রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে সকল ধর্মের মিলনমেলা
দৈনিক দেশেরপত্র ও দৈনিক বজ্রশক্তির উদ্যোগে গত ২১ অক্টোবর ২০১৪ বিকেলে শিল্পকলা একাডেমীর চিত্রশালা মিলনায়তনে “সকল ধর্মের মর্মকথা, সবার ঊর্ধ্বে মানবতা” শীর্ষক একটি প্রাণবন্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহানা পন্নী (রুফায়দাহ)’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এম.পি। স্রষ্টা যুগে যুগে মানবজাতির শান্তির জন্য নবী-রসুল ও অবতারদের মাধ্যমে জীবন বিধান বা ধর্ম পাঠিয়েছেন। কিন্তু সেই মহামানবদের অন্তর্ধানের পরেই একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে যারা সেই মানবকল্যাণের সেই ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে সমাজে নেমে এসেছে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও সর্বপ্রকার জুলুম। অনুষ্ঠানে আলোচকগণ দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষ কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তোলা যায় এ ব্যাপারে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এম.পি বলেন, ‘পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যত নবী-রসুল এবং মহামানব এসেছেন তারা সবাই মানবতার কথা বলেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও আজীবন মানবতার কল্যাণে জন্য কাজ করে গেছেন। কিন্তু আজ সমাজের কিছু স্বার্থান্বেষী লোক ধর্মের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি করছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী। তারা মানবতাহীন কোন ধর্মের কথা বলছেন তা আমার বোধগোম্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের লোকদের উপর হামলা করে, তাদের উপাসনালয় পুড়িয়ে দেয়, তারা কোনভাবেই ধর্মের অনুসারী হতে পারে না। কোন ধর্মই মানবতার অকল্যাণের কথা বলে না।’ তিনি উপস্থিত সবাইকে নিজেদের মধ্যে বিরাজিত সকল বিভেদের প্রাচীর লুপ্ত করে সত্য, ন্যায় ও মানবতার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি জাতিতে পরিণত হওয়ার আহ্বান জানান।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রো উপাচার্য এবং ইউনিভার্সেল পিস ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, ‘মানবতার জন্য কাজ করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ধর্ম। ধর্ম থেকে এই শিক্ষা নেয়ার পরিবর্তে আজ ধর্মের কতিপয় ধারক ও বাহক দাবিদার নিজেদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করতে গিয়ে ধর্মকে বিকৃত করে ফেলেছে। তাই ধর্মীয় অঙ্গন হয়েছে কলুষিত। আজ লোভ লালসা চরম পর্যায়ে পৌঁছার কারণেই ধর্মে ধর্মে এত হানাহানি ও রক্তারক্তি চলছে। মানুষ অতিরিক্ত অর্থ আয়ের জন্য যে কোন অন্যায় কাজ করে এবং সেটাকে জায়েজ করার চেষ্টা করে।’ তিনি সকলকে ধর্মীয় গোড়ামী ও ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত ধর্মানুরাগী হওয়ার আহ্বান জানান।
ভ্যানারেবল করুণা ভিক্ষু বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীই নিজের জীবনকে ভালবাসে। আঘাত পেলে ব্যথা পায়। নিজের ব্যথাকে যেভাবে দেখা হয় অন্যের ব্যথাকেও যদি একইভাবে দেখা হতো তাহলে মানবতার কল্যাণ হতো।’ তিনি মানুষের মধ্যেকার সকল প্রকার হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একে অপরের প্রতি দয়া-মায়া-করুণা বৃদ্ধি করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
জঙ্গিবাদকে মানবতার জন্য হুমকি উল্লেখ করে দৈনিক বজ্রশক্তির প্রকাশক ও সম্পাদক এস এম সামসুল হুদা বলেন, ‘জঙ্গিবাদকে দমন করতে না পারলে মানবতার কল্যাণ সম্ভব নয়। যারা ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করে তারাই জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে, তাই জঙ্গিবাদ ধর্মব্যবসার একটি অংশ।’ তিনি বলেন, ‘শুধু শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়। কারণ এটি একটি আদর্শিক যুদ্ধ। এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর প্রস্তাবনাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলে নতুন করে কোন জঙ্গি সৃষ্টি হবে না।’
যারা মানবতার কল্যাণকে অনুসন্ধান করেন তারাই প্রকৃত সনাতন ধর্মের অনুসারী উল্লেখ করে হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক সচিব ড. মংগল চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘স্রষ্টা যেমন এক তেমনি ধর্মও এক। সে হিসেবে মানবজাতি এক জাতি। তাই সকল প্রকার হিংস্রতাকে দূর করে মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আজ সময় এসেছে ধর্মীয় বিভেদ ভুলে এমন একটি সমাজ গড়ার যেখানে ন্যায়, শান্তি ও মানবতার সমন্বয়ে সত্য যুগের প্রতিচ্ছবি থাকবে।’
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্মল রোজারিও তার বক্তব্যের শুরুতেই যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর প্রতিষ্ঠিত হেযবুত তওহীদ ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত দৈনিক দেশেরপত্র ও দৈনিক বজ্রশক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘এমামুয্যামানের অনুসারীরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেটা মূলত সরকারের কাজ। তবুও সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে এ রকম একটি মহতি কার্যক্রম পরিচালনা করা সত্যিই প্রশংসনীয়।’ তিনি হেযবুত তওহীদ আন্দোলনকে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সূতিকাগার উল্লেখ করে বলেন, ‘যুগে যুগে যারাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে মানবতার কল্যাণ করতে চেয়েছেন তারা সবাই বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু তবুও তারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে গেছেন। আজ হেযবুত তওহীদ সম্পর্কে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তাতে কোন লাভ হবে না। প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হলে সকল মিথ্যা অবশ্যই পরাভূত হবে।’
শিক্ষাবিদ শ্রী দেবন্দ্রনাথ সাহা সমাজের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আজকের বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থাই মানুষকে ভোগ-বিলাসের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। এই ভোগবাদী শিক্ষাব্যবস্থাই সমাজের সকল প্রকার অনৈতিকতার জন্য দায়ী। তাই এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে অবশ্যই মানবতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
দেশেরপত্রের উপদেষ্টা উম্মুত তিজান মাখদুমা পন্নী তার বক্তব্যে বলেন, ‘আজকের সমাজে নারীদেরকে অবমূল্যায়নের প্রধান কারণ হচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীদের কূপমণ্ডূকতা। অপরদিকে দাজ্জালের আত্মাহীন বস্তুবাদী সভ্যতা নারীদেরকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে সকল ধর্মেই নারীদেরকে যথেষ্ট সম্মান দেয়া হয়েছে।’ তিনি স্রষ্টা প্রদত্ত সম্মান ফিরে পেতে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার নারীদেরকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
প্রকৃত জ্ঞান কখনো মানুষকে অন্ধকারে নিতে পারে না উল্লেখ করে অধ্যক্ষ শ্রী শ্রী সঙ্গীতানন্দজী মহারাজ বলেন, ‘বিশ্বে আজ যে অশান্তির দাবানল জ্বলছে তার মূল কারণ হচ্ছে অজ্ঞানতা। সমাজের এক শ্রেণির জ্ঞানপাপী যখন সাধারণ মানুষদের অনুভূতিকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের অজ্ঞানতাকে পুঁজি করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে ঠিক তখনই দৈনিক দেশেরপত্র ও দৈনিক বজ্রশক্তি মানুষকে সত্যের পথ, মানবতার পথ দেখাচ্ছে। সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়।’ তিনি উপস্থিত সবাইকে অসত্য থেকে সত্যের পথে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের পথে এবং অন্ধকার থেকে আলোর পথে চলার আহ্বান জানান।
পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মই মানবতার শিক্ষা দেয় উল্লেখ করে ভিক্ষু থে ওয়ান থি বলেন, ‘কেউ যদি চাঁদে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখেন তবে পৃথিবীতে কোন ভৌগোলিক সীমা রেখা দেখা যায় না। তাই এই পৃথিবীতে হিন্দু- বৌদ্ধ- খ্রিস্টান- এবং মুসলিমদের মধ্যে কোন সীমা-রেখা থাকা উচিত নয়।’
এছাড়াও সভায় আরো বক্তব্য রাখেন মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. কামরুল হাসান, বাসাবো জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখ। সকল ধর্মের অনুসারী দর্শক-শ্রোতার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হলটিতে আরো উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, ধর্মগুরু, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যাংক কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ এবং অন্যান্য পেশাজীবীগণ। আলোচনা সভাটির মিডিয়া পার্টনার ছিল দৈনিক নিউজ এবং জাতীয় টেলিভিশন (জেটিভি-অনলাইন)। আগত অতিথিদের সকলেই যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী উপস্থাপিত প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানান ও তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
আনুষ্ঠানে আগত বক্তাগণ
অনুষ্ঠান সঞ্চালন
অনুষ্ঠানস্থলের ছবি
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের রেজিষ্ট্রেশন
অনুষ্ঠানে আগত অন্যান্য অতিথিবৃন্দ
অনুষ্ঠানে আগত মিডিয়াকর্মীবৃন্দ
প্রকাশনা স্টল
অনুষ্ঠানে হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম