মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে:
আদম (আ:) থেকে শেষ নবী (দ:) পর্যন্ত আল্লাহ যুগে যুগে তওহীদভিত্তিক দীনগুলো পাঠিয়েছেন একটা ভারসাম্য দিয়ে। প্রত্যেকটিতে একদিকে যেমন মানুষের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিধান রোয়েছে-তেমনি তার আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়াও রোয়েছে। দু’দিকেই সমান এবং একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একেবারে অচল। মানুষ যেমন দুপায়ে চলে, এক পায়ে চোলতে পারে না, দীনও একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একা চোলতে পারে না। কাজেই ইসলামেও তাসাওয়াফের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রোয়েছে। কিন্তু সেই তাসাওয়াফ কোন তাসাওয়াফ? বর্তমানে তাসাওয়াফের যে রূপ আমরা দেখে থাকি সেটা ইসলামের তাসাওয়াফ নয়। আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়া পূর্ববর্তী সমস্ত দীনেই ছিলো, বিকৃত অবস্থায় আজও আছে এবং ঐ পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরলে আজও ফল পাওয়া যায়। আজও অন্যান্য ধর্মে অতি শক্তিশালী মহা সাধকরা আছেন যাদের কেরামত অলৌকিক ক্ষমতা মোসলেম ওলী, আওলিয়াদের চেয়ে কম নয়। যে কেউ-ই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরলে তার ফল পাবে, তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অদৃশ্যের, গায়েবের অনেক খবর তার কাছে আসবে, সাধারণ মানুষ যা পারে না তেমন কাজ করার ক্ষমতা জন্মাবে, এক কথায় তাসাওয়াফের বই-কেতাবে যে সব উন্নতির কথা লেখা আছে সবই হবে। কিন্তু এগুলি শেখাতে বিশ্বনবী (দ:) আসেন নি। এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফী ও আলেম, হাকীম-আল-উম্মাহ আশরাফ আলী থানভী (রঃ) লিখেছেন- “মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেমন জাহিরী (প্রকাশ্য) শক্তি রহিয়াছে। সেইরূপে মানুষের রূহের (আত্মার) মধ্যে অনেক বাতেনী (গুপ্ত) শক্তি নিহিত আছে। শরীর চর্চার মাধ্যমে যেমন মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ শক্তিশালী হইয়া উঠে, তদ্রুপ আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা তাহাদের রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায় (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন-১ম খণ্ড ৭৬ পৃঃ)। আশরাফ আলী থানভী প্রকৃত সত্য কথা লিখেছেন এবং সে সাধনার কথা লিখেছেন যে সাধনার প্রক্রিয়া প্রতিটি ধর্মেই আছে। কিন্তু শুধু এই প্রক্রিয়া শেখাতে শেষনবী (দ:) আসেন নি। কাজেই ইসলামের প্রকৃত তাসাওয়াফ জানা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামে তাসাওয়াফ হোচ্ছে যখনই কোনো কাজ করা হবে তখন মনে রাখতে হবে এই কাজটি আল্লাহর অনুমোদিত কিনা, যদি আল্লাহ ও রসুলের অনুমোদিত হোয়ে থাকে তাহোলে সেটা করা আর যদি আল্লাহ রসুলের নিষিদ্ধ হোয়ে থাকে সেটা না করা। অর্থাৎ কাজটি করা অথবা না করা এবং সেটা হবে আল্লাহর আদেশ বা নিষেধ মোতাবেক। হুকুম দেয়ার একমাত্র অধিকারী আল্লাহ কারণ সার্বভৌমত্ব হোল আল্লাহর। রসুলের কথা বলার কারণ রসুল আল্লাহর হুকুমের বাহিরে হুকুম দিতে পারেন না (সুরা হাক্কা- ৪৬, সুরা নজম ৩-৪)। আল্লাহর হুকুমের কোনটার কি মানে সেটা হোল রসুলের জীবনীতে অর্থাৎ রসুলের কথায়। সুতরাং ইসলামের আধ্যাত্মিকতার শুরু হোল এখান থেকে। এটা কোরতে কোরতে কে কত উচ্চে উঠতে পারে, নিখুঁত (চবৎভবপঃ) হোতে পারে সেটা যার যার আমল। এটাকেই আল্লাহ বোলেছেন আমার যেকর, সকাল সন্ধ্যা তাঁর যেকর এ রত থাকা (সুরা আল আহযাব-৪১, ৪২)। অন্যভাবে বলা যায় তাকওয়া। জান্নাতে স্তর নির্ধারিত হবে এই তাকওয়া বা যেকরের উপর নির্ভর করে। বর্তমানে আধ্যাত্মিকতার নামে যে সূফিবাদ চালু আছে সেটা আল্লাহ ও রসুলের নয়। মো’মেনদের মধ্যে যিনি আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে যতো সচেতন, যতো বেশি মোত্তাকী তিনি ততো বড় আধ্যাত্মিক সাধক। গাছের নিচে, ঝোপ ঝাড়ে বোসে, গুহায়, খানকায় বোসে অধ্যাত্ম অর্জন শেষ ইসলামের অধ্যাত্ম নয়।
আজকের আধ্যাত্মিক সাধকদের মূল উদ্দেশ্য হোচ্ছে ষড় রিপুকে দমন কোরে আত্মার উন্নতি সাধন। এখানে ষড়রিপু সম্পর্কে দুইটি বিষয় উল্লেখ কোরতে চাই। প্রথম ধরুন ‘লোভ’। লোভ হোল মানুষের ষড়রিপুর একটি রিপু। লোভ মানুষকে হীন পশুতে পরিণত কোরে দিতে পারে। একজন সাধক চোখ বন্ধ কোরে, না খেয়ে, আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ (ঈড়হঃৎড়ষ) কোরতে পারে, যেমন হয়তো সে ৫০ বছরে কেবল লোভ থেকে মুক্ত হোল (যদিও আদৌ ১০০% সম্ভব কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহ রোয়েছে)। অন্যদিকে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদের ডাক যখন আসে একজন মো’মেন মোজাহেদ সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি, ঘর, সহায় সম্পত্তি, আত্মীয় পরিজন, বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান সব কিছুর মায়া ত্যাগ কোরে জেহাদে অংশগ্রহণ করে, অতঃপর সেখানে অবশেষে নিজের জানটুকু পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় কোরবান কোরে শহীদ হোয়ে যায়। তাহোলে লোভ থেকে, মোহ থেকে, ক্রোধ থেকে, ভোগের বাসনা থেকে ১০০% মুক্ত হোয়ে গেলো, কামেলিয়াত অর্জন কোরল, নিশ্চয় ঐ মোজাহেদ। একজন মোজাহেদ জেহাদ করে প্রথমত মানবজাতির কল্যাণের জন্য, আল্লাহকে বিজয়ী করার জন্য, পক্ষান্তরে সাধু, ফকীর, দরবেশ জুহুদ বা আত্মিক সাধনা করে একান্তই নিজের জন্য, স্বীয় আত্মিক পরিতৃপ্তি ও পরিশুদ্ধির জন্য। প্রশ্ন হোল বছরের পর বছর ধরে যে সাধক জুহুদ কোরে অর্থাৎ সাধনা কোরে একটা একটা কোরে রিপু জয় কোরতে চেষ্টা কোরল কিন্তু কোনটা থেকেই হয়তো পুরোপুরি মুক্ত হোতে পারলো না সেখানে একজন মোজাহেদ কিভাবে সমস্ত কিছু বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে একসঙ্গে সকল ষড়রিপু থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হোয়ে সর্বোচ্চ কামেলিয়াত হাসিল কোরল। এর সহজ উত্তর, এটা মহান আল্লাহ কোরে দিয়েছেন কারণ সে আল্লাহকে বিজয়ী করার জন্য আত্মনিয়োগ কোরেছে।
এখানে একটা কথা প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এই সুন্দর পৃথিবী আল্লাহ সৃষ্টি কোরেছেন বনী আদমের জন্য, বনী আদম আল্লাহর খেলাফত কোরবে, এখানে তারা শান্তিতে থাকবে, দুনিয়ার আলো বাতাস, খাদ্য পানীয় ইত্যাদি ভোগ কোরবে, বংশ বৃদ্ধি কোরবে, দুনিয়া চাষাবাদ কোরবে এটাই হোল স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ যদি কাম প্রবৃত্তি দমন কোরতে থাকে, পাহাড়ে জঙ্গলে বোসে সংসার না কোরে জীবন অতিবাহিত করে তাহোলে মানবজাতি একসময় বিলুপ্ত হোয়ে যাবে। আজকের তাসাওয়াফ চর্চাকারীদের প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক:
ক) যদি নারী পুরুষ বৈবাহিক জীবন যাপন না করে তাহোলে আল্লাহ নারীদের সৃষ্টি কোরলেন কেন?
খ) বনী আদমের বংশ বৃদ্ধি হবে কিভাবে, আল্লাহর খেলাফত কে কোরবে?
গ) সমস্ত মানবজাতির পক্ষে কি এসব জটিল, প্রায় অসম্ভব তরিকা অবলম্বন করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তবে তা সার্বজনীন নয়। আর যা সার্বজনীন নয় তা ইসলাম হোতে পারে না।
ঘ) তাছাড়া আল্লাহর রসুল (দ:) বোলেছেন, ‘তোমাদের উপর তোমাদের নফ্সের হক রোয়েছে। নফল সওম রাখো এবং তা থেকে বিরত থাকো। রাতের বেলা তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করো এবং ঘুমাও। আমি তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম কোরি এবং ঘুমাইও। কোনো কোনো সময় সওম রাখি। আবার কোনো কোনো সময় সওম ত্যাগও কোরি। গোশত খাই, চর্বিও খেয়ে থাকি। স্ত্রীদের নিকটও যাই। যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ শরীরকে বঞ্চিত করাকে তিনি জুলুম বা অন্যায় বোলে আখ্যায়িত কোরেছেন।
সুতরাং এই কথা পরিষ্কার যে, ইসলামের অধ্যাত্মবাদ হোল প্রত্যেক কাজে আল্লাহর উপস্থিতি গণ্য করা অর্থাৎ এটা মনে করা যে আমার এই কাজ আল্লাহ দেখছেন এবং আল্লাহর আদেশ নিষেধ অনুযায়ী সেই কাজ করা বা না করা। যে এটা যতো বেশি স্মরণে রেখে জীবন অতিবাহিত কোরল সে ততো বড় কামেল, ততো বড় মোত্তাকী। এই হোল প্রকৃত ইসলামের তাসাওয়াফের সাথে বর্তমানের বিকৃত এবং ইসলাম বিবর্জিত তাসাওয়াফের পার্থক্য।