রিয়াদুল হাসান
সালাতের উদ্দেশ্য:
আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত দীন (জীবন-ব্যবস্থা) অবলুপ্ত কোরে দিয়ে এই সঠিক দিক নির্দেশনা (তওহীদ, সেরাতাল মোস্তাকিম) ও এই সত্যদীন (জীবন-ব্যবস্থা, শরিয়াহ) প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিলেন- এই সত্য আমরা পাচ্ছি প্রত্যক্ষ, সরাসরি কোর’আনে তিনটি আয়াত থেকে (কোর’আন- সুরা তওবা ৩৩, ফাতাহ ২৮, সফ ৯), এবং পরোক্ষভাবে সমস্ত কোর’আনে শত শত আয়াতে। প্রশ্নটি হোচ্ছে- আল্লাহ শেষ নবীকে এই বিশাল দায়িত্ব দিলেন কিন্তু কেমন কোরে, কোন নীতিতে তিনি এ কাজ কোরবেন তা কি আল্লাহ তাঁকে বোলে দেবেন না? আল্লাহ সোবহান, অর্থাৎ যার অণু পরিমাণও খুঁত, ত্র“টি, অক্ষমতা, অসম্পূর্ণতা বা চ্যুতি নেই। কাজেই তাঁর রসুলকে আল্লাহ এক বিরাট, বিশাল দায়িত্ব দিলেন কিন্তু কেমন কোরে, কোন্ প্রক্রিয়ায় তিনি তা করবেন তা বলে দেবেন না, তা হতেই পারে না। কাজেই আল্লাহ তাঁর নবীকে ঐ দায়িত্বের সঙ্গে ঐ কাজ করার নীতি ও প্রক্রিয়া অর্থাৎ তরিকাও বলে দিলেন। সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন প্রতিষ্ঠার নীতি হিসাবে আল্লাহ তাঁর রসুলকে দিলেন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম; এবং ঐ নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি পাঁচদফার কর্মসূচি। ঐ পাঁচ দফা হলো- ১) ঐক্য, ২) শৃঙ্খলা, ৩) আনুগত্য, ৪) হিজরত, ৫) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। (হাদিস- তিরমিযী, মুসনাদে আহমেদ, আহমদ, বাব-উল-ইমারাত)। পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যা ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে আল্লাহর দেয়া সঠিক দিক-নির্দেশনা ও সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে যে নীতি ও তরিকা (প্রক্রিয়া, কর্মসূচি) দিলেন সেটা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও কঠিন সংগ্রাম।
এর প্রমাণ আল্লাহর কোর’আন এবং তাঁর রসুলের জীবনী, কথা ও কাজ। আল্লাহ তাঁর কোর’আনে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে মুমিন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ফরদে আইন করে দিয়েছেন সুরা বাকারার ২১৬ ও ২৪৪ নং আয়াতে, আনফালের ৩৯ নং ও আরও বহু আয়াতে। শুধু তাই নয় মুমিন হবার সংজ্ঞার মধ্যেই তিনি সংগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- শুধু তারাই সত্যনিষ্ঠ মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমান এনেছে এবং তারপর আর কোনো দ্বিধা-সন্দেহ করে নি এবং প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেছে (কোর’আন- সুরা হুজরাত ১৫)।
দীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর রসুলকে যে পাঁচ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন তার প্রথম চার দফা অর্থাৎ ১) ঐক্য, ২) শৃঙ্খলা, ৩) আনুগত্য, আদেশ প্রতিপালন, ৪) হিজরত এই চারটি হলো সংগ্রাম করার প্রস্তুতি এবং পঞ্চম দফা হচ্ছে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
তাহলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক এই দীনকে সমস্ত পৃথিবীতে কার্যকর করে মানব জাতির জীবন থেকে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও রক্তপাত দূর করে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আল্লাহ তাঁর রসুলকে পৃথিবীতে পাঠালেন এবং ঐ কাজ করার নীতি হিসাবে নির্ধারণ করে দিলেন সংগ্রাম ও ৫ দফার কর্মসূচি। তাঁর রসুল ঐ নীতি ও কর্মসূচির অনুসরণ করে গড়ে তুললেন এক দুর্দম, দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় সামরিক বাহিনী যার নাম হলো উম্মতে মোহাম্মদী। এই উপলব্ধি (আকিদা) থেকে আজ আমরা লক্ষ-কোটি মাইল দূরে অবস্থান নিয়েছি।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে সংগ্রাম করে পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া দিক নির্দেশনা ও সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠার মতো বিশাল ও কঠিন কাজের জন্য আল্লাহর হুকুমে তাঁর রসুল যে বাহিনী গঠন করলেন, অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী, তার চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য কী ব্যবস্থা করা হলো? এটা হতে পারে না যে আল্লাহ তাঁর রসুলকে উম্মাহ গঠন করতে আদেশ দিলেন, সংগ্রামকে ফরদে আইন করে দিলেন, কিন্তু তাদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দিলেন না। যে কথাটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে কোনো কাজ করতে গেলেই সেই কাজের প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক, আল্লাহ সোবহানুতায়ালা কি এই কথাটা বোঝেন নি? তাহলে এই দীনে সেই প্রশিক্ষণ কোথায়?
সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ হলো- সালাহ
প্রত্যেক সুশৃঙ্খল ও সংগ্রামী জাতিরই সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। যেমন সেনাবাহিনীর দৈনিক প্যারেড, কুচকাওয়াজ, অস্ত্রের ব্যবহারের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ওগুলো ছাড়া কোনো সামরিক বাহিনী নেই। তাহলে আল্লাহর রসুল যে সামরিক বাহিনী গঠন করলেন, যে বাহিনী সংগ্রামের মাধ্যমে ৯ বছরের মধ্যে সমস্ত আরব উপদ্বীপ জয় করল, তারপর মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে তৎকালীন পৃথিবীর দুই বিশ্বশক্তির সুশিক্ষিত বিশাল সামরিক বাহিনীগুলিকে যুদ্ধে পরাজিত করে অর্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করল তারা এ সব কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়াই করল? এ হতে পারে? অবশ্যই নয়। একথা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে, যে দীনে, জীবন-ব্যবস্থায় ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ফরদে আইন, অবশ্য করণীয় করে দেয়া হয়েছে (কোর’আন- সুরা বাকারা ২১৬) সে দীনে প্রশিক্ষণকেও অবশ্য করণীয়, ফরদে আইন করে দেয়া হবে। আল্লাহ ভুল করেন নি, তিনি সোবহান, তিনি সামান্যতম ভুলও করতে পারেন না, আর এতবড় ভুল তো কথাই নেই। তাহলে সে প্রশিক্ষণ কোথায়?
আল্লাহর রচনা করা এই অমূল্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে যে চরিত্র প্রয়োজন, যে চরিত্র ছাড়া এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, সেই চরিত্র অর্জন করার প্রধান উপায় হচ্ছে সঠিকভাবে সালাহ (নামাজ) কায়েম করা। সালাহ এবং এই কর্মসূচির মধ্যে একটি অভূতপূর্ব মিল আছে। কর্মসূচির প্রথম দফা হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সালাহরও প্রথম কাজ হলো সালাহর জন্য সকলে একত্রিত হওয়া। কর্মসূচির দ্বিতীয় দফা হলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়া (উরংপরঢ়ষরহবফ), সালাতের জন্য একত্রিত হওয়ার পর দ্বিতীয় কাজটি হলো কতগুলি নিয়ম অনুসারে দাঁড়ানো অর্থাৎ নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা। এই নিয়মগুলি হচ্ছে, লাইন করে দাঁড়াতে হবে এবং লাইনটি হতে হবে ধনুকের ছিলার মতো সোজা, (ধনুকের ছিলার চেয়ে বেশি সোজা আর কোনো জিনিস পৃথিবীতে নেই), শরীর হতে হবে রডের মতো সোজা এবং শক্ত, দৃষ্টি থাকবে সম্মুখে নিবদ্ধ, হাত হতে হবে মুষ্টিবদ্ধ, মন হতে হবে ইমামের হুকুম শোনার সঙ্গে সঙ্গে পালন করার জন্য তীক্ষè সচেতন ইত্যাদি অনেক কিছু। কর্মসূচির তৃতীয়টি হলো এতায়াহ। সালাতেও তৃতীয় কাজ হচ্ছে এতায়াহ অর্থাৎ ঐরকম শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সতর্ক হওয়ার পর ইমামের তাকবীর বা হুকুমের আনুগত্য করা। এই আনুগত্যের মধ্যে কোথাও বিন্দুমাত্র শিথিলতা থাকবে না, কোনো প্রশ্ন থাকবে না। ইমাম যদি রুকুতে বা সেজদায় যেয়ে বা যেকোন অবস্থানে এক ঘণ্টাও থাকেন সেক্ষেত্রে মোক্তাদীরও এক ঘণ্টা সেই অবস্থায় থাকতে হবে, এর ব্যতিক্রম করলে তার সালাহ পণ্ড হয়ে যাবে। এখানে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না যে, আপনি কেন সেজদায় বা রুকুতে গিয়ে এত সময় আছেন? কর্মসূচির চার নম্বর হলো হিজরত। একইভাবে সালাতে যারা আসবে তারাও পূর্বের জীবনের সমস্ত শিরক, কুফর থেকে হিজরত করে অর্থাৎ ওগুলো পরিত্যাগ করে সালাতে আসবে। সুতরাং কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করতে গেলে যে চরিত্রের প্রয়োজন তা গঠন করবে ঐ সালাহ। কোর’আনে আল্লাহ সালাহ সম্বন্ধে সর্বদাই বলেছেন, সালাহ কায়েম কর, তিনি বলেন নাই যে সালাহ পড়, বা সালাহ আদায় কর, বলেছেন কায়েম কর। কায়েম শব্দের অর্থ কোনো জিনিস বা বিষয় স্থায়ী, দৃঢ়, শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সালাহ তাহলে কোথায় প্রতিষ্ঠিত করবে? করবে নিজেদের চরিত্রে, অর্থাৎ সালাহ যে গুণগুলি সৃষ্টি করে তা নিজেদের চরিত্রের ভেতর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ কায়েম করে পাঁচ দফার কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করবে। তবেই যে উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচি আল্লাহ প্রণয়ন করে আমাদের দিয়েছেন সেটা অর্জনে সফলতা আসবে, নইলে আল্লাহর সাহায্যও আসবে না, সাফল্যও আসবে না। মনে রাখতে হবে, যে লোক সারা জীবন, দিন রাত্রি সালাহ কায়েম করল, প্রত্যেক ওয়াক্তের প্রথম ভাগেই সালাহ পড়ল বা আদায় করল কিন্তু তার চরিত্রে কঠিন ইস্পাতের মতো ঐক্য, কঠিন শৃঙ্খলা, প্রশ্নহীন আনুগত্য ও শিরক-কুফর-জুলম-নিফাক-ফিসক ইত্যাদি থেকে মুক্তি আসলো না (হিজরত), তার সমস্ত জীবনের সালাহই অর্থহীন, নিষ্ফল। আবার ঐ সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে যে, যে লোক সালাহর মাধ্যমে এই সমস্ত গুণ অর্জন এবং সুদৃঢ়ভাবে কায়েম করল কিন্তু তার ঐ চারিত্রিক গুণগুলি নিয়ে কর্মসূচির পঞ্চম দফা অর্থাৎ হেদায়াহ ও দীনুল হককে পৃথিবীতে বিজয়ী করার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লিপ্ত হলো না তার ঐ চারিত্রিক সফলতাও অর্থহীন, মূল্যহীন।
প্রথম চার দফার চরিত্র ছাড়া অর্থাৎ গলিত সীসার প্রাচীরের মতো ঐক্য, পিঁপড়ার মতো শৃঙ্খলা, মালায়েকের মতো শর্তহীন-প্রশ্নহীন- দ্বিধাহীন আনুগত্য এবং সাহাবীদের মতো হিজরত অর্জন না করে কেউ যদি আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ ব্যয় করে সংগ্রাম করতে চায়, তবে করতে পারবে কিন্তু তারা দীন প্রতিষ্ঠার সেই সংগ্রামে আল্লাহর নসর পাবে না, ফলে বিজয়ী হতে পারবে না। ফলে তাদের ঐসব কাজ করা না করা সমান হবে, পণ্ডশ্রম হবে। কাজেই নিজেদের চরিত্রের মধ্যে চার দফার গুণগুলি পূর্ণভাবে কায়েম করতে হবে।