রাকীব আল হাসান:
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সঙ্কট কোনটি এমন প্রশ্নের উত্তরে হয়ত একেক জন একেকটা বিষয় উল্লেখ করবেন। কেউ বলবেন অনৈক্য, নিজেদের মধ্যে হানাহানি, কেউ বলবেন অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার আবার কেউ হয়ত বলবেন অন্যান্য জাতির দ্বারা নির্যাতিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হবার কথা। আবার মুসলমানদের সঙ্কট নিয়ে কয়জন চিন্তা করেন সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
যখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর বৌদ্ধরা অত্যাচার চালায়, ফিলিস্তিনি মুসলিমদের উপর ইহুদিরা বর্বরোচিত হামলা চালায়, কাশ্মিরের মুসলিমদের উপর হিন্দুরা পাশবিক নির্যাতন চালায়, বসনিয়ার মুসলিমদের উপর খ্রিষ্টানরা নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়ন চালায় তখন তার প্রতিবাদে জুমার দিনে এখানে ওখানে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়, নিজেদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘাত হয়, নিজেদের দেশের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করা হয়, মনের জ্বালা মেটাতে বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয়, ভাঙচুর করা হয়। এটা সত্য যে কোনো নিপীড়িত মানুষের নিপীড়ন দেখে বিক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তা না করে কেবল প্রতিবাদ করে কোনো লাভ আজ পর্যন্ত হয় নি। আমাদের এই অনর্থক প্রতিবাদে কোনো জনগোষ্ঠীই আজ পর্যন্ত রক্ষা পায় নি। তাছাড়া এটাও উপলব্ধির বিষয় যে, মুসলিমদের এই পরিণতির জন্য সবার আগে যা দায়ী তা হলো আদর্শচ্যুতি, লক্ষ্যচ্যুতি। যার পরিণামে তারা নিজেদের মধ্যেই আজ অনৈক্য, দ্বন্দ্ব, সংঘাতে লিপ্ত। মহানবী (সা.) বলেছেন ইহুদিরা ৭২ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে আর আমার উম্মাহ ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হবে। আজ আমাদের ঠিক তাই হয়েছে। আমরা বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদের শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছি।
কেন আমাদের এই পরিণতি হলো?
মহানবী মোহাম্মদ (সা.) যখন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার সমাজে আসলেন তখন সেই সমাজের মানুষগুলো অনৈক্য, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতে নিমজ্জিত ছিল। দুর্বলের কোনো অধিকার ছিল না, মানুষের উপর জোরপূর্বক দাসত্ব চাপিয়ে দেওয়া হতো, দরিদ্রের উপর ছিল অর্থনীতিক চূড়ান্ত অবিচার। সেখানে নারীর কোনো সম্মান ছিল না, কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। এক কথায় সকল দিক দিয়ে তারা ছিল চরম অন্যায়, অবিচার আর অশান্তির মধ্যে নিমজ্জিত। সেই সমাজের মানুষকে রসুলাল্লাহ (সা.) সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ একটা জাতিতে পরিণত করলেন। সত্য, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য, নিরাপত্তা, ন্যায্য অধিকার এক কথায় চ‚ড়ান্ত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো সেই সমাজে। সেই জাতি গঠন, সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা, সেই সভ্যতা নির্মাণের ভিত্তি ছিল কলেমা- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই, মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল”। আল্লাহর হুকুম মানে হলো- চূড়ান্ত ন্যায়, অর্থাৎ ন্যায়ের ভিত্তিতে রসুল (সা.) উম্মতে মোহাম্মদী নামক একটি জাতি গঠন করলেন যারা রসুলাল্লাহ (সা.) এর ইন্তেকালের পর আরবভ‚মি থেকে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়লেন সেই ন্যায়ভিত্তিক, কলেমা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। অর্ধ-পৃথিবীতে সত্য, ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। মুসলিম জাতি হলো শ্রেষ্ঠ জাতি, শিক্ষকের জাতি, সবচেয়ে উন্নত জাতি ও তখনকার সময়ের সর্বাধুনিক সভ্যতার নির্মাতা। অন্যান্য সকল জাতি তাদের দিকে সভয় সম্ভ্রমে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো- এ জাতির পরবর্তী সুলতানগণ ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত হলো। তারা আর ইসলামের খলিফা থাকল না, তারা হয়ে গেল রাজা-বাদশাহ, কিসরা, কায়সার। ক্ষমতার লোভ তাদের পেয়ে বসল। তারা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল, ন্যায়ের দণ্ড ছেড়ে স্বার্থের দণ্ড ধারণ করল। ন্যায়ের দণ্ড ছাড়ার অর্থই হলো- কলেমা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া। ভিত্তিই যখন নষ্ট হয়ে গেল তখন তাদের মধ্যে নানা রকম অনৈক্য, বিভেদ জন্ম নিল। নিজেদের মধ্যে শুরু হলো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সময়ের ব্যবধানে এক মুসলিম উম্মাহ ভেঙ্গে শিয়া-সুন্নী, শাফেয়ী, মালেকী, হানাফী, হাম্বলী, মুজাদ্দেদিয়া, নক্সবন্দীয়, এক কথায় বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এটা স্বাভাবিক যে, বিভক্তি মানেই হলো দুর্বল হয়ে যাওয়া। এই জাতিও নিজেরা নিজেরা দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি করতে করতে দুর্বল হয়ে গেল। এক সময় এই সুযোগটাই নিল অন্য জাতিগুলো। আস্তে আস্তে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিই এই মুসলিম জাতির উপর নানামুখী নির্যাতন, অত্যাচার করার সুযোগ ও সাহস পেল। আজকে পৃথিবীব্যাপী মুসলিমদের যে করুণ পরিণতি তার মূল কারণ এটাই। বর্তমানে মুসলিম জাতির সবচেয়ে বড় সঙ্কটও নিজেদের মধ্যে নানামুখী অনৈক্য, বিভেদ, হানাহানি এবং এর ফলে পৃথিবীব্যাপী এই জাতির উপর চলছে নির্যাতন, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, অপমান।
এখন করণীয়:
আমরা ইতিহাস থেকে বুঝতে পারলাম বর্তমানের এই সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে প্রধানত আমরা অর্থাৎ মুসলিমরা নিজেরাই দায়ী। কাজেই এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদেরকে এখন ভাবতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে দুর্বলের উপর অন্যায়কারীরা অত্যাচার চালাবেই, আর একটা জাতি দুর্বল হয় অনৈক্য থেকে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করো। তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ো না, তাহলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দূর হয়ে যাবে (সুরা আনফাল- ৪৬)।
আল্লাহ যে কাজটি করতে নিষেধ করেছেন আমরা ঠিক সেই কাজটিই করেছি। ফলাফলও তেমনটাই হয়েছে যেমনটা আল্লাহ হুঁশিয়ার করেছেন। এক সময়কার শ্রেষ্ঠ জাতি আজ গোলাম জাতিতে পর্যবসিত হয়েছে। অথচ জনশক্তি, খনিজ সম্পদ, বিরাট ভূ-খণ্ড, অসংখ্য সমুদ্র বন্দর, সমুদ্র পথ ইত্যাদি সম্পদ, সেই সাথে আলেম-ওলামা, লেখক-সাহিত্যিক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি কোনো কিছুর অভাব নেই এই মুসলিম জাতির। এই জাতির মধ্যে ঐক্য না থাকার কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। এখন মুসলিম জাতির সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়গুলোকে পেছনে রেখে আগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। রসুলাল্লাহ (সা.) যেমন কলেমা তওহীদের উপর অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমের উপর ভিত্তি করে একটি জাতি গঠন করলেন এবং ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ গড়ে তুললেন সেভাবে এক আল্লাহর হুকুমের উপর মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিজেদের মধ্যে অনৈক্য জিঁইয়ে রেখে মুসলিম বিশ্বের বর্তমান বহুমুখী সংকট ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার কোনো সুযোগ নেই।