়টা না বুঝে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের তীব্র আপত্তি করতে পারেন। তাদেরকে বলব, কোর’আন হলো আল্লাহর হুকুমসমূহের (আদেশ ও নিষেধ) সমষ্টি। তাই কোর’আনের পণ্ডিত হওয়ার আগে আমাদের কর্তব্য হবে সমগ্র জাতিটিকে একটি কথার মধ্যে নিয়ে আসা যে আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না। তারপরের কাজ হলো জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে সেই হুকুমগুলোকে সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। একটি সংবিধান বা জীবনব্যবস্থা যখন একটি দেশে কার্যকর হয় তখন সেটাকে প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রয়োজন পড়ে কিছু আইন বিশারদের, বিশেষজ্ঞের যেন মানুষ আইনের সুবিধাগুলো পেতে পারে, কোনো ক্ষেত্রে যেন ঐ বিধানে প্রদত্ত অধিকারগুলো লঙ্ঘিত না হয়। আইনের সকল ধারা উপধারার (যেগুলোকে আরবি পরিভাষায় মাসলা-মাসায়েল বা ফতোয়া বলে হয়ে থাকে) ভিত্তি হলো সংবিধান। সেই সংবিধানই যখন বলবৎ নেই তখন ধারা-উপধারার উপর ক্ষুরধার পাণ্ডিত্য অর্জন করা কি অর্থহীন নয়? কাজেই আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা হলে তখন প্রয়োজন পড়বে তাঁর হুকুমগুলো (কোর’আন) ভালোভাবে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আরবি জানা লোক তৈরি করা। কিন্তু গোটা জাতিকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য সব শাখা-প্রশাখা থেকে বিমুখ ও বঞ্চিত রেখে সেই সংবিধান যা বাস্তবজীবনে প্রতিষ্ঠিতই নেই সে সংবিধানের বিশেষজ্ঞ (আলেম, মুফতি, শায়েখ, মুফাসসির) বানানো কোনো শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হতে পারে না। আগে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হোক তারপর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, রেডিও, টেলিভিশন, ফ্যান, ফ্রিজ ইত্যাদি এবং দক্ষ ইলেকট্রিক্যাল ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে ছোটখাটো টেকনিশিয়ান পর্যন্ত প্রয়োজন পড়বে। তখন তাদের তৈরি করা, প্রশিক্ষিত করা সময়োপযোগী হবে, কাজে লাগবে। যেখানে বিদ্যুতই নেই সেখানে এসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও এতদ্সংক্রান্ত অভিজ্ঞ লোকবল দিয়ে কী লাভ? সব অনর্থক। এই সরল সত্যটি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের লক্ষ্যের সঙ্গে আমাদের বর্তমান বাস্তবের সামাজিক কাঠামোর কোনো মিল নেই। আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্যের সাথে আরবি ভাষা শিক্ষার সম্পর্ক থাকলে ভালো কথা, সেক্ষেত্রে এ বিষয়ের উপর আরো বেশি জোর দিয়ে ঘরে ঘরে আরবি ভাষার পণ্ডিত তৈরি করা উচিত। আর যদি রাষ্ট্রের লক্ষ্যের সঙ্গে আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক্বের সম্পর্ক না থাকে তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঐ দীনের ভাষা ‘আরবি’ শেখানোর জন্য হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া যুক্তিহীন নয় কি? লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিহীন শিক্ষা অর্থহীন – এ কথাটুকু বুঝতে খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন হয় না।
আমাদেরকে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া জরুরি। তা হলো, এই ৯০% মুসলমানের দেশটি কয়েক শতাব্দী আগেই পাশ্চাত্যের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। সেই ইউরোপীয় ইংরেজ খ্রিষ্টান জাতিগুলো আমাদেরকে তাদের দেশে প্রচলিত শাসনকাঠামো (আইন-আদালত, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবকিছু) এ দেশে চালু করে দিয়ে গেছে। এর আগে ইসলামের মূল্যবোধ, দণ্ডবিধি ইত্যাদি এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। ইংরেজরা আসার পরে জাতীয় জীবন থেকে ইসলামকে একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। ফলে সরকারী কাজ করার জন্য আরবি বা ফার্সি ভাষার কোনো প্রয়োজনীয়তা আর রইল না। সেই জায়গাটি করে নিল ইংরেজি। আর আরবি হয়ে গেল নিছক সুরা কেরাত, দোয়া-কালাম এক কথায় পরকালের ভাষা। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রকাঠামো আমাদেরকে শান্তি দিতে না পারলেও, আমাদের জীবনের সাথে বিশ্বাসের সাথে খাপ না খেলেও তা জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকের উপর আজও চেপে আছে। সেই পাথরটিকে অপসারণ না করে লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা বসিয়ে আমরা আরবি পণ্ডিত বের করছি। অথচ আমাদের উচিত ছিল ফেরকা-মাজহাব সংক্রান্ত সর্বপ্রকার মতভেদ ভুলে জীবনের সর্বস্ব কোরবানি দিয়ে হলেও আগে জাতির বুকে চেপে থাকা এই পাথরটি সরানো। কিন্তু আমাদের আরবিকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই মুখ্য কর্তব্য সম্পর্কে কোনো ধারণাই দেওয়া হয় না। সেখানে ইসলামকে কেবল অক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেই অক্ষরগুলোকে ব্যবহার করে আরবি শিক্ষিতরা বিভিন্নভাবে জীবিকা হাসিল করে যাচ্ছেন।
জানি না বিষয়টা পরিষ্কার করে বোঝাতে পারলাম কি না। আমাদের কথা হলো, একটি মানুষের দেহ যেমন সত্য তেমনি তার আত্মাও সত্য। তার কেবল ইহকাল সত্য নয়, তার পরকালও আছে। জীবনকে খণ্ডিতভাবে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং মানুষের এমন একটি জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন যা তার দুই জীবনকেই শান্তিপূর্ণ করবে। শিক্ষাব্যবস্থাও সেই সার্বিক জীবনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই জীবনের শিক্ষাকেও খণ্ডিত করার সুযোগ নেই। জাগতিক জীবনে মানুষ কীভাবে সফলতা ও শান্তি লাভ করবে এটা যেমন তার শিক্ষার অংশ হবে তেমনি পরকালেও সে কীভাবে জান্নাতে যাবে সেটাও তার শিক্ষার মধ্যে সমানভাবে থাকতে হবে। এজন্য তাকে তার স্রষ্টাকে জানতে হবে, স্রষ্টার হুকুম বিধান সম্পর্কে জানতে হবে, তাঁর সৃষ্টির প্রতি তার দায়িত্ব কী, কর্তব্য কী বুঝতে হবে, ভালোমন্দ-ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা যেন জাতিকে বিভক্ত না করে এবং যেন তা মানুষের বস্তুগত চাহিদা ও আত্মিক প্রয়োজন পূরণ করে সেদিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। একেক রঙের, একেক ডিজাইনের, একে লক্ষ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে কখনওই জাতির সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
ইহকাল ও পরকাল এই দুইটি জীবনকে একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ করার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা আল্লাহ যুগে যুগে বিভিন্ন ভাষাভাষী নবী-রসুলগণের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। তাতে মানুষের জাগতিক ও আত্মিক উভয়ক্ষেত্রের সমাধান রয়েছে। শেষ জীবনব্যবস্থাটি এসেছে আরবি ভাষায়, শেষ কেতাবটিও নাজেল হয়েছে আরবিতে। যিনি সেটি কার্যকর করেন অর্থাৎ শেষ নবী, তিনিও আরবিতে কথা বলতেন। কাজেই এখন পৃথিবীর যে জনগোষ্ঠীই তাদের জাতীয়, ব্যক্তিগত, সামষ্টিক জীবনে শেষ জীবনব্যবস্থাটি গ্রহণ করে নেবে তাদেরকে অবশ্যই নিজ মাতৃভাষার পাশাপাশি আরবিও জানার প্রয়োজন পড়বে। গত কয়েক শতাব্দী থেকেই আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে পাশ্চাত্যের অনুকরণ। সে মোতাবেক আমরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি, আইন আদালত, চিকিৎসা, ব্যবসাবাণিজ্য, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ইংরেজি না জেনে আমরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই করতে পারছি না। কাজেই এখন মুসলমানদের মুখ্য কর্তব্য হচ্ছে ইসলামকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। এখন ঘরে ঘরে আরবি শেখাতে গিয়ে যে পরিমাণ সময় ও শ্রম ব্যয় করা হচ্ছে তার চেয়ে বহু বেশি সময় ও শ্রম ব্যয় করা উচিত জনগণকে এটা বোঝানোর জন্য যে, আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা ছাড়া তাদের জীবনে শান্তি আসবে না। এই কথাটি আমরা বারবার বলছি যেন এর গুরুত্ব বুঝতে কারো অসুবিধা না হয়।
ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা যে জাতিকে বহুভাগে বিভক্ত করছে সেটা ইতোপূর্বে দেখানো হয়েছে। একদিকে চরম বস্তুবাদী ভোগবাদী দর্শন শিক্ষা দেওয়ার জন্য সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, অপরদিকে জাগতিক জ্ঞানশূন্য একেবারে পরকালমুখী, সওয়াবমুখী, মাসলা-মাসায়েল নির্ভর মাদ্রাসা শিক্ষা। এই দুই শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে মানসিক দ্ব›দ্ব-সংঘাত চলছে প্রতিনিয়ত। একই বাবা-মায়ের দুটো সন্তানকে দুটো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত করা হলে তারা একে অপরের সঙ্গে আর মিশতে পারে না, কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না, একরকম করে ভাবতে পারে না। তাদের চিন্তাচেতনা, সংস্কারবোধ, মূল্যবোধ হয়ে যায় সম্পূর্ণ বিপরীত। নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার এই আত্মঘাতী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার সময় কি এখনও হয় নি?