মোহাম্মদ আসাদ আলী
১. খন্দক যুদ্ধ
পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাস। জাজিরাতুল আরবের একটি পল্লী জনপদ মদীনা। সেই মদীনার ঘরে ঘরে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। কারণ স্মরণকালের ভয়াবহতম এক অবরোধের মুখে তাদের জনজীবন আজ বিপর্যস্ত! সারা আরব থেকে কাফের-মোশরেকরা সমবেত হয়েছে মদীনার উপকণ্ঠে। বাজিয়ে চলেছে যুদ্ধের দামামা! এর বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বলতে এতটুকুই যে, মদীনাকে ঘিরে প্রশস্ত পরিখা খনন করা হয়েছে এবং সেই পরিখা পাহারা দিচ্ছে তিনি হাজার যোদ্ধা।
ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা চলছে মো’মেনদের। তাদের ঈমান বলে- আল্লাহর রসুল আছেন আমাদের সঙ্গে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। বাস্তবতা বলে, দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী পরিখার ওপারে প্রস্তুত- আরবের প্রসিদ্ধ যোদ্ধারা সেখানে তলোয়ারে শান দিচ্ছে। কোনোভাবে পরিখা অতিক্রম করতে পারলেই আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এক নিমেষেই মদীনায় বয়ে যাবে রক্তগঙ্গা। আল্লাহর রসুলের সারা জীবনের সাধনা হয়ে যাবে ব্যর্থ! জীবনপণ সংগ্রাম করে যেই মদীনাকে তিনি গড়ে তুললেন, যেই মদীনায় ইসলামের ফুটন্ত গোলাপ সবে সুবাস ছড়াতে শুরু করল- সেই মদীনার সাথেই কবর হবে সত্য ও ন্যায়ের। এমনই জীবন-মরণ সঙ্কটের মুখে সবার একটাই আশা, হয়ত কোনো উপায় বের করবেন আল্লাহর রসুল। আল্লাহ কোনো বিশেষ সাহায্য পাঠাবেন তাঁর প্রিয় বন্ধুর সৌজন্যে।
ওদিকে আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে আবু সুফিয়ান, মক্কার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তার হৃদয়ে আজ প্রতিশোধের আগুন, চোখে বিজয়ের দীপ্তি! সারা আরবের সৈন্যরা একত্রিত হয়েছে মদীনার বিরুদ্ধে, এই দৃশ্য দেখে তার পুলকিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবু সুফিয়ান ভালোভাবেই জানে এত বিশাল বাহিনীকে মোকাবেলা করার সাধ্য মোহাম্মদের (সা.) নেই। অচীরেই তার অনুসারীদের উপর দশ হাজার সৈন্যের যৌথবাহিনী আছড়ে পড়বে সাক্ষাৎ গজব হয়ে। তরল শোণিতধারায় সিক্ত হবে মদীনার পথঘাট এবং একমাত্র তখনই মুসলমানরা প্রমাণ পাবে- কোরাইশ গোত্রপতিদের বিরুদ্ধাচারণ করার পরিণতি কত শোচনীয় হয়!
পরিখাবেষ্টিত মদীনাজুড়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। কতদিন অবরুদ্ধ থাকতে হবে কেউ জানে না। খাবার ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। অস্ত্রশস্ত্রও আছে নামমাত্র। অবরোধের একটি দিন যেন একটি বছর, শেষ হতেই চায় না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দু’দণ্ড বিশ্রাম নেওয়া? তারও সুযোগ নেই। গভীর রাতে ঘুম ভাঙে তীরের শব্দে, অশ্বের হ্রেষাধ্বনিতে! এই বুঝি পরিখা পেরিয়ে এলো শত্রুরা! টেনশনে নির্ঘুম রাত কাটে মুসলিম শিবিরে।
মুনাফিকরাও কথা বলার মওকা পেয়ে গেছে। তারা বলে ‘মুহাম্মদ (সা.) আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, আমরা পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হয়ে যাব। অথচ আজ আমরা নিরাপদে পায়খানায় যেতেও পারছি না।’ তাদের এই কথার প্রত্যুত্তরে মো’মেনরা নিশ্চুপ! কারণ এর জবাব দেওয়ার সময় আসেনি। আগে সঙ্কটের মেঘ কাটুক- দিনের আলো উদ্ভাসিত হোক। আল্লাহর সাহায্য যখন আসবে তখন এই মুনাফিকদের মুখ কালিমালিপ্ত হবে। কিন্তু অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস! মুনাফিকদের প্রশ্রয় দিতেই যেন সঙ্কটের মেঘ আরও ঘনীভূত হতে লাগল। দেখা গেল মদীনার ভেতরেও শুরু হয়েছে গোলযোগ। কোনো কোনো গোত্রে নিজেরাই গণ্ডগোল শুরু করল। একপক্ষ মনে করে আমরা বোধহয় মোহাম্মদকে (সা.) আশ্রয় দিয়ে ভুলই করে ফেললাম, আরেকপক্ষ বলে- ‘কখনই নয়। তিনি আল্লাহ রসুল, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ভয় কিসের?’
২. বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত
সব মিলিয়ে এই যখন মদীনার সঙ্কটাবস্থা, চারিদিকে হিংস্র জন্তুর কোলাহল প্রতি মুহূর্তে মদীনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- ‘মদীনা তুমি আজ চরম নিঃসঙ্গ, তোমার কেউ নেই, তুমি একপাল নেকড়ের সম্মুখে একটি হরিণছানার ন্যায় অসহায়’- ঠিক সেই মুহূর্তে একটি খবর আল্লাহর রসুলকে আরও বিচলিত করে তুলল। তিনি জানতে পারলেন বনি কুরাইজা গোত্র নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অস্ত্রধারণ করছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
সেই বিশ্বাসঘাতক বনি কোরাইজা গোত্র, যারা এর আগেও একবার নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল! আল্লাহর রসুল সেদিনই তাদেরকে বিতাড়িত করতে পারতেন, শাস্তিস্বরূপ হত্যাও করতে পারতেন। কিন্তু দয়া পরবশ হয়ে তিনি ক্ষমার ঘোষণা দেন। চুক্তি নবায়ন করেন। কে জানত বিশ্বাসঘাতকতা তাদের রক্তে মিশে আছে?
খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে আল্লাহর রসুল দুই সাহাবীকে বনি কুরাইজায় পাঠালেন। তারা বনি কুরাইজার দূর্গে গিয়ে দেখলেন – খবর সত্য। পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ। যতটা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ। ইহুদি গোত্রটিকে চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তারা খেঁকিয়ে ওঠে- ‘কে মোহাম্মদ? কীসের চুক্তি? আমরা মোহাম্মদ নামের কাউকে চিনি না।’ সাহাবীদ্বয় ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসছেন আর ভাবছেন, এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর কি সবাইকে জানানো ঠিক হবে? এই খবর প্রচারিত হলে মুসলিম বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে যাবে! তারা সম্মুখের শত্রু নিয়েই বিচলিত- পেছনেও যে বিষাক্ত নাগিন নিশ্বাস ফেলছে সেই খবর বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম বাহিনী আর যুদ্ধ করার মত মানসিক দৃঢ়তা পাবে না। সুতরাং বুদ্ধি খাটিয়ে তারা সাংকেতিক ভাষায় রসুলকে বুঝিয়ে দিলেন পরিস্থিতি বড়ই সঙ্কটজনক। খবর পুরোটাই সত্য। . . . (চলবে)