মোহাম্মদ আসাদ আলী:
স্বাস্বাধীনতা পরবর্তী গত ৪২ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মুখনিঃসৃত সর্বাধিক শব্দ সম্ভবত গণতন্ত্র। রাজনৈতিক জনসভার বক্তৃতায়, মিটিং-মিছিলে, সেমিনার বা টকশোতে গণতন্ত্রের পক্ষে কথার কোন শেষ নেই। অন্যদিকে গণতন্ত্রের জন্য পশ্চিমা সভ্যতার অনুগত অন্যান্য মিডিয়াগুলোর দৌড়-ঝাঁপও কম নয়। গণতন্ত্র আমরা পেয়েছি মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরে। তারা দুইশ’ বছরের শাসন-শোষণ চালিয়ে যখন উপমহাদেশ ছেড়ে আমাদেরকে আপাত স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেল, তখন চাপিয়ে দিয়ে গেল গণতন্ত্র নামের এই সোনার হরিণ। আজ ব্রিটিশপরবর্তী অর্ধশত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এসেও আমরা সেই সোনার হরিণকে ধরতে পারি নি। বহুরূপী গণতন্ত্র প্রতিনিয়তই রূপ পরিবর্তন করে চলেছে তার আপন মহিমায়! আর এই রূপ পরিবর্তনের ফল জাতি ৪২ বছর যাবৎ হাড়ে হাড়ে ভোগ করে যাচ্ছে। তাই গণতন্ত্রের ৪২ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে এর কিছু সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
গণতন্ত্র নামক শাসনব্যবস্থাটির সুবিধার কথা বলা হলেও আসলে এর সুবিধাজনক কোন দিক নেই। সুবিধা বলে যা আছে তার সবই ফাঁকা বুলিতে সীমাবদ্ধ। বাস্তবতার সাথে এর কোন ছিটেফোঁটাও মিল নেই। বলা হয়ে থাকে- গণতন্ত্র এমন একটি সামষ্টিক পদ্ধতি যেখানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকে যারা জনগণের বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অভিমত প্রকাশের অধিকারকে সমর্থন করে। অর্থাৎ গণতন্ত্র হলো একটি দেশের সর্বসাধারণের দ্বারা পরিচালিত সরকার পদ্ধতি। এই ব্যবস্থার অধীনে শাসকগণ নির্বাচিত হয়ে জনগণের ইচ্ছা অনুসারে দেশ শাসন করেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি তা কুলীনতন্ত্র এবং যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে তা গণতন্ত্র।’ আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন “গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার, এবং জনগণের জন্য গঠিত সরকার।” গণতন্ত্রের এই আদর্শগত বুলিই পৃথিবীব্যাপী এর বিস্তারে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। কিন্তু বাস্তবতার দিকে তাকালে আমরা এর বাস্তবায়ন কোনকালেই দেখতে পাই না।
প্রাচ্যের শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে আমাদের মন-মগজ এমনভাবে ধোলাই হয়ে গেছে যে, গণতন্ত্রের ক্ষতিকর দিকগুলো আমরা কখনোই ভাবি না। মনোলোভা এবং আকর্ষণীয় কথা-বার্তায় আমরা সর্বদা বিমুগ্ধ। কোথাও কাউকে এর সমালোচনা করতে দেখা যায় না। কখনওবা যদি সমালোচনা করার চেষ্টা করাও হয়, দেখা যায় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, গণতন্ত্র তার শিশুকাল পেরোয়নি ইত্যাদি বলে তাকে পার পাইয়ে দেওয়া হয়। আসলে আমরা প্রাচ্যের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের চাকচিক্য দেখে হীনমন্যতায় ভুগছি। তাই সাহস করে এর বিপক্ষে কোনকিছু বলতে সাহস পাই না। কিন্তু একথা মনে রাখছি না যে, পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থায় পৌঁছেছে। তাছাড়া তারা দীর্ঘ দিন প্রায় সারা বিশ্বটাকে তাদের উপনিবেশ বানিয়ে রেখে শাসন-শোষণের মাধ্যমে সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের দেশকে উন্নত করেছে। তাদের সে উন্নতি গণতন্ত্রের উন্নতি নয়। অথচ তাদের সৃষ্ট সে গণতন্ত্রকে আমরা আমাদের তৃতীয় বিশ্বের এই দেশগুলোতে হুবহু প্রতিষ্ঠা করতে বৃথা প্রচেষ্টা করছি। যার কারণে ফলাফল হচ্ছে উল্টো। তাছাড়া আগেই বলেছি, পশ্চিমা সভ্যতার প্রচার মাধ্যমের প্রচারণা ও চাকচিক্যতায় আমরা মুগ্ধ। কিন্তু তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অপরাধ অর্থাৎ খুনো-খুনি, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি সামাজিক অপরাধের পরিসংখ্যান দেখলে আমরা দেখতে পাব যে পাশ্চাত্যের সমাজকে যতটা সুখী মনে করা হয় মোটেও তারা ততটা সুখী নয়। প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মাঝে রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য।
পাশ্চাত্যসৃষ্ট এ গণতন্ত্রকে প্রতিপালন করতে গিয়ে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো:
ক) জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি:
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বহুদল ও বহুমতের নামে জাতি বিনাশী অনৈক্যর জন্ম দেয়া। গণতান্ত্রিক ভাষায় বলা হয়ে থাকে- যে দেশে যত বেশি রাজনৈতিক দল থাকে সেই দেশের গণতন্ত্র তত বেশি বিকশিত ও পরিপক্ক। বাস্তবতায় বহুদল ও বহুমতের পরিণাম হচ্ছে অনৈক্য, বিভেদ ও অশান্তি। একটি জাতির উন্নতির প্রথম সূত্রই হলো ঐক্য। যে জাতিতে যত বেশি মত-পথের মানুষ থাকবে তা ততই জাতীয় উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভিত্তিগতভাবেই গণতন্ত্র অনৈক্যের সকল উপাদান বিলিয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তার বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনসমূহকেও বৈধতা প্রদান করে। এর সূত্র ধরে দলের ভেতর সৃষ্টি হয় আরো উপদলের। স্বাভাবিক ফলাফল দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল, হানাহানি, ক্ষমতা ও পদ দখলের লড়াই। অর্থাৎ গণতন্ত্র একই মত ও পথে বিশ্বাসীদেরকেও এক সূত্রে আবদ্ধ হতে দিতে চায় না।
খ) বিরোধী মতের বৈধতাদানকারী গণতন্ত্র:
গণতান্ত্রিক সিস্টেম রাষ্ট্রপরিচালনায় বিরোধী দলের অস্তিত্বকে অত্যাবশ্যক বলে জ্ঞান করে থাকেন প্রায় সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং এতদসংক্রান্ত গবেষকগণ। তাদের মতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দল দুটি স্বতন্ত্র উপাদান। তারা একটি অপরটির পরিপূরক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, তারা সরকার গঠন করে। যারা কম আসন পায়, তারা থাকে বিরোধী দলে। এই দু’য়ের স্বতন্ত্র ভূমিকা শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে। এ কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। সরকারের অযৌক্তিক কাজে বিরোধী দল বাধা প্রদান করে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণকে বাধাগ্রস্ত করে। কিন্তু বাস্তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায় সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র।
আমাদের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, শুধুমাত্র বিরোধিতা করার খাতিরেই বিরোধী দল যতদিন বিরোধী দলে থাকে ততদিন সরকারের ভালো-মন্দ সকল কর্মকাণ্ডের একচেটিয়া বিরোধিতা করে যায়। এমনও দেখা যায় বাজেট ঘোষণার আগেই বিরোধীদল বাজেটের বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণ করে ফেলে, এমনকি বিকল্প বাজেটও তৈরি করে। সরকারের এমন একটি সিদ্ধান্তও থাকে না যার বাস্তবায়নের পথে বিরোধী দল বিরোধিতা করে না। ফলে সরকারি দল আর বিরোধী দলের মাঝে সব সময়ই থাকে দা-কুমড়া সম্পর্ক। সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও- পোড়াও, ভাঙচ ুর ইত্যাদি করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে বিরোধী দল। অপরদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও বিরোধীদলের উপর চলে দমন-পীড়নের স্টিম রোলার। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে-সরকারি দল আর বিরোধী দলের লড়াইয়ে জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে।
ঘ) গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন:
গণতন্ত্র ক্ষমতাসীন সরকারের অনৈতিক ও অযৌক্তিক আচরণের প্রতিবাদে বিরোধী দলকে বিভিন্ন কর্মসূচীর অধিকার প্রদান করে। এসব কর্মকাণ্ড প্রায় সময়ই দেখা যায় সহিংসতার রূপ নেয়। বিরোধীদল কতটা শক্তিশালী তা বিচার করা হয় সহিংসতায় তারা কতটা সিদ্ধহস্ত তার উপর। এই অধিকার বলে তারা বছরের বিশেষ একটা সময় ধরে হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও- পোড়াও, বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করায়।
ঙ) ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন:
সরকারি দল ও বিরোধী দলের এই সংঘাত ও মানি না মানবো না এসব দাবি এবং বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে, সহিংসতা ঘটিয়ে প্রায়ই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামায়। বিরোধী দল সরকারে গেলে সরকারি দল আবার বিরোধী দলে গিয়ে ঐ একই কাজ করে। উভয়ের এই লড়াইয়ে কোন সরকারই নিশ্চিন্তে দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে পারে না। আবার উভয় পক্ষের হানাহানিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সামরিক বাহিনী বাধ্য হয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এভাবে ক্ষমতার কামড়া-কামড়ির সুযোগে বিশ্ব মোড়লগণ তাদের আধিপত্য বিস্তার করে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়।
চ. গণতন্ত্রের সার্বিক ফলাফল:
আধুনিক পৃথিবীতে একদিকে চলছে গণতন্ত্রের জয়-জয়কার, আর অপরদিকে চলছে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, গুম-খুনের মহোৎসব। পরিসংখ্যান খুললেই দেখা যাবে- গণতন্ত্র পালনকারীরা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অন্যায়-অবিচার, অশান্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের বাহারী শ্লোগান অনুযায়ী এবং গণতন্ত্র মান্যকারী দেশগুলোর তো এর উল্টো ফলাফল হবার কথা ছিল! কিন্তু চিত্র উল্টো কেন? কারণ, গণতন্ত্র ভিত্তিগতভাবেই দুর্বল, ফাঁপা ও স্ববিরোধী নীতিতে পূর্ণ বলে কাক্সিক্ষত শান্তি দিতে ব্যর্থ। তবুও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করে মুক্তির আশায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বৃথা রক্ত দিয়ে চলেছে। শুধু গণতন্ত্রই নয়, এই একই রকম ফল সবক’টি মানবসৃষ্ট জীবনব্যবস্থাতেই। এক সময় মানুষ রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য জীবন দিয়ে গণতন্ত্র এনেছে আর এখন তাতেও সন্তুষ্টি অর্জন করতে না পেরে ভিন্ন পথ খুঁজছে। কারণ গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ফুটো দিন দিন বড় হচ্ছে। এক সময় হয়তো অন্যান্য জীবনব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে সংগ্রাম করেছে আবারও হয়তো তাদেরকে গণতন্ত্র থেকে বের হওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।